ইঙ্গিতে...

ঘাসের ওপর মাথা রেখে আকাশটা মনে হয় যেন খুব কাছে। আবার চোখ বন্ধ করলে পাশের মানুষটাও হয়ে যায় অনেক দূরের। মনে আছে, ছোট বেলায় মা আমাকে বাবার শাসনের হাত থেকে বাঁচাতে ইশারায় বোঝাতেন কথা, আমি মায়ের সব কথার ইঙ্গিত বুঝে নিতাম। পড়াশোনায় মোটামুটি ছিলাম, কলেজের এক ছেলের সঙ্গে প্রেম হয়ে যায়। বাবা মায়ের অমতেই আমরা বিয়ে করি। কারণ, বাবার ইচ্ছে ছিল আমি ভালো কিছু করব জীবনে। বিয়ের জন্য তা আর সম্ভব হয়নি। আমার জন্য শাফিনের ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। দুজনই যত্ন করে বাঁধি অভাবের সংসার, ধীরে ধীরে কোলজুড়ে আসে অহনা। শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়, ব্যস্ততার মাঝে কাটে দিন–রাত। শাফিন ছিল অনেক বড় ঘরের, তাই সংসারের টানাপোড়েনেও যেন হাঁপিয়ে উঠতে থাকে। ছোট্ট অহনার জন্য আমিও কাজে যেতে পারি না, আবার কোনো বেবি সিটার রাখার মত বাড়তি পয়সাও নেই।

মাঝে মাঝে শাফিন বেশ দেরি করে আসে, আবার কখনো না খেয়ে শুয়ে পড়ে। প্রশ্ন করলেই বলে, এত কেন তোমার কৌতূহল? ওর মায়ের অনেক ইচ্ছে ছিল, তাঁর বান্ধবীর মেয়ের সঙ্গে শাফিনের বিয়ে দেওয়ার। মেয়েটির বাবা সচিব, তা ছাড়া মেয়েটিও মেডিকেলের ছাত্রী ছিল। পরে শুনেছি ডাক্তার হয়েছে, কখনো তাকে দেখিনি। কিন্তু শাফিন আমাকে ভিশন ভালোবাসত, আমার প্রতি খুব খেয়াল করত। কাজের ব্যস্ততাও বেড়েছে প্রতিদিনের, ইদানীং ওকে কেমন যেন পর পর মনে হয়। আমার অন্তর দৃষ্টি বলে, শাফিন হয়তো তার মায়ের বাড়ি যায়। আমি কষ্ট পাব বলে কিছুই আমাকে বলে না।

একদিন শাফিন বলল, অহনাকে নিয়ে বাইরে যাবে ঘুরতে, আমিও বাধা দিইনি তাতে। এভাবে করে ও প্রায়ই নিয়ে যায়। একদিন আমি খুব জোর করলাম ওদের সঙ্গে যাব বলে। কিন্তু ও রাজি হয়নি, বরং কেন সন্দেহ করছি এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া শুরু হলো। কথায় কথায় বেরিয়ে আসল, ওর মা অহনাকে দেখতে চায়।

বুঝতে আর বাকি রইল না, শাফিন এখন নিত্যই মায়ের কাছে যায়। আমার ভয় বাড়তে থাকে, ওরা শাফিনকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলবে নাতো? প্রায় প্রতিদিনই রাগারাগি যেন অশান্তির চরমে চলে যেতে থাকল। অহনাকে দাদির কাছে নিয়ে যেতে বাধা না দিলেও আমি অবাক হয়ে যাই, রাতে শাফিন একা বাসায় ফিরে। কিছু বলার আগেই ‘অনু (অহনা) আজ মায়ের কাছে থাকবে’ বলে শাফিন আমাকে বলে, তুমি শুয়ে পরো। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।

–শাফিন তুমি কি শুরু করছ বলতো? তুমি কি আমার কাছ থেকে অনুকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছ? আগে কোথায় ছিল তোমার মা? অনুর জন্য আমি কাজে ঢুকিনি, ওর যাতে খেয়াল রাখতে পারি। আজ যখন অনুর দুই বছর কথা বলতে শিখেছে, তুমি আমাকে ওর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছ? তুমি কেন এমন করছ?

