আস্থা রাখুন চিকিৎসকে
মধ্যরাত। ঘুমন্ত শহর কুমিল্লা। নিয়ন বাতির আলোয় জ্যোৎস্না ম্লান। দিনের কর্ম ব্যস্ততার শেষে ক্লান্ত হয়ে গভীর ঘুমে মানুষেরা। এমন নীরব-নিস্তব্ধ রাতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল আমার বোনের। শ্বাসকষ্টের তীব্রতায় মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিল। বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ লড়াই করছিল। অ্যাজমা ছিল আগে থেকেই। কিন্তু এমন পরিস্থিতি আগে হয়নি। পাশে থাকা বোন জামাই দিশেহারা আকস্মিক এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে। বাড়ির সদস্যদের ডাকা হলো, অ্যাম্বুলেন্স দরকার। যেতে হবে হাসপাতালে। অ্যাম্বুলেন্স এল, সুনসান মধ্যরাতের যানজটহীন পথে নির্বিঘ্নে অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছে গেল কুমিল্লা মুন হাসপাতালে। দায়িত্বরত ডাক্তার এগিয়ে এলেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বললেন, আইসিইউতে নিয়ে অক্সিজেন দিতে হবে। ততক্ষণে আপা মৃত্যুর মুখোমুখি। চেতনা নেই নেই, বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে। বেঁচে থাকার প্রাণপণ লড়াই করছেন।
মোবাইল বেজে উঠল। আপার এমন সংবাদে আমার শরীর কাঁপতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল, যেন আমিই মরে যাচ্ছি। বিদেশে থাকার এই এক যন্ত্রণা, কারও বিপদে কিছুই করার থাকে না। শুধু দোয়া করা আর ডাক্তারদের ওপর ভরসা করা ছাড়া। আমি ওই মুহূর্তে তাই করছিলাম। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে মন এমনিতেই দুর্বল হয়ে যায়। সে সময় আমরা সৃষ্টিকর্তার পর ভরসা করতে থাকি ডাক্তারের ওপর। তাঁরাই ওই সময় হয়ে ওঠেন আমাদের ভরসার আশ্রয়স্থল। একজন চিকিৎসক শুধু রোগীর শারীরিক চিকিৎসাই করেন না, সহমর্মিতা, মানবিকতা দিয়ে রোগীর পাশে থাকেন।
প্রশ্ন হচ্ছে সব চিকিৎসক কি তা করেন? অন্তত গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সব চিকিৎসক তাঁদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেন না।
সময় যত গড়াচ্ছিল আপা তত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছিল। আপার দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে আর বড় ছেলে ঢাকায় থাকে। ছোট ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে। ওই সময় আমি আপার ছোট ছেলে রিয়াদের বাসায় ছিলাম পেনসিলভানিয়ায়। আপার এমন দুঃসংবাদে বড় ছেলে রুবেল ঢাকা থেকে রওনা দেয়। তখন ভোর রাতের আবছা অন্ধকারে আলোর কিছুটা ঝলকানি। কুমিল্লা পৌঁছাতে সকাল হয়ে যায় রুবেলের। কুমিল্লা মুন হাসপাতালে পৌঁছে দেখে, তার মা নিথর পড়ে আছে আইসিইউতে। আপার অসার শরীরে বড় বড় নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। মুখে অক্সিজেনের নল। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করা হলো, এত সময় অক্সিজেন দেওয়া ছাড়া আর কী করা হয়েছে। ডাক্তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। কিছু টেস্টের কথা বললেন, পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়েছে তবে রেজাল্ট এখনো আসেনি। এমন অবস্থায় মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন। তবুও রুবেল যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতি দেখল এবং সিদ্ধান্ত নিল, না এখানে আর রাখা ঠিক হবে না। ঢাকা নিতে হবে। সে তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল ডাক্তারদের। তখন একজন ডাক্তার এগিয়ে এলেন, আশ্বাস দিলেন অবশ্যই নিতে পারেন।
আপাকে আবার দেখা হলো। আমি বলব, মূলত তখন চিকিৎসা শুরু হলো। কিছু ইনজেকশন দেওয়া হলো, ওষুধ দেওয়া হলো। এর কিছুক্ষণ পর আপা চোখ খুললেন। তবে অক্সিজেন চলল অবিরত। হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে তা ঢাকা থেকে আনা হলো। কিন্তু সেই অ্যাম্বুলেন্সেও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ছিল না। ততক্ষণে মুন হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ফিরে এসেছে। পরে ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একজন চিকিৎসকসহ অ্যাম্বুলেন্সটি দিল। এ জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
আপাকে ঢাকায় নেওয়া হলো। স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হলো, অবস্থা জটিল। করোনা টেস্ট এল নেগেটিভ। টিকা নেওয়া ছিল আপার। হাসপাতালে ভর্তির পরবর্তী ১২ ঘণ্টা আমাদের সঙ্গে আপার আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। ফোন করে জানতে চেয়েছি, বলেছে পরের দিন জানতে।
আমার মনে হয়, কিছু সিস্টেম পরিবর্তন দরকার। শুধু রোগীর সঙ্গে না, রোগীর পরিবারের সঙ্গেও চিকিৎসকদের যোগাযোগ থাকা উচিত। তাঁদের জানানো উচিত, ওই মুহূর্তে রোগী কী অবস্থায়, কেমন আছে। অর্থের ব্যাপার তো আছেই। এত ব্যয়বহুল চার্জ না করে নাগালের মধ্যে রাখা উচিত। বিদেশে ইনস্যুরেন্স আছে। কিন্তু দেশে তো তা নেই। যাদের সাধ্য আছে তারা না হয় চিকিৎসা করল অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু প্রতিদিন লাখো টাকা ব্যয় করে কতজনের সাধ্য আছে রোগীর চিকিৎসা করানোর? আর অ্যাম্বুলেন্স যেন ব্যবসার হাতিয়ার না হয়। মানুষের জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দর-কষাকষি করে যেন অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া না হয়। আমি বলছি না অ্যাম্বুলেন্স ফ্রি দিতে হবে। চার্জ অবশ্যই করবে তবে তা যেন মানুষের নাগালের মধ্যে হয়। তা না হলে সীমিত আয়ের মানুষেরা কোথায় যাবে?
