আয়েশ আর অর্জন এক পথে চলে না

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এই আবির, এদিকে আয়।

হুট করে নিজের নাম শুনতে পেয়ে পেছনে তাকায় আবির। দেখে মাসুম ভাই ডাকছে। অন্য কেউ ডাকলে ইগনোর করা যেত। কিন্তু মাসুম ভাই ডাকলে আর ইগনোর করার উপায় থাকে না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও পেছনে ফিরে এল সে। তখনই মাসুম ভাই বলে উঠল, কিরে, এই হাতি সাইজ একটা বডি নিয়ে বসে আছি তাও তোর চোখে পড়লাম না?
—না ভাই, মনটা খুব খারাপ।
—কেন, কেউ ছ্যাঁকা দিছে?
—হ ভাই ছ্যাঁকা তো দিছেই। তবে সেটা কোনো মেয়ে মানুষে না। বরং ছ্যাঁকা দিছে রেজাল্টে। আমি স্টুডেন্ট হিসেবে খারাপ না। তারপরেও গত দুই সেমিস্টার ধরে রেজাল্ট আমাকে আনফলো করে দিসে।
—শোন, তুই ভাবছস তোর ট্যালেন্ট আছে। তবে ট্যালেন্ট দিয়ে সব হয়ে গেলে যে ফার্স্ট হয় তাকে ক্লাসে যাওয়া লাগত না। এক সপ্তাহ হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করে ডাক্তার হওয়া গেলে, পাঁচ-ছয় বছর ধরে মোটা মোটা বই কেউ পড়ত না। তিন-চারবার ব্যর্থ হয়ে ছেড়ে দিলে একটা বাংলাদেশের জন্ম হতো না। দুনিয়ার কেউই শর্টকাটে সফল হতে পারে নাই। তুইও পারবি না।
আসলে দুনিয়াতে ট্যালেন্ট বলতে কিছু নেই। পরিশ্রমী পোলাপান দিনের পর দিন সাধনা করে যে দক্ষতা, যে জ্ঞান অর্জন করে, আইলসা পোলাপান সেটাকেই ট্যালেন্ট বলে।
এই দেখ আমাদের ক্লাসের সুজন। সে দুই বছর ধরে রেজাল্টে লাড্ডু মারছে। গত বছর ডিসিশন নিল, যে করেই হোক, ওভার অল সিজিপিএ ৩.০–এর ওপরে তুলতেই হবে। তাই আগের লাইফ স্টাইল ছেড়ে দিয়ে ধুমাইয়া পড়ালেখা শুরু করছে। শুধুমাত্র রেগুলার ক্লাস, ঠিক সময়ে অ্যাসাইনমেন্ট, ক্লাস টেস্ট আর পরীক্ষার আগে সিরিয়াসলি পড়ে সেই লাড্ডু মার্কা সুজনই গত সেমিস্টারে পাইছে ৩.৫২। আর এই সেমিস্টারে পাইছে ৩.৬৪। ব্যস, কঠোর পরিশ্রম দিয়ে ট্যালেন্টের তকমা কিনে ফেলছে সে।
অন্যদিকে আমাদের কলেজের মেরিটোরিয়াস স্টুডেন্ট ভার্সিটিতে গিয়ে চার সাবজেক্টে রেজাল্ট খারাপ করে ট্যালেন্টের মেডেল হারিয়ে ফেলছে। সো, ট্যালেন্ট কিচ্ছু না। ট্যালেন্ট বলতে কিচ্ছু নাই। অনলি পরিশ্রম ইজ রিয়াল।
আজকের পর থেকে মেধা আছে, ট্যালেন্ট আছে, ব্যাকআপ আছে মনে করে ঘুমিয়ে থাকবি না। এগুলা সোজা, আগে কত করছি বলে ঢিলামি করতে যাবি না। পিছলামির কথা মাথায়ও আনবি না। তাহলে দেখবি অল্প কয়দিনেই তোর চাইতে কম ট্যালেন্টের পরিশ্রমী পোলাপানরা তোকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছে।
মনে রাখবি, আয়েশ আর অর্জন এক পথে চলে না। অলসতা সফলতার বন্ধু হতে পারে না। একটু বেশি আয়েশ করার নাম ভাঙিয়ে আলসেমি করতে যাবি না। ট্যালেন্টের দোহাই দিয়ে ফাঁকিবাজি করলে, অর্জন আসবে না। বরং অর্জন তোকে বর্জন করবে।
তাই শ্রম, সাধনা দিয়ে নিত্য নতুন ট্যালেন্টের তকমা জোগাড় করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বি। তাহলেই ভালো রেজাল্ট তোকে ফলো করবে।
Hard work beats talent when talent doesn't work hard. —Tim Notke

