ইউরোপে কোরবানির সমস্যা ও আমার অভিজ্ঞতা

ইউরোপের কোনো দেশেই মুসলমানদের কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ছুটি থাকে না। তাই মুসলমানদের ছুটি নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়। আসছে ১১ আগস্ট আরব দেশসহ ইউরোপে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। এবার ঈদ রোববার হওয়ায় অনেকেই ছুটিতে থাকবেন। আলাদা করে ছুটি নিতে হবে না।
এখানে যাঁরা পরিবার নিয়ে থাকেন তাঁদের অনেকেই কোরবানি দেওয়ার চেষ্টা করেন। আমাদের দেশের মতো এখানে যেখানে-সেখানে পশু জবাই করা যায় না। পশু জবাইয়ের নির্দিষ্ট জায়গা আছে। আবার সব জায়গায় ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী পশু জবাই করার অনুমতি নেই। যেখানে অনুমতি আছে সেখানে পশুর দাম তুলনামূলক বেশি।

যাঁদের অনুমতি আছে সেখানে দুই মাস আগে বুকিং দিয়েও অনেকে প্রথম দিন কোরবানি দিতে পারেন না। আবার প্রথম দিনের বুকিং দিতে পারলেও কখন মাংস নিয়ে বাসায় ফিরবেন, তা বলতে পারেন না। গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাই অনেকেই ঝামেলা এড়াতে মাংসের দোকানে বুকিং দিয়ে দেন। পশু পছন্দ থেকে মাংস পৌঁছানো পর্যন্ত সবকিছুই দোকান মালিকই করে থাকেন।
আবার আমার মতো অনেকেই আছেন নিজে পছন্দ করে কোরবানির পশু কেনা, জবাই করা, মাংস কাটাসহ সব কাজ করেন। ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে প্রবাসে আমার প্রথম কোরবানির ঈদ। তখন থেকে আমরা এখানে কোরবানি দিয়ে আসছি।
প্রথম বছরের অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন ছিল। আমাদের দেশের মতো একটা খামারির বাড়িতে গরু জবাই করেছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি সেটা ছিল অবৈধ। তার পর থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় কোরবানি দিয়ে আসছি। ২০০৯ সালের আগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পশু জবাই করার বিভিন্ন আইন ছিল। ২০০৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সব দেশের জন্য অভিন্ন আইন পাস করে, যা ce ১০৯৯ /২০০৯ নামে পরিচিত। এই আইনে মুসলমানদের জন্য একটা আর্টিকেল আছে। যিনি পশু জবাই করবেন, তাঁর জবাই করার লাইসেন্স থাকতে হবে।
আমি অনেক বছর ধরে আমাদের কোরবানির পশু জবাই করে আসছি। এমনকি গত বছর বাংলাদেশে গিয়েও আমাদের কোরবানির পশু আমি নিজেই জবাই করেছিলাম। কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমার জানাই ছিল না ইউরোপে পশু জবাই করতে লাইসেন্স লাগে। যেখানে নিয়মিত কোরবানি দিয়ে আসছি তারাও কখনো বলেননি এটা লাগবে।
এবার আগে বুকিং দিইনি বলে ওখানে অনেক পরে কোরবানি দিতে হবে। তাই নতুন জায়গা খুঁজতে থাকি। একটা জায়গায় পাওয়া গেল যেখানে মুসলমানদের পশু জবাই করার অনুমতি আছে। বিপত্তি দেখা দিল কে জবাই করবেন। ওখানে যে মুসলমান ছেলেটা পশু জবাই করেন, তিনি ছুটিতে তাঁর দেশে গেছেন। আমি বললাম জবাই আমি করব। মালিক আমাকে জানালেন, জবাই করতে লাইসেন্স লাগবে। তাকে বোঝালাম আমি অনেক বছর ধরেই জবাই করে আসছি। তার সোজা কথা, লাইসেন্স ছাড়া তিনি করতে দেবেন না।
মহা ঝামেলায় পড়ে গেলাম। খুঁজতে শুরু করলাম কীভাবে লাইসেন্স করতে হয় বা পরিচিত কার লাইসেন্স আছে। জানতে পারলাম আমাদের মাংস দোকানদারের আছে। তাঁকে ফোন দিয়ে অনুরোধ করলাম ঈদের দিন আমাদের কয়েকটা পশু জবাই করে দিতে। তিনি জানালেন তার ইচ্ছে থাকলেও পারবেন না। কারণ তিনি অনেকের বুকিং নিয়ে রেখেছেন।

পরে যে সংস্থা লাইসেন্স দেয় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার সমস্যার কথা বললাম। তাদের সহযোগিতায় মাত্র ছয় ঘণ্টা ক্লাস করে পরীক্ষা দিয়ে অস্থায়ী লাইসেন্স পাই। তাদের সঙ্গে দুই ঘণ্টা প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিলে সেটা স্থায়ী করে দেবেন। এবারের মতো কোরবানি নিয়ে চিন্তামুক্ত হলাম।
বলে রাখা ভালো, এখানে পশু জবাই করার সময় একজন পশু চিকিৎসক উপস্থিত থাকেন। জবাইয়ের পর চামড়া ছড়িয়ে বর্জ্য পরিষ্কার করার পর তিনি পরীক্ষা করে অনুমতি দিলেই মাংস কাটা যাবে। চিকিৎসক মাথার মগজ, যকৃৎ ও ফুসফুস—এগুলোই বেশি পরীক্ষা করেন। জবাই করার জায়গা সব সময় পরিষ্কার রাখতে হয়। তাই একটা জবাই শেষ হলে সঙ্গে সঙ্গে সেটার বর্জ্য সরিয়ে নেওয়া হয়।
দেশের সবাইকে অনুরোধ, সবাই নিজ নিজ পশুর বর্জ্য অপসারণ করে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখুন। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
---
লেখকের ইমেইল: <[email protected]>