শাফিন কোনো কথা না বলেই শুয়ে পড়ে। সকালে আমার যখন ঘুম ভাঙলে দেখি, সে বাইরে যেতে রেডি হয়ে গেছে। আমাকে দেখে বলে, ‘তুমি যদি কাজ করতে চাও, করতে পারো। অনুর জন্য চিন্তা করো না। আমার মা বাইরের কেউ নয়, তোমার চেয়ে ভালোই খেয়াল রাখতে পারবেন। আমি চাই না, অনুর ভবিষ্যৎটা খারাপ হোক, বাবার যা কিছু আমিই তো পাব। অনুকে মা–বাবা খুব ভালোবাসেন, আমিও চাই অনুর ভালো ভবিষ্যৎ। এতে আমাদেরই স্বার্থ, তুমি এটা নিয়ে রোজ রোজ অশান্তি তৈরি করো না।’

শাফিন এসব কথা বলে চলে গেল। ‘এই অশান্তি আমার ভালো লাগছে না’—আমিও ভাবতে পারছি না কী করব। শাফিন যেন আমার কাছে অপরিচিত হতে শুরু করছে, অনুও আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাচ্ছে। শাফিনকে ভুলে থাকতে পারব, কিন্তু অনু? ওর জন্যই তো আমার জীবনযুদ্ধ শুরু হয়েছে, আমার মনজুড়ে শুধুই অনু। আমার মনের ভেতর অশান্তির তীব্রতা বেড়েই চলছে, শাফিন আমার এত কাছে থাকলেও সন্দেহ প্রকটভাবে বাসা বাঁধে মনে। শাফিন আমাকে ছেড়ে চলে যায় ওর মায়ের কাছে, ধীরে ধীরে আমার ট্রমার অবস্থা হয়।

ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ করি, পয়সা আমার জন্য কম নয়। একদিন নিজেকে সুস্থ করতে মনস্তত্ত্ববিদের কাছে যাই। কিছু থেরাপির পর আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। আমার ডাক্তার এসে বললেন, ‘অতীত আপনার জীবন থেকে গত হয়েছে, যা আপনার জন্য ভুলে থাকা তেমন অসম্ভব নয়। আপনার বয়স তেমন নয় যে, নিরাশ হয়ে বেছে নেবেন একাকিত্ব। চেষ্টা করে খুঁজে বের করুন, কী আপনার ভালো লাগে। বইপড়া, গল্প করা, মুভি দেখা, রান্না কিংবা বাগান—এর মধ্যে যা কিছু মন চায়, চেষ্টা করতে পারেন। অন্য রোগীদের দেখতে পরিবারের কেউ আসলে আমি তাকিয়ে থাকি। একদিন আমার পরের তিন নম্বর বেডের রোগীকে দেখতে তার নাতনি আসে। আমি ওকে দেখে অনুর কথা ভেবে কাঁদতে থাকি, নার্স এসে আমাকে ঘুমের ওষুধ দেয়। পরদিন ডাক্তার আমাকে আমার পারিবারিক কথা জিজ্ঞেস করে, আমি শুরু থেকে সব কথাই বলি। তবে বললাম, আমি শাফিন আর অনুর বর্তমান কিছুই জানি না। ডা. হু..ম বলে চুপ।

কেটে যাচ্ছে দ্রুত সময়, ডাক্তার একটি চার বছরের মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই বাচ্চাটি নতুন ভর্তি হয়েছে, তবে ও স্পেশাল চাইল্ড’। ওর সঙ্গে (সাইন ল্যাংগুয়েজ) আকার–ইঙ্গিতে কথা বলতে হয়। আপনি সময় করে ওর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তবে ও যেন কোনো অবস্থায় আপনাকে ভয় না পায়। এক সপ্তাহের জন্য এখানে থাকবে। নার্সকে জিজ্ঞেস করেই তবে কথা বলবেন, কোনোভাবে বিরক্ত যেন না হয়।’