প্রকাশিতব্য রিচার্জ ইয়োর ডাউন ব্যাটারি গ্রন্থের প্রচ্ছদ
প্রকাশিতব্য রিচার্জ ইয়োর ডাউন ব্যাটারি গ্রন্থের প্রচ্ছদ

দুই. শান্টিং না দিলে পানি ওপরে ওঠে না

—কিন্তু মাসুম ভাই, যে সাবজেক্টটাতে বেশি খারাপ করছি সেটাতো অনেক কঠিন ছিল।
—শোন, যে সাবজেক্টটা কঠিন বলে তুই রেজাল্ট খারাপ করছস; সেই একই সাবজেক্টে তোর ক্লাসের অর্ধেকের বেশি পোলাপান ৫০–এর ওপরে মার্কস পেয়েছে। এই দেখ, গতকালকে বৃষ্টির কারণে, ঠান্ডার ভয়ে তুই ঘর থেকে বের হসনি কিন্তু সেই একই বৃষ্টিতে ভিজে, একই ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে, রিকশাওয়ালারা ঠিকই সংসার চালানোর টাকা কামিয়ে ঘরে ফিরেছে।
এই শহরে ঘুষ, অনিয়ম আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেকেই বিজনেসে নামার স্বপ্নটা মাটি চাপা দিয়ে রাখে। অথচ এই একই শহরে তাদের পাশের ফ্ল্যাটের আরেকজন, ঠিকই ব্যবসায় নেমে এগিয়ে যাচ্ছে।
সো, সমস্যাটা সাবজেক্ট কঠিন হওয়া, শীতের ঠান্ডা বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে না। বরং সমস্যাটা তোর মধ্যে।
শোন, যে মোবাইলে গেমস খেলার নেশা কমাতে চায়, সে সহজে গেমস খেলার নেশা ছাড়তে পারে না। যে পরের সেমিস্টারে দুনিয়া উল্টায় ফেলতে চায়, সে এই সেমিস্টারেও লাড্ডু মারবে, পরের সেমিস্টারেও লাড্ডু মারবে।
তাই গেমস খেলার নেশা ছাড়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে, আজকে দুপুরে লাঞ্চ শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল খুলে গেমস খেলতে শুরু না করে, জোর করে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবি। খেলতে চাইছস, তো খেলবিই। তবে সারা দিন যেহেতু বাকি আছে। তাই পাঁচ মিনিট পরে শুরু করলেও তোর দুনিয়া উল্টে যাবে না। তবে এই যে পাঁচ মিনিট ইচ্ছা করে পেছানোর চেষ্টা করতেছস। এইটা হচ্ছে তোর নেশাকে কন্ট্রোল করার ছোট্ট একটা স্টেপ। এই ছোট্ট স্টেপটা আজকেও ট্রাই করবি। আগামীকালকেও একই সিস্টেমে, জাস্ট পাঁচ মিনিট নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করবি। জাস্ট পাঁচ মিনিট।
একইভাবে পরের সেমিস্টার পড়ে তাল গাছে ওঠায় ফেলার চিন্তা না করে, পরের সপ্তাহে সারা দিন বই নিয়ে পড়ে থাকার চিন্তা না করে, এমনকি আগামীকাল ঘুম থেকে উঠেই শুরু করে দেওয়ার চিন্তা না করে, আজকের দিনটায় এক ঘণ্টা সময় বের করার চেষ্টা কর। ইয়েস, আজকে দিনের মধ্যেই তোকে এক ঘণ্টা সময় বের করতে হবে। নট আগামীকাল, নট আগামী সপ্তাহ।
