ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান: পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া ও আমাদের শিক্ষণীয়

রাশিয়ার একটি এটিএম বুথে অর্থ তোলার লাইনছবি: রয়টার্স

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া তার পার্শ্ববর্তী দেশ ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ‘নিও-নাৎসি’ তত্ত্বের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থাকলেও মূল কারণ রাশিয়ার নিরাপত্তা। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো সাবেক সোভিয়েত ‘ওয়ারশ’ ব্লকের দেশ পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়াকে তাদের বলয়ে নিয়ে আসার পর রাশিয়ার পাশের বাড়ির ইউক্রেনকে যখন তাদের বলয়ে আনার পরিকল্পনায় নেয়, তখন সম্ভবত রাশিয়ার ধৈর্য ভেঙে যায়। রাশিয়া পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রতিকূলতা মাথায় নিয়েই আট বছর ধরে আজকের এ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু তার হিসাবে ভুল হয়েছে বলেই অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যদি এ নিষেধাজ্ঞা প্রলম্বিত হয়, তাহলে রাশিয়ার সমগ্র অর্থনীতি ৫ শতাংশ ও জিডিপি -৭.৫ শতাংশ সংকুচিত হবে বলে সিএনএন বিজনেসের মার্ক থমসন মনে করেন (সিএনএন বিসনেস ডটকম-রাশিয়া)। রাশিয়ার যুদ্ধাবস্থানের সঙ্গে আমাদের দেশের অমিল থাকলেও অর্থনীতি বিষয়ে মিল হয়ে যেতে পারে যদি আমরা সন্তর্পণে পদক্ষেপ রচনা না করি।

বর্তমান ইউক্রেন একসময় অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য, রাশিয়া, পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়াদের করায়ত্ত ছিল। ১৯১৭ সালে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে স্বাধীনতা লাভ করে তার নাম রাখে ‘ইউক্রেনিয়ান পিপলস রিপাবলিক’। কিন্তু ১৯২৪ সালে ফেব্রুয়ারিতে সাবেক সুপার পাওয়ার সোভিয়েত রাশিয়া ইউক্রেনকে দখল করে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেন, তখন ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী নেতা স্টিফেন বেনডেরার নেতৃত্বে একদল জাতীয়তাবাদী নাৎসি বাহিনীকে সহায়তা করে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তখনই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের সন্নিকটে কনসেন্ট্রেসন ক্যাম্প স্থাপন করে হাজার ইহুদিসহ সোভিয়েত বংশোদ্ভূত লোকদের গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয়। রাশিয়ার নেতা পুতিন এ প্রেক্ষাপটেই ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ‘নিও-নাৎসি’ বলেছেন। এরপর সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচভের ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেসট্রইকার’ সুবাদে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ১৯৯১ সালে আবার ইউক্রেন নিজস্ব স্বকীয়তা ফিরে পায়। নিজস্ব স্বকীয়তা ফিরে পেলেও রাশিয়ার প্রভাব একেবারে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি। ২০১৩ সালে ইউক্রেনের তৎকালীন রাশিয়া-সমর্থক প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে অস্বীকার করলে পার্লামেন্টে ও প্রচণ্ড গণবিক্ষোভে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এর পর থেকেই শুরু হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার সঙ্গে ইউক্রেনীয়দের মৈত্রী, যা রাশিয়ানরা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছিল না। ২০১৪ সালের মার্চে রাশিয়া ইউক্রেনের দক্ষিণ-পশ্চিমের পোর্ট সিটি ক্রিমিয়া দখল করে নিলে পরিস্থিতি ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব করা হয়। বেলারুশের রাজধানী মিনস্ক রাশিয়ার পুতিন ও ইউক্রেনের পেট্রো প্রসেনকোর মধ্যে ফ্রান্সের হল্যান্ডেরই ও জার্মানির এনজেলা মার্কেলের মধ্যস্থতায় একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং উভয় পক্ষই উপদ্রুত অঞ্চল থেকে ভারী গোলাবারুদ সরিয়ে নিতে সম্মত হয়। এর দুই মাস পর ন্যাটো পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়ায় ৪ ব্যাটালিয়ন সৈন্য মোতায়েন করে, যেখানে আমেরিকার দুটি ট্যাংক ব্রিগেড রয়েছে। ন্যাটোর এই বর্ধিতকরণ রাশিয়া নিজেদের জন্য ভীষণ হুমকি মনে করছিল এবং ভেতরে-ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগ্রহের কারণে রাশিয়া আর সুযোগ দিতে চায় না এবং তারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ইউক্রেন আক্রমণ।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে কঠিন ও দ্রুততার সঙ্গে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ দেখেনি। রাশিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী সার্গেই অ্যালেসাসেনকো বলেছেন, এটা একটি ‘অর্থনৈতিক পারমাণবিক বোমা’ রাশিয়ার ওপর পতিত হয়েছে। সত্যিই কোনো দেশের মুদ্রামান এত সংক্ষিপ্ত সময়ে এত নিচে নামেনি, যা রাশিয়ার রুবলের ক্ষেত্রে ঘটেছে। রুবল ৪০ শতাংশ তার মূল্য হারিয়েছে। পশ্চিমারা রাশিয়ার রিজার্ভ ৬২০ বিলিয়ন ডলার জব্দ করে রেখেছে। রাশিয়ার ব্যাংক, তেল ও গ্যাস, বিভিন্ন রপ্তানি পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাজারে মুদ্রাস্ফীতিতে মানুষের হাহাকার পড়ে গেছে। বিভিন্ন ব্যাংকের সামনে মাইলের মতো লম্বা লাইন পড়ে গেছে। রাশিয়ার জিডিপি -৭.৫০ শতাংশ গ্রোথ এবং টোটাল ইকোনমি ৫ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। এসব তথ্যচিত্র থেকে এ কথা স্পষ্ট, পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থারই একচ্ছত্র আধিপত্য। রাশিয়ার মতো দ্বিতীয় সুপার পাওয়ার অসহায় হয়ে মিউ মিউ করছে।

*লেখক: মফিজুল হুসেন নিজাম, নিউইয়র্ক