ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থামুক, বাঁচুক মানুষ
ইউক্রেন এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। যুদ্ধের সময় খুব বেশি দিন নয়। এখনো চলছে। এই অল্প সময়ে বদলে গেছে পরিস্থিতি। প্রায় ৪ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার দেশ ইউক্রেন। সে দেশে এখন জ্বলছে আগুন। পুড়ছে হাজারো স্মৃতিঘেরা মানুষের স্বপ্নের ঘর। একটু আশ্রয়ের জন্য মানুষ ছুটছে এদিক–ওদিক। যুদ্ধ মানে ধ্বংস, জীবন আর মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ। এক আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকা। কী ভয়াবহ এক পরিস্থিতি! জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, রুশ হামলার পর ইউক্রেনের প্রায় এক লাখ মানুষ বাড়ি ছেড়েছে। অনেকে আশ্রয় নিয়েছে শরণার্থী ক্যাম্পে। যুদ্ধে একটা দেশ জিতে যায়। কিন্তু সেই জয় আসে সাধারণ মানুষের রক্তের পথ বেয়ে। সৈনিকেরা জীবনের শেষনিশ্বাস ফেলেন যুদ্ধের মাঠে। থাকে না পাশে কোনো আপনজন। এটাই বাস্তবতা।
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে একটি দেশ জয়ী হবে। কিন্তু ক্ষতি তো দুই দেশের হচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে। আর মারা যাচ্ছে হাজারো মানুষ। ইউক্রেনের ডেপুটি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দাবি, এ পর্যন্ত রাশিয়ার ৪ হাজার ৩০০ সেনা নিহত হয়েছেন। ১৪৬টি ট্যাংক, ৭০৬টি যুদ্ধযান, ২টি ড্রোন, ২৬টি হেলিকপ্টার, ২৭টি উড়োজাহাজ ধ্বংস করেছে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বাহিনী। এদিকে ইউক্রেনেরও অনেক সেনা নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছে সামরিক, বেসামরিক অনেক মানুষ। আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অকল্পনীয়। যা দেখা যাচ্ছে—শুধু ধ্বংসস্তূপ। বৈরী আবহাওয়া আর রুশ সেনাদের ট্যাংকের শব্দে আতঙ্কিত মানুষ যেন জীবিত হয়েও মৃত। যেন যমদূত দাঁড়িয়ে আছে চোখের সামনে।
যুদ্ধ মানে অনেক কিছু হারানো। পাওয়া না পাওয়ার বেদনা ভরা ক্ষত চিহ্ন। আজকের এই যে আগ্রাসন, তা থেমে গেলেও মানুষের মনে দাগ থেকে যাবে আজীবন। বিশেষ করে আপনজন যারা হারিয়েছে। ইইউর পররাষ্ট্র নীতি প্রধান জোসেপ বোরেল বলেন, ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার এ হামলা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে অন্ধকারতম হামলা।
রাশিয়া-ইউক্রেনের ওপর আগ্রাসন থামানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। প্রতিবাদ জানাচ্ছে লাখো মানুষ। বার্লিনে প্রায় এক লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার বিরুদ্ধে। রাশিয়াকে বলছে যুদ্ধ বন্ধ করতে। ইউক্রেনের ওপর আগ্রাসন থেকে সরে আসতে। এমনকি খোদ রাশিয়ার শীর্ষ দুই ধনকুবের ওলেগ ডেরিপাস্কা ও মিখাইল ফ্রিডম্যান প্রতিবাদ করছেন। ব্যবসায়ী ধনকুবের ওলেগ ডেরিপাস্কা রাশিয়াকে বলেন, যুদ্ধ নয়, শান্তি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আলোচনা করে যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করুন। রাশিয়ার অন্যতম ধনী ফ্রিডম্যান বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংক আলফা ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিও ‘রক্তপাত’ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, যুদ্ধ কখনোই প্রতিপক্ষের উত্তর হতে পারে না। এমনকি রাশিয়ার অনেক সাধারণ মানুষও এ যুদ্ধের বিপক্ষে। এ আগ্রাসন কীভাবে সমাধান করা যায়, তাই রাশিয়া-ইউক্রেন বেলারুশের গোমেল অঞ্চলে বৈঠকে বসেছে। কিন্তু কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। তারা নিজ দেশে ফিরে গিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আবার দ্বিতীয়বার বৈঠকে বসবে। অর্থাৎ ঝুলেই রইল, কোনো সমাধান হলো না। কিন্তু সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে মানুষের কষ্ট। আর এ ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো পক্ষ লাভবান হবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন। তারা চেয়েছিল রাজনৈতিক কৌশলে রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দমিয়ে রাখা, তা–ই হয়েছে। শুধু যে মানুষ হতাহত হচ্ছে তা তো নয়, বিরাট একটা অর্থনৈতিক ধাক্কা খাবে রাশিয়া। আর এর প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে। বিশেষ করে তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে। রাশিয়ার কাছে ইউক্রেন তেমন শক্তিশালী দেশ নয়। তারপরও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি দৃঢ় মনোবল নিয়ে কথা বলছেন। মূলত তাঁর এ দৃঢ়তা দেখে জনগণ এখন অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছেন। বলছেন, দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। তাঁদের এ দেশপ্রেমকে সম্মান জানাই। কিন্তু আগ্রাসন বন্ধ হোক, এটাই আমরা চাই।