আমি খুশিই হলাম, প্রথম দিন শুধু তাকিয়ে থাকলাম। ও আমাকে দেখছিল আর আমি শুধু ওর মাঝে অনুকে ভাবছিলাম, আমার জানালা থেকে ওর বেডটা দেখা যায়। আমি ইশারায় গুড নাইট বলতেই ও হাত নাড়িয়ে উত্তর দিল, সারা রাত এত ভালো লাগছিল এটা ভেবে যে, ও বুঝেছে আমাকে। নার্স আমাকে ওর সঙ্গে কথা বলা বা কাছে আসার অনুমতিই দিচ্ছিল না। তবে ইশারা/ইঙ্গিতে কথা হতো প্রতি রাতে। আজ রাতে ওকে আর দেখতে পাচ্ছি না, ওই দিকে যাওয়াও নিষেধ। তাই ঘুম হল না। সকালে নার্সের কাছে জানতে পারি, ও গতকাল বিকেলে বাড়ি ফিরেছে। আমিও আর তিন দিন পর চলে যাব এখান থেকে। মনটা অস্থির লাগছে, আবার যেন একাকিত্ববোধ চেপে বসছে নিজের ভেতর।

ডাক্তার এসে বললেন, আজ তো আপনার ছুটি হবে বিকেলে। আপনার সব কথা শুনে খারাপ লাগলেও মনে হয় এখনো কিছু ভালোমানুষ আছে পৃথিবীতে। আর তাই আমার কাছে আপনার কথা শুনে দুপুরে একজন মহিলা আসবেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমার খুবই পরিচিত মানে আমার আম্মার বান্ধবী। উনি আসলে নিয়ে আসব আপনার কাছে, আর নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন।

তখন সবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁই ছুঁই। দেখি, হালকা ছাই রঙের সবুজ পাড়ের শাড়ি পরে একজন মধ্যবয়সী মহিলা নার্সের সঙ্গে আসছেন। আর নার্সের হাত ধরে হাঁটছে খুব মিষ্টি একটি বাচ্চা মেয়ে। আমার দরজায় কাছে এসে আমাকে নার্স দেখিয়ে দিল। উনি বললেন, ‘বউমা আমি শাফিনের মা, আমি তোমাকে নিতে এসেছি। আমি অনুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি, একটু পর শাফিন মাথায় হাত বুলিয়ে বলে চল বাড়ি যাবে।’

–কী করে এসব কিছু হল? কীভাবে সম্ভব হল? তোমরা আমার খোঁজ কি করে পেলে?

–ইতি মানে তোমার ডাক্তার শাফিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব বলেছে। শাফিন আর তোমাদের নিয়ে আমি নতুন করে বাঁচতে চাই বউমা। তুমি তোমার সংসারে ফিরে এসো, আমি আর কত দিন বাঁচব জানি না। এখন তৈরি হও যেতে।

আমি অনুর হাত ধরে ডাক্তার ইতির কাছে আসতেই বললেন, ভালো থাকবেন, আমার বাসায় বেড়াতে আসবেন। আপনার এখন পুরো পরিবার আপনার সঙ্গে। শাফিন আপনাকে খুব ভালোবেসে। সেও আপনার খেয়াল রাখবে, যেকোনো প্রয়োজনে কল করবেন কথা হবে।

বিদায় জানিয়ে গাড়িতে বসি, ভাবতে কেমন যেন অবাক লাগছে। আমি কোথায় ছিলাম, এখন কোথায় যাচ্ছি।

অনু ইঙ্গিত করল বাবার দিকে। জোরে জোরে বলল, ‘ড্যাড তুমি কি কাঁদছ?’

শাফিন হেসে বলল, পাকা বুড়ি হয়েছ। গাড়ি থেকে নামতেই শাফিন গোলাপের ফুলগুচ্ছ হাতে দিল, আমার সারা অবয়বে উপলব্ধি করলাম সুখী পরিবারের পূর্ণতা। নতুন জীবনের আবির্ভাব হল শাফিন আর অনুকে নিয়ে।