আসুন, নিজেকেই জয় করি

লুইস গ্লুক।
ছবি: এএফপি

সাহিত্যে নোবেল পদক জয় নিয়ে আলোচনা জমে উঠেছে। কবির নামের উচ্চারণ কেমন হবে, এ নিয়ে মিসরীয় বন্ধু মোবারকের সঙ্গে তর্কে নেমে গেছেন জর্জ।

শাহানা ফিসফিস করে বলছিলেন, এরাই ইব্বি আর সু বলে আমাদের নাম উচ্চারণ করে থাকে। এদের কাছ থেকে নোবেলজয়ী কবির নামের উচ্চারণ আমাদের না শুনলেও চলবে!

মোবারকের বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে আড্ডা বসেছে। শীত আসি আসি করছে। ভরা সন্ধ্যায় চাঁদের আলো। আঙিনার সীমানাজুড়ে সারি সারি গাছের ওপর ভর জোনাকির অবারিত হাতছানি। ‘আমেরিকান হোলি’ নামে একধরনের স্থানীয় গাছে লাল আর হলুদের রং। প্রকৃতির মনকাড়া আবহাওয়া!

শারীরিক অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছেন মোবারকের স্ত্রী ফাতিমা। মিসরীয় ঐতিহ্যের মেরুন রঙের ‘কাফতান’ নামের ড্রেস পরেছেন।

আমার আগে শাহানাই ফাতিমার ড্রেসের প্রশংসা করে ফেললেন। কাফতান নেমের ড্রেসটি পরার ঐতিহ্যের ব্যাখ্যা ফাতিমা আমাকেই দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছিল। এর মধ্যেই জানালেন, নাতালিয়া ইউক্রেনে খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন বলে জানিয়েছেন। সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন।

–কিসের এত ব্যস্ততা! দেখো গিয়ে, সাবেক কোন বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরছে!

জর্জকে খ্যাপানোর চেষ্টা মোবারকের। স্ত্রীকে নিয়ে বন্ধুর এমন কথা এড়িয়েই গেলেন তিনি।

খাঁটি মিসরীয় সল্টেড ক্রাঞ্চি বাদাম পরিবেশন করছিলেন ফাতিমা। সঙ্গে নোবেলজয়ী কবি লুইস গ্লুকের কবিতার লাইন ছুড়ে দিলেন—

No wonder you are the way you are,

afraid of blood, your women

like one brick wall after another.

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম প্রস্তাবে ছিল, এর চেয়ে বড় কৌতুক আর কী হতে পারে! আজকাল বাটপার, স্বৈরাচার—এদের নামও প্রস্তাব হয়! সারা বিশ্বকে এক পাগলের কারখানা মনে করেছে নাকি এই ব্যাটা ট্রাম্প

মোবারক হঠাৎই বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। জানালেন, এসব কবিতার প্যানপ্যানানি তার ভালো লাগছে না।

–এবার ইব্বি নিশ্চয়ই টেগোরের দুই লাইন আমাদের শোনাবে।

–উনুনে কেরোসিন ঢালার চেষ্টা করছেন জর্জ। প্রায় মুখে চলে এসেছিল–

‘আমি আশায় আশায় থাকি।

আমার তৃষিত আকুল আঁখি॥

ঘুমে-জাগরণে-মেশা প্রাণে স্বপনের নেশা–

দূর দিগন্তে চেয়ে কাহারে ডাকি॥’

তবে ফাঁদ এড়িয়ে গেলাম। শাহানাই উদ্ধার করলেন।

–নোবেল পদক নিয়ে শোনা একটা কৌতুক আমি বলতে পারি।

–ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম প্রস্তাবে ছিল, এর চেয়ে বড় কৌতুক আর কী হতে পারে! আজকাল বাটপার, স্বৈরাচার—এদের নামও প্রস্তাব হয়! সারা বিশ্বকে এক পাগলের কারখানা মনে করেছে নাকি এই ব্যাটা ট্রাম্প!

মোবারক তখনো উত্তেজিত।

হ্যাঁ, হেঁড়ে গলায় বায়বীয় কবিতা শোনার চেয়ে কৌতুকই ভালো। সুরেলা কণ্ঠে ঝংকার তোলা কৌতুক! মোবারক ফাতিমাকে নয়, শাহানাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছেন।

জর্জ একটা ইঙ্গিতপূর্ণ কাশি দিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার করলেন। মোবারক থামছেন না। জানালেন, কৌতুক শোনার আগে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্টদের বিতর্ক নিয়ে তাঁর মন্তব্যটি করে ফেলতে চান।

কমলা হ্যারিসের উক্তি—মি. ভাইস প্রেসিডেন্ট, আমি কথা বলছি, আমাকে শেষ করতে দিন—কথাটি তাঁর ভালো লেগেছে।

মাইক পেন্সের কপালে মাছি বসার বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ একাই হাসলেন মোবারক। বললেন, মাছিটি ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ওখানে বসে থাক। আরও বংশ বৃদ্ধি করুক!

জর্জ শুধু জানালেন, মাইক পেন্স একসময় রেডিও টক শো হোস্ট করতেন। টক শোটির নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন তিনি। মাইক পেন্সকে একজন ভদ্রলোক ও বিতর্কে টলানোর মতো লোক নয় বলে উল্লেখ করেন জর্জ।

মোবারক, এবারে অট্টহাসি হাসলেন। তার এবারের হাসিতেও কেউ যুক্ত হলেন না।

–তাহলে কৌতুকটাই শুনে ধন্য হই!

