ইতালিতে রোজা ও ইফতার
ইতালিতে আসার পর করোনাভাইরাসের মহামারিতে এখানে লকডাউন ঘোষিত হওয়ায় ঘরে আটকা পড়ি। আবার বাংলাদেশেও লকডাউন ও বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় ফিরতে পারিনি। সে কারণে প্রথমবারের মতো প্রবাসে রমজানের রোজা পালনের সুযোগ হলো এবার।
বাংলাদেশ থেকে এক দিন আগেই এখানে রোজা শুরু হয়। প্রথমে একটু চিন্তায় ছিলাম, কীভাবে এখানে রোজা পালন করতে পারব সেটা নিয়ে। কেননা, প্রথমত আমার ডরমেটরির ক্যানটিনে হালাল খাবারের সংকট, প্রায় বেশির ভাগ খাবারের আইটেমেই এখন শূকরের কোনো অংশের সংমিশ্রণ থাকে। আর শূকরের মাংসের বিভিন্ন আইটেম তো থাকেই। লকডাউনের আগে অবশ্য এমন ছিল না।
করোনা পরিস্থিতিতে ডরমেটরিতে আমার মতো নিতান্ত বাধ্য হয়ে থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাতে গোনা, সে কারণে এখন খাবারের আইটেম কম, কেননা তারা পোষাতে পারছে না। অন্যদিকে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ইউরোপ–আফ্রিকার, যাঁদের ওসব খাবারে সমস্যা নেই। তবু কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে যা কিছু হালাল পাওয়া যায়, সেগুলোই প্রতিদিন খেয়ে নিই।
সকাল ৮টা থেকে ৯টায় নাশতা, দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা দেড়টায় দুপুরের খাবার এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত রাতের খাবার। অথচ তুরিনে সন্ধ্যা হয় সাড়ে ৮টায়।
রমজানে সাহরি ও ইফতার নিয়ে পড়লাম চিন্তায়। ডরমেটরিতে আমিসহ মোট চারজন পাওয়া গেল, যাঁরা রোজা পালনে আগ্রহী। পরে অবশ্য কোর্স সেক্রেটারি লাইজা আমার সঙ্গে আলোচনা করে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন যে আমি রোজা পালনে আগ্রহী। অন্যদের বেলায়ও তাঁদের কোর্স কর্তৃপক্ষ জেনে নিয়ে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। ফলে সকালের নাশতাটা প্যাকেট ভর্তি করে রাতের খাবারের সময় আমাদের দিয়ে দেওয়া হলো প্রতিদিন। নাশতার আইটেমেও পরিবর্তন আনা হলো। আমাদের প্রতিদিনের সাহরির প্যাকেটে দেওয়া হলো, সিদ্ধ ডিম একটা, একটা কেক, একটা আপেল, এক প্যাকেট জুস, পাঁচ–ছয়টা খেজুর, এক বানরুটি, কিছু চিনাবাদাম, টকদই। বেশ ভালোই মনে হলো, কর্তৃপক্ষ অন্য ধর্মাবলম্বী হলেও আমাদের রোজা পালনে সহায়তার কার্পণ্য করেনি। এ ছাড়া রাতের খাবারের সময় পরিবর্তন করে ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত করা হলো। শুরুর দিকে এখানে সাহরি খাওয়ার সময় শেষ হতো সোয়া চারটায় আর ইফতার রাত ৮টায়, সুতরাং বেশ দীর্ঘ সময় রোজা। বাংলাদেশে এতটা সময় আমাদের কখনো রোজা রাখতে হয়নি, ইউরোপের দেশগুলোয় দীর্ঘ সময় রোজা পালন করতে হয়। এখানে মসজিদের সংখ্যা এমনিতেই কম, তারপর জামাত নিষিদ্ধ থাকায় সারা দেশেই মানুষ নিজের বাসাতেই তারাবিহ ও অন্যান্য ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। আমিও আমার কক্ষেই নামাজ পড়ি। আর ইফতারের পরে বিভিন্ন কোর্সের কয়েকজন মিলে করোনা পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে গল্প করি। এভাবে তুরিনে রমজানের প্রথমার্ধ কেটে গেল।
