আয়নার এপিঠ-ওপিঠ

সামার মোটামুটি চলে এসেছে। নদীটির নীল পানিগুলো ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করছে। অদূরে কোনো বোটে হয়তো কেউ মাছ ধরছে। স্বচ্ছ পানিতে সূর্যরশ্মির আভায় নদীর কিনারার নুড়িপাথরগুলো চকচক করছে। শায়লার চোখ দুটো সেখানে আটকে যায়। নদী পাড়ের এই পার্কটি শায়লার ভীষণ ভালো লাগে। ঝিরঝির হাওয়া সব সময়ই বিরাজমান থাকে।

অনলাইনে বহু খোঁজাখুঁজি করে নদী পাড়ের এই বাড়িটি শায়লা পছন্দ করেছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে ও রিফাত কর্মস্থলে চলে গেলে সংসারের কাজগুলো গুছিয়ে শায়লা এই পার্কটাতে চলে আসে। সংসারের ব্যস্ততা এখন অনেক কমে গেছে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। মেয়েটা ইয়ার সেভেনে পড়ে। ছেলেটা ইয়ার সিক্সে পড়ে।
অবসর সময় বই পড়ে বা পার্কে কাটায় শায়লা। মাঝে মাঝে কিছু মায়েরা অথবা দাদি–নানিরা বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে আসেন। শায়লা তাদের সঙ্গে গল্প করে। বাঙালি হলে বাসাতেই নিয়ে আসে। সেই কবে শায়লা তার বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে আসত। এখন ওরা আইপ্যাড আর ল্যাপটপ নিয়েই বেশি ব্যস্ত। শায়লাও এখন ব্যস্ত থাকতে চায়। শায়লা নিজ বাড়িতেই একটা ডে কেয়ার সেন্টার খোলার কথা ভাবছে। বাচ্চাদের নিয়ে পড়ে থাকা যাবে। অনেকটা ফুল বাগানের মতো।
এর আগে চাইল্ড কেয়ারের ওপর একটা কোর্স করতে হবে। শায়লা এরই মধ্যে TAFE ভর্তি হয়েছে। কবে থেকে ক্লাস শুরু হবে প্রশ্ন করলে তারা বলেছে মেইল করে জানাবে। পার্কে বসেই শায়লা আরেকবার মেইল চেক করে। নাহ কোনো উত্তর আসেনি। আবার সেই জলের মাঝে দুটি চোখ থেমে যায় শায়লার।
সেই সব দিনের কথা মনে পড়ে যায় শায়লার। গ্র্যাজুয়েশন তখন মাত্র শেষ হয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত কোনো পছন্দ না থাকায় পারিবারিকভাবেই রিফাতের সঙ্গে বিয়ে হয় শায়লার। অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী রিফাত। বিয়ের পরই কয়েক মাসের মধ্যেই শায়লার ভিসা হয়ে যায়। শায়লাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আসে রিফাত। নতুন পরিবেশে সবকিছুই তখন নতুন ছিল শায়লার কাছে। রিফাতই শায়লাকে সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিল। রান্না থেকে শুরু করে আদ্যোপান্ত সবকিছুই শিখিয়েছে শায়লাকে। এই জন্যই শায়লা রিফাতকে এত পছন্দ করে।
শায়লার ছোট্ট একটি আয়না ছিল। দেশের থেকেই আয়নাটি নিয়ে এসেছিল শায়লা। আয়নার সামনে বসে শায়লা দীর্ঘ সময় নিয়ে সাজত। আয়নাটির দুই পিঠেই দেখা যায়। এক পিঠে স্বাভাবিক আর অন্য পিঠে অনেক প্রসারিত দেখা যায়। শায়লা তখন আয়না দেখত আর ভাবত পৃথিবীতে মানুষেরও কত রকম রূপ। স্বাভাবিক রূপ সবাই প্রকাশ করে। ভেতরের প্রসারিত রূপ কেউই প্রকাশ করে না। ছোট্ট আয়নাটি এখনো আছে। শায়লা প্রতিদিনই আয়নাটি দেখে, মুছে পরিষ্কার করে রাখে। দেশের থেকে আনা প্রতিটি জিনিসই শায়লা যত্ন করে রাখে। এই সব জিনিসের মাঝে দেশের ঘ্রাণ পায় শায়লা। মাঝে মাঝে দেশের থেকেও পোস্টে জিনিসপত্র আনায় শায়লা। রিফাতই সেই ব্যবস্থা করে দেয়। কখনো নিষেধ করে না।