চিকিৎসা পেশা হলো মহৎ পেশা। এখানে মানব সেবার সুযোগ থাকে। একজন চিকিৎসক চাইলে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন রোগীর যথাযথ চিকিৎসা করে।
দায়িত্ব কী, সেবা কী তা দেখেছিলাম নিউজার্সির চিকিৎসক দম্পতি কাশিফ চৌধুরী ও নাইলা শেরিনের ক্ষেত্রে। তখন করোনার ভয়াবহ অবস্থা নিউইয়র্কে। বিয়ে করে মাত্র ১০ ঘণ্টার মতো এক সঙ্গে ছিল এই দম্পতি। এরপর শেরিন চলে যায় নিউইয়র্কের করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে, আর কাশিফ চৌধুরী আইওয়া অঙ্গরাজ্যের সিডার র্যাপিডস শহরের মারসি মেডিকেল হাসপাতালে। দুজন দুই স্টেটে।
শেরিন বলেছেন, আমাদের আনন্দের চেয়ে এ মুহূর্তে মানুষের পাশে থাকা উচিত। একজন ডাক্তার হিসেবে তো বটেই, একজন মানুষ হিসেবেও তাদের সেবা করা উচিত।
কাশিফ চৌধুরী বলেন, আমরা দুজনে মিলেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চিকিৎসা একটি মহৎ পেশা। নিজেকে যদি মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে না পারলাম তাহলে কীসের চিকিৎসক হলাম। এ মুহূর্তে দুজনের এক সঙ্গে থাকার চেয়ে করোনা রোগীদের পাশে থাকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আমি দেশেও এমন অনেক চিকিৎসক দেখেছি। এই করোনার সময় তাঁরা যেভাবে সেবা দিয়েছেন রোগীদের, তা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে। অনেকে সেবা দিতে গিয়ে নিজে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। অনেক সময় ডাক্তাররা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জিম্মি থাকেন তাঁদেরও করার কিছু না। তাঁরা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারেন না। এ জন্য আমি সিস্টেমকেই দায়ী করব। কোনো জবাবদিহি নেই বলেই এমন হচ্ছে। আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছি বলে এবং কিছু ডাক্তার আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন বলে হয়তো আমার বোন বেঁচে গেছে। কিন্তু যাদের পরিবারে সে রকম কেউ নেই কিংবা ব্যয়বহুল অর্থের সামর্থ্য নেই, তাঁদের কী হবে সেটাই ভাবছিলাম।
এই লেখা মূলত সেই সব মানুষের কথা ভেবেই। মৃত্যুর স্বাদ আমাদের সবাইকে নিতে হবে, আজ আর কাল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ডাক্তারদের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ, রোগীদের নিয়ে অবহেলা করবেন না। আপনাদের ওপর মানুষ অনেক ভরসা করে। একজন মুমূর্ষু রোগী যখন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যায়, তখন আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধায় মন ভরে ওঠে।
সম্প্রতি দেখলাম রাজধানীর মগবাজারে বিস্ফোরণের প্রায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। অনেকেই আহত। হাসপাতালে ছোটাছুটি মানুষের, ডাক্তাররা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন রোগীকে বাঁচাতে। যে পেশায় থাকি না কেন, আসুন এভাবে আমরা মানুষের পাশে থাকি। প্রত্যেকের জায়গা থেকে যদি কর্তব্য পালন করি, সমাজ থেকে অনেক সমস্যা এমনিতেই চলে যাবে। ভালো থাকুক দেশের মানুষ এই কামনা করি।