ইংরেজি সাহিত্যে বাঙালি মুখ
তারা আহমেদ। বাংলাদেশি-আমেরিকান নতুন প্রজন্মের লেখক। প্রথম বই ‘দি ম্যারেজ কন্ট্রাক্ট’ লিখে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। কয়েক মাস আগে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নতুন বই ‘এক্সহেল’। বাবা হেলিম আহমেদ ও জান্নাত আরা বেগমের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার বড় তারা আহমেদ। সিলেটী পরিবারের সন্তান তারার জন্ম বাংলাদেশে, বড় হয়েছেন নিউইয়র্কে আর বর্তমানে বাস করছেন ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ডে। নিউইয়র্কের পেস ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ব্যাচেলর ডিগ্রি নেওয়ার পরে ২০১৪ সালে তাঁর বিয়ে হয় মোহাম্মদ শোয়েবের সঙ্গে। স্বামী পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তারা আহমেদের লেখালেখির সূচনা হাইস্কুলের নিউজপেপারে। তারপর ফেসবুকে নানা বিষয় নিয়ে লিখতেন। প্রথম বই ‘দি ম্যারেজ কন্ট্রাক্ট’ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের অক্টোবরে।
প্রথম বইয়েই বাজিমাত। বইয়ের কাহিনি রোমান্টিক ও পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে। তারা আহমেদ প্রথমে ওয়েবসাইট হোয়াটপ্যাড ডট কমে ধারাবাহিক লেখেন উপন্যাসটি। সেখানে প্রায় ২৯ লাখ পাঠক লেখাটা পড়ে। অনেকে যখন এই উপন্যাসটি পছন্দ করে তখন এটিকে বই হিসেবে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বই প্রকাশের পরে অনেকে জানতে চেয়েছেন, সিক্যুয়েল কবে আসবে? লেখালেখির ব্যাপারে তারাকে বর শোয়েব সব সময় উৎসাহিত করেছেন। বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরি করেছেন তিনি এবং বাজারজাতকরণে সাহায্য করেছেন। আর বাবা হেলিম আহমেদ বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় বইয়ের খবর প্রকাশে সাহায্য করেছেন। তারা আহমেদ জানান, ‘লেখার ব্যাপারে আমার আব্বু-আম্মু ও ও স্বামীর কাছ থেকে খুব সাহায্য পেয়েছি। প্রথম বই প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে সেটা আমাজন ই–বুকের বেস্ট সেলিং নম্বর ওয়ানে গেছে।‘
লম্বা বিরতি দিয়ে তারা আহমেদ নতুন বই লিখেছেন-‘এক্সহেল’। নানা দেশের সংস্কৃতির ভিন্নতা দিয়ে এটির কাহিনি গড়ে উঠেছে। বইটি লিখতে লেখকের পাঁচ মাস সময় লেগেছে। চার মাস বই লিখেছেন ও এক মাস সম্পাদনা করেছেন। তবে প্রথমটির মতো মার্কেন্টিং করতে পারেননি বলে বইটি তুলনামূলক কম সাড়া ফেলেছে। তাই বলে তারা আহমেদ হতাশ নন। বলেন, ‘আমার স্বপ্ন বইয়ের কাহিনি নিয়ে হলিউডে সিনেমা হবে।’ ব্র্যাডফোর্ডের বাড়িতে তারা আহমেদের দিন কাটে ১৬ মাসের ছেলে মোহাম্মদ মাহাদ শোয়েবকে নিয়ে। তার দেখাশোনা ও ঘরের অন্যান্য কাজ করেন। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত লেখেন। স্বামী শোয়েব তাঁকে নানা সহযোগিতার মাধ্যমে লেখালেখির সুযোগ করে দেন। লেখার পাশাপাশি তারা আহমেদ প্রচুর বই পড়েন। নতুন লেখকদের জন্য এটি খুব প্রয়োজন বলে জানান তিনি। তাঁর পরের উপন্যাস হবে কল্পকাহিনী নির্ভর। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ১২ বছর বয়স এক কিশোরী। সে একজন জাদুকর।
নিউইয়র্ক সফরে এলে তারা আহমেদ প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাকে সাক্ষাৎকার দেন—
প্রশ্ন: প্রকাশের এত মাধ্যম থাকতে আপনি লেখালেখিকে বেছে নিলেন কেন?