এদিকে রাশিয়াকে হাতে না মেরে ভাতে মারবে—এমন ব্যবস্থা যেন নিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা। ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে একমত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যাংকে লেনদেন করতে সুইফট ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। তেল ও গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে রাশিয়া যে অর্থ আয় করে, সেই অর্থ আদায়ে দেশটি সুইফটের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তাই রাশিয়া যে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু তা–ই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আকাশসীমা যাতে রাশিয়া ব্যবহার না করে, তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এদিকে রাশিয়া আবার পাল্টা তাদের আকাশসীমা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য।
তাদের এ নিষেধাজ্ঞার ফলে জাঁতাকলে পড়েছে সাধারণ নাগরিকেরা। পদে পদে এখন তাদের হয়রানি হতে হবে। আর যাঁরা ভ্রমণপিপাসু বা ব্যবসায় কাজের জন্য ভ্রমণ করেন, তাঁদের এখন ঘরে বসে থাকতে হবে। এতে করে অনেকে এখন ফ্লাইট বাতিল করবে, এ কারণে সেই অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়বে। আবার, আন্তর্জাতিক ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা ও ইউরোপিয়ান ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা উয়েফার সব ধরনের প্রতিযোগিতা থেকে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করেছে। তাই আগামী বিশ্বকাপে খেলা অনিশ্চিত হয়ে গেল রাশিয়ার। এভাবে একের পর এক রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করলে তার পরিণাম যে ভালো হবে, তা কে বলতে পারে। কারণ, রাশিয়া যদি ক্ষিপ্ত হয়ে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে, তাহলে কেঁপে উঠবে পুরো বিশ্ব, শুরু হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আমাদের চাওয়া, সেদিকে যেন না যায়। আলোচনা করে সমাধান হোক, তা–ই চাই।
কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন পড়েছে হুমকির মুখে। দুই রাষ্ট্রনায়কের রেষারেষির কারণে সাধারণ মানুষ পড়েছে যন্ত্রণায়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা চেয়েছেন, পরোক্ষভাবে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রায় ২৬টির মতো দেশ। এর মধ্যে রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবিলায় ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা করবে বলেছে অনেক দেশ। ইতিমধ্যে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিচ্ছে জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস। কিছু দেশ মনে হচ্ছে চায় যুদ্ধ লাগুক। এতে তাদের লাভ। যুক্তরাষ্ট্র আর চীন এ ক্ষেত্রে বেশি লাভবান হচ্ছে। ক্ষমতা আর অর্থের জাঁতাকলে পড়ছে সাধারণ মানুষ। কথায় আছে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় প্রাণ যায় প্রজার। এখন হয়েছে এমন অবস্থা।
যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে পিষ্ট হবে সাধারণ মানুষ। আসলে কেউ যুদ্ধ চায় না। ইউক্রেনের অনেক নাগরিকের পূর্বসূরি রাশিয়াতে ছিল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যতই যুক্তি দেখাক, তার এ আগ্রাসন কেউ সমর্থন করছে না। যত তাড়াতাড়ি এ যুদ্ধ থামবে, ততই মঙ্গল। যখন দেখি ক্লান্ত স্থির বয়স্ক মানুষটি বলছেন, আমার এ ঘর ছেড়ে কোথায় যাব? কার কাছে যাব? আমার তো কেউ নেই। একজন মা তাঁর দুটো সন্তানকে নিয়ে দৌড়াচ্ছেন, ভয়ে আতঙ্কিত—কখন না আবার সেনাদের কবলে পড়ে যান। বাবা তাঁর সন্তানের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন আর গড়িয়ে পড়ছে চোখের পানি।
তখন মনে হয়, যুদ্ধ কার জন্য, মানুষই যদি না বাঁচে! এই যে আগ্রাসনের আগুন লাগল ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে, কবে থামবে কে জানে! থামতে থামতে হয়তো হারিয়ে যাবে অনেক কিছু। পরে থাকবে আগুনে পোড়া ইট–পাথর আর কংক্রিটের পোড়া চিহ্ন। স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ভাঙা দেয়াল আর মানুষের আপনজন হারানোর হাহাকার। আমরা যুদ্ধ চাই না। চাই যুদ্ধ থেমে যাক, বেঁচে থাকুক মানুষ। পৃথিবীটা হোক মানুষের।
*লেখক: এম আর ফারজানা, কলামিস্ট, নিউ জার্সি