অন্যান্য বাঙালি ভাবিদের সঙ্গে এই নিয়ে গল্পও করে শায়লা। সব ভাবিদেরই স্বামীকে নিয়ে অভিযোগ। চরিত্র নিয়েও অভিযোগ আছে অনেকের। রিফাতকে নিয়ে শায়লার কোনো অভিযোগই নেই। চরিত্র নিয়ে তো প্রশ্নই আসে না। রিফাত কোনো নারীর সঙ্গেই কথা বলে না। ওর নাকি লজ্জা লাগে। বিদেশি মেয়েদের যথারীতি ভয়ই পায়। সে দিক দিয়ে শায়লা অনেক সুখী। সেটা ভেবে শায়লা কিছুটা আশ্বস্ত হয়। কিন্তু সেটা শায়লা অন্যদের কাছে প্রকাশ করে না। কারণ অন্যদের দুঃখের কথা শুনতে শায়লার ভালো লাগে। অন্যের সুখের কথা শুনলে কেউই কখনো নিজের দুঃখের কথা বলে না।
যখনই ভাবিদের সঙ্গে সুখ দুঃখের গল্প করে অনেকেই বলে ভাবি বাচ্চাদের মুখের দিকে চেয়ে পড়ে আছি। শায়লা অবাক হয়ে বলে, আপনাদের ফেসবুকের ছবি দেখেতো বোঝার উপায় নেই। এমন কথা শুনলে কেউ কেউ বিরক্ত হয় এই ভেবে যে বাস্তবতা আর ফেসবুক এক নয়। আবার কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, মানুষকে দেখাই। দেখানো ভালোবাসা। শায়লা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। সেই আয়নাটির কথা মনে পড়ে যায় শায়লার যার দুই দিকে ভিন্ন রূপ।
শায়লা এবার মানুষের কথা বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাবে। রিফাত আর এই সব স্বামীদের মাঝে কত পার্থক্য। রিফাতের ভালোবাসা তার জন্য মোটেই দেখানো নয়। বরং রিফাত অনেক বেশিই সংসারী। পরপর দুটো বাচ্চা। বিদেশে একা লালন–পালন করতে শায়লা হিমশিম খেয়ে যেত যদি না রিফাতের সহযোগিতা থাকত। যতটুকু সময় পায় শায়লাকে সাহায্য করে। সেই বিয়ের পর থেকেই শায়লা দেখে আসছে। এই মাঝ বয়সে সেসব দিনের কথা ভেবে শায়লার চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ে। চোখ মুছতে মুছতেই শায়লা পার্ক থেকে বাসায় ফেরে।
দু–তিন দিন পরেই শায়লার ক্লাস শুরু হয়ে যায়। শায়লার বয়সী এক অজি সহপাঠী জেনের সঙ্গে শায়লার বেশ সখ্যতা জমে ওঠে। জেন একদিন জিজ্ঞেস করে, তুমিতো ইন্ডিয়ান তাই না?
শায়লা মুচকি হেসে বলে, আমি বাংলাদেশি।
জেন এবার আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে বলে, আমি বাংলাদেশি কালচার, খাবার, পোশাক সবকিছু সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। বাংলাদেশি পায়েস অনেক পছন্দ করি।
শায়লা বলল, ঠিক আছে আমি তোমার জন্য একদিন রেঁধে আনব। তারপর শায়লা একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে, কিন্তু তুমি এত কিছু কীভাবে জান?
জেন বলল, আমার বাংলাদেশি এক বয় ফ্রেন্ড ছিল। আমরা তিন বছর একসঙ্গে ছিলাম। এরপর আর ভালো লাগেনি। আমি অন্য বয় ফ্রেন্ড খুঁজে নিয়েছি। ও বলেছিল দেশে গিয়ে বিয়ে করবে। করেছে কিনা জানি না। ওর নাম ছিল রিফাত চৌধুরী।
নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শায়লা চমকে ওঠে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শায়লা। কোনো রকমে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি তার কোনো ছবি দেখাতে পার?
জেন মোবাইল বের করে ঘাটতে থাকে। একটি ছবি বের করে শায়লাকে দেখায়। জিজ্ঞেস করে, তুমি কি তাকে চেন?
শায়লার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। শুধু মনে মনে বলে, খুব ভালো করে চিনি। আজ আরও ভালো করে চিনলাম।