পরে বিশেষ কিছু কারণে রোম শহরে এলাম। উঠলাম বাঙালি পরিবারে। মনে হলো কয়েক মাস পরে যেন বাংলাদেশে চলে এসেছি। এখানে বেশ কয়েকজন বাঙালি থাকেন, বাংলায় কথা বলা, সব বাঙালি খাবার খাওয়া, বাংলাদেশি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা এবং ইফতারেও বাংলাদেশি বেগুনি, পিঁয়াজু, ডিমের চপ, আলুর চপ, ছোলাবুট, মুড়ি, শরবত, তরমুজ, বাঙ্গি, খেজুর, জিলাপি, মুড়ি ও অন্যান্য ফলমূল ইত্যাদি আয়োজন। আবার কখনো সঙ্গে কাবাবও থাকে। এখানে অবশ্য তুরিনের চেয়ে আধা ঘণ্টা আগেই ইফতার। রোমে আসার পরপরই অবশ্য লকডাউন শিথিল পেলাম, মে মাসের ১৮ তারিখ থেকে। এখন কোথাও যেতে বাধা নেই, তবে মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে। এখন আর সবখানে ডিক্লারেশন ফরম দেখাতে হচ্ছে না। রোমের অবস্থা অনেকটাই ভালো হলেও পুলিশ এখনো এখানে টহল দিয়ে দেখছে মানুষ নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি ব্যবহার করছে কি না ও সামাজিক দূরত্ব নীতি প্রতিপালন করছে কি না। বেশির ভাগ অফিস চালু হয়েছে।
এরই মধ্যে বেশ কিছু বাঙালির ইফতারের দাওয়াত রক্ষা করতে হলো। তাঁদের সঙ্গে কথাও হলো, বেশির ভাগই লকডাউনের পুরোটা সময় ঘরে বসে কাটিয়েছেন, কাজ নেই। তবে যাঁরা হাসপাতাল, পেট্রলপাম্প, খাদ্য সরবরাহ কিংবা ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় ও আবশ্যকীয় সেবায় যুক্ত, তাঁদের কাজে যেতে হয়েছে। অবশ্য লকডাউন শিথিল হলেও পর্যটন খাতের সঙ্গে যুক্ত যাঁরা, বিশেষ করে হোটেল-মোটেল কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এখনো সচল হতে পারেনি। ইতালি অবশ্য ৩ জুন থেকে পর্যটকদের আসার সুযোগ করে দিচ্ছে, তথাপি কবে আসলে স্বাভাবিকভাবে পর্যটকেরা আসতে পারবেন, তার ঠিক নেই।
এবারের রমজানে প্রবাসে ভিন্ন আঙ্গিকে রোজা ও ইফতার পালনের পাশাপাশি জীবনের আরও নতুন কিছু দিক দেখার সুযোগ হলো। এসব বাংলাদেশি মানুষের সঙ্গে ইফতার করতে করতে আরও অনেক কিছুই জানার সুযোগও হলো। তাঁদের জীবন, পরিবার, দেশ নিয়ে ভাবনা, এমনকি এখানে সূদুর প্রবাসেও কীভাবে অনেকেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, কিংবা তাঁদের ঠকানো হয়, সেসব বিষয়েও জানতে পারলাম। যেমন মালিক যে শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করেন, সে শ্রমিকের পদ ও বেতন গ্রেড অনুযায়ী সরকারের কোষাগারে ট্যাক্স প্রদান করতে হয় মালিককে। এ ক্ষেত্রে অনেক মালিক ছলনার আশ্রয় নেন। তাঁরা শ্রমিককে নিম্নতম পদে ও গ্রেডে নিয়োগ দেখান, তাহলে সরকারকে কম ট্যাক্স দিতে হয়। আবার শ্রমিককেও কম পরিমাণে বেতন দেন। শ্রমিকের যেহেতু কাজের দরকার, মালিকের এমন শর্তেও রাজি হয়ে যান। তাঁরা উচ্চতর পদের ও গ্রেডের কাজ করলেও ওই নিম্নতম পদের ও গ্রেডের বেতন পান। ফলে পুষিয়ে নিতে তাঁরা হয়তো দীর্ঘ সময় কাজ করেন, কেউবা একাধিক জায়গায় কাজ করেন। থাকেন অনেকে মিলে একটি বাসায়। যতটা সম্ভব নিজের জন্য কম ব্যয় করে দেশে টাকা পাঠান।
ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের অনেকেই তাঁদের বাঁকা চোখে দেখে কিংবা রিফিউজি মনে করে, এটাও বললেন কেউ কেউ। তবু বেশির ভাগ বাংলাদেশি ইতালির পুলিশের প্রশংসা করেন। তাঁদের মতে, বাংলাদেশি শ্রমিকের প্রতি এ দেশের পুলিশের ‘সফট কর্নার’ আছে; অনেক সময় বৈধতা নেই জেনেও নাকি না জানার ভান করে ছেড়ে দেয়। অবশ্য, এ দেশের অর্থনীতিতেও বাংলাদেশি শ্রমিকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইফতার করতে করতে তাঁদের মুখে আশার আলো দেখতে পাই, ইতালি সরকার এ দেশে শ্রমিকদের বৈধতা প্রদানের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তার মাধ্যমে হয়তো জীবন বাজি রেখে পরিবার–পরিজন ছেড়ে প্রবাসে পড়ে থাকা এসব মানুষের কাজের বৈধ অনুমতি পাওয়া যাবে।