কারণ, যে পড়ালেখার জন্য আজকে এক ঘণ্টা সময় বের করতে পারবে না। সে পরের সপ্তাহে বা পরের সেমিস্টারেও এক ঘণ্টা বা চার ঘণ্টাও বের করতে পারবে না। আর পুরা সেমিস্টার ফাটিয়ে ফেলাতো দূরেরই কথা। সো, যা করার আজকেই করতে হবে। আজকেই আজকের ক্লাসে যেটা পড়াইছে সেটার জন্য এক ঘণ্টা করে করে সময় বের করে, আজকেই বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবি; কেউ যুদ্ধ জয় করে না, একজন একজন করে শত্রুপক্ষের সৈন্যকে পরাজিত করে। কেউ সাগর পাড়ি দেয় না, বইঠা মেরে মেরে, ইঞ্চি ইঞ্চি করে সামনে এগোতে থাকে। কেউ বিশ্বসেরা খেলোয়াড় হয় না, একটার পর একটা ম্যাচে, দুই-একটা করে গোল করতে থাকে।
আসলে সফলতা কোনো লটারি না। সফলতা আসমান থেকে ঝরে পড়া উল্কাপিণ্ড না। সফলতা হচ্ছে কনসিসটেন্সি (ধারাবাহিকতা)। এই কনসিসটেন্সি, রেজাল্ট বা আউটকামের কনসিসটেন্সি না। এইটা চেষ্টার কনসিসটেন্সি। লেগে থাকার কনসিসটেন্সি।
শোন, পানি যে পাত্রে রাখে সেই পাত্রের আকার ধারণ করে। চান্স পাইলেই গড়িয়ে নিচে নেমে যায়। আরও বেশি চান্স পাইলে, নদীর স্রোতের সঙ্গে ভেসে ভেসে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। মানুষের চেষ্টাও পানির মতো। রিলাক্স করার পাত্র খুঁজে পাইলে, সেই পাত্রকে আলসেমির বাক্স বানিয়ে সারা দিন কাটিয়ে দেয়। ছুতার রাস্তা খুঁজে পাইলে, সেই রাস্তা দিয়ে গড়গড় করে গড়িয়ে পড়ে। আড্ডাবাজি, মাস্তির স্রোত পাইলে সেই স্রোতের টানে ফাঁকিবাজির বঙ্গোপসাগরে হারিয়ে যায়। তাই জীবনকে পানি পানি করবি না।
রিলাক্স হবি না। রিলাকট্যান্ট হবি না। লম্বা টার্গেট সেট করবি না। বরং নেক্সট স্টেপের দিকে তাকাবি। সেই ছোট স্টেপগুলো নিয়মিত দিতে থাকবি। দেখবি, ছোট ছোট স্টেপ, পানির পাম্পের মতো তোর চেষ্টার পানিকে একটু একটু করে ওপরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো কারণে কনফিডেন্স লুজ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বল্টু টাইট দিয়ে নিবি। ফাঁকিবাজি মনে আসলে সঙ্গে সঙ্গে শান্টিং দিয়ে নিবি। কারণ পানিকে পাম্প দিয়ে শান্টিং না দিলে পানি ওপরে উঠে না। ঘোড়ার ওপরে উঠে, ঘোড়াকে শান্টিং না দিলে ঘোড়া সামনে দৌড়ায় না।
এই একটু একটু করে ওপরে উঠতে থাকলেই, একসময় পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে যাবি। তখন পাহাড়ের চূড়া বসে বসে তোর পায়ের নিচে শিস বাজাবে।
It always seems impossible until it’s done. —Nelson Mandela.
(ক্রমশ)

ঝংকার মাহবুব: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।