তারা আহমেদ: ছোটবেলা থেকে আমি নিজেকে মৌখিকভাবে প্রকাশের ক্ষেত্রে খুব বেশি আগ্রহী ছিলাম না। আমি বেশ শান্ত স্বভাবের শিশু ছিলাম। লেখালেখি শুরুর পর আমি বুঝতে পারলাম, এটাই আমার জায়গা, যেখানে আমি কীভাবে অনুভব করি, আমি দুঃখিত, বিচলিত বা আনন্দিত কিনা, আমি সব সময় স্পষ্টভাবে লিখিত শব্দের মাধ্যমে আমার অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে পারি। আমি গল্প বলতে ভালোবাসি। তাই এমনকি তরুণ বয়স থেকে, আমি এমন একজন মানুষ হতে চেয়েছিলাম যে গল্পের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ করতে পারে।
প্রশ্ন: সমাজে নারীর প্রতি যে বৈষম্য একটা নারী হিসেবে আপনার লেখায় সেটা কতখানি এসেছে?
তারা আহমেদ: সমাজে নারীদের সব সময় বিচার করা হয়, কীভাবে তারা কথা বলে কিংবা কী ধরনের পোশাক ও সাজে তারা নিজেদের তুলে ধরে—এসব নিয়ে। আমরা সাধারণত এক নারীকে অন্য নারীদের সঙ্গে তুলনা করি। এটা যেমন পুরুষেরা করে তেমনি নারীরাও করে। আমি মনে করি, একজন নারীর তুলনা করা উচিত নিজের সঙ্গে নিজের। শিক্ষা ও মানসিকতার উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীদের এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
প্রশ্ন: বাধা বিপত্তি ও সমালোচনাকে কীভাবে নেন?
তারা আহমেদ: যেকোনো শিল্পী বা লেখকের জন্য সমালোচনা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। মানুষ আপনার লেখা নিয়ে নানা কথা বলছে, তাতে বিক্ষুব্ধ হওয়ার পরিবর্তে, লেখকের উচিত এটা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা। হ্যাঁ, যখন আপনার কাজের ব্যাপারে লাগাতার সমালোচনা হয়—এটা এক সময় সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে সেই সময়ও আপনাকে অবশ্যই আপনার কাজে বিশ্বাস রাখতে হবে এবং কখনই হাল ছাড়া যাবে না। ব্যর্থতা মানে আপনার সামনে দ্বিতীয় সুযোগ আছে, কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়া মানে সব সম্ভাবনাকে শেষ করে দেওয়া।
প্রশ্ন: লেখালেখির ক্ষেত্রে কাউকে অনুসরণ করেন কিনা?
তারা আহমেদ: ব্যক্তিগতভাবে আমি কাউকে অনুসরণ করি না, অন্তত লেখালেখির ক্ষেত্রে। যা হোক, আমি দৈনন্দিন জীবনে জুড়ে ছড়িয়ে থাকা গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হই। আমি বিশ্বাস করি, একজন লেখককে প্রতিদিন বাস্তবতাকে অনুসরণ করা উচিত ।
প্রশ্ন: স্মরণীয় স্মৃতি থাকলে বলুন…
তারা আহমেদ: প্রতিদিন স্মৃতি তৈরি হয় এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে খুব সাধারণ ঘটনাকেই স্মরণীয় মনে হয়। আমার স্মরণীয় কিছু স্মৃতি আছে ছোটবেলার। যখন বাবা-মা আমাদের বাংলাদেশ সফরে নিয়ে যেত, আমার শিকড় ফিরে আসার সুযোগ করে দিত, সেই ঘটনা আমি ভুলতে পারি না। পুরো প্লেন ভ্রমণে আমি খুব উত্তেজিত থাকতাম কখন আমার খালা, চাচা, মামা, ফুফু এবং তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা করব। এই আনন্দ-স্মৃতি যেন আমার অস্তিত্বেরই একটা অংশ।
প্রশ্ন: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানান…
তারা আহমেদ: আমি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে পছন্দ করি না। এটা কখনই নিশ্চিত হওয়া যায় না। আমি আমার পারিবারিক জীবন সুখে কাটাতে ভালোবাসি বিশেষ করে আমার বাবা-মা, স্বামী-পুত্র এবং আমার ভাইবোনদের জন্য। কারণ তাঁরা আমার জীবনে প্রধান ব্যক্তি। তবে কিছু লক্ষ্য তো থাকেই। যেমন বর্তমান উপন্যাসটি শেষ করা। আর একদিন প্রতিষ্ঠিত লেখক হতে পারা।
প্রশ্ন: আমাজন থেকে আপনার বই প্রকাশের অনুভূতি কি?
তারা আহমেদ: আমাজনে আমার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ‘দি ম্যারেজ কন্ট্রাক্ট’ বই দিয়ে, প্রথমবারই আমি বিশাল সম্মান পেয়েছি। আমি সত্যি অবাক হয়েছি, আমার বই কেনা হচ্ছে এবং পড়া হচ্ছে । আমার পরিশ্রম সার্থক করেছে।