শাহানা বলতে শুরু করলেন—নোবেল পদক পেয়েছেন পদার্থ বিজ্ঞানী। ডাক পড়েছে প্রান্তিক এক নগরে বক্তৃতা দেওয়ার। নতুন এলাকায় এসে কার সার্ভিস ভাড়া করেছেন। একের পর এক সভায় বক্তৃতা করছেন। প্রতিটি সভায় নিয়ে যাচ্ছেন গাড়ি চালকটি। বেশ কয়েকটি সভা হয়ে গেছে এর মধ্যে।

গাড়ি চালক বিজ্ঞানীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন পরের সভায়। সাহস করে বললেন, স্যার একদিনে অনেক সভা করে ফেলেছেন আপনি। এবারে বিশ্রাম নিন। পরের সভায় আপনার বক্তৃতাটি আমিই দিয়ে দিচ্ছি। একদম মুখস্থ হয়ে গেছে আমার। কোন অসুবিধাই হবে না।

ক্লান্ত বিজ্ঞানী মনে করলেন, ভালোই হলো। একটা পর্যবেক্ষণের জন্যও এমন কিছু করা যায়! অনেক নোবেলজয়ী নানা সময় নানা পাগলামো করেছেন। তা ছাড়া এ শহরে তাঁর চেহারা তেমন কেউ চিনেও না।

উত্তম প্রস্তাব। আমি চালকের আসনে বসি। আমার কোট আর হ্যাটটা নিয়ে আপনি সোজা মঞ্চে চলে যাবেন। আমি ততক্ষণে চালকের আসনে বসে শুনতে থাকব।

ড্রাইভার চমৎকার করে তাঁর বক্তৃতা শেষ করলেন। প্রচণ্ড করতালি। এর মধ্যে অনেকই এসে সেলফি উঠিয়ে নিলেন। কেউ সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দিলেন। ভাব করলেন, যেন নোবেলজয়ী লোকটা তাদের খালাতো বা চাচাতো ভাই!

হঠাৎই বিপত্তি!

এক স্কুল শিক্ষার্থী অফ ট্র্যাকে প্রশ্ন করে বসে!

–স্যার, বস্তুর বাস্তবতার সঙ্গে পরিমাপের সম্পর্কটি যদি একটু ব্যাখ্যা করতেন! কোয়ান্টাম থিওরি এ নিয়ে নতুন কথা বলছে!

বক্তৃতা দেওয়া মানুষটি তখন মাথা ঝুঁকালেন। পোডিয়াম থেকে চশমাটি হাতে নিলেন। হলভর্তি লোকজন পিন পতন নিস্তব্ধতায় পদার্থ বিজ্ঞানের নতুন ব্যাখ্যাটি শোনার অপেক্ষায়।

–প্রশ্নটির উত্তর একদম সহজ। এতই সহজ যে, আমার গাড়ির ড্রাইভারই তা ভালো করে ব্যাখ্যা করতে পারবে।

ড্রাইভারের আসনে বসা আসল বিজ্ঞানী ততক্ষণে দ্রুত নেমে আসেন পরিস্থিতি সামাল দিতে!

–বিজ্ঞানীকে নিয়ে ড্রাইভ করা লোকটির নাম কি মোবারক ছিল?

–এমন বাটপার ড্রাইভারের নাম জর্জও হতে পারে!

হাসতে হাসতে দুই বন্ধুর পাল্টাপাল্টি মৃদু আক্রমণ!

নোবেল পদক নিয়ে কোন কৌতুক নয়। একটা সত্য ঘটনা যোগ করতে চাই!

–সত্য সব সময় আপেক্ষিক ইব্বি। বলে ফেলুন!

ফাতিমা সায় দিলেন! বলি, সত্যের আপেক্ষিকতা নিয়ে আরেকদিন আলাপ হবে। আড়চোখে মোবারককে দেখে নিই। বিভ্রান্ত দেখা যায়! ভাবছেন, তার ওপর কোন আক্রমণের গোপন ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না!

২০০৭ সাল। নোবেল পদক ঘোষণার দিন। সাধক পুরুষ শ্রী চিন্ময় নোবেল পাচ্ছেন বলে প্রচার হচ্ছিল বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। তাঁর নাম বহুবার সুপারিশ করেছেন বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রনেতারা। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া শ্রী চিন্ময় যেভাবেই হোক, একজন আন্তর্জাতিক মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।

সারা বিশ্বে তাঁর অনুসারী রয়েছে। নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় তাঁর জমজমাট আশ্রম। আশ্রমে আমেরিকান নারী-পুরুষ রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করেন, শ্রী চিন্ময়ের লেখা সংগীত বাংলায় গেয়ে ওঠেন, জাতিসংঘের শান্তির দূত হিসেবে শ্রী চিন্ময় কাজ করেন। দেশে দেশে রাষ্ট্র নেতাদের আপনজন হয়ে ওঠেন তিনি।

জাতিসংঘ সদর দপ্তরে শান্তির দূত হিসেবে তাঁর প্রায়ই ডাক পড়ে। প্রাচ্যের এক সাধু পুরুষ হিসেবে শ্রী চিন্ময় খ্যাতি লাভ করেন। সঙ্গীতে, চিত্রশিল্পে, অ্যাথলেটিকস, মেডিটেশন নিয়ে তিনি পশ্চিমা দেশের হতাশাগ্রস্ত মানুষের এক আলোর দিশারি হয়ে ওঠেন।

২০০৭ সালের নোবেল পদক ঘোষণার আগে আগে তাঁর আস্তানায় গিয়ে দেখা করে আসি। সাজসাজ রব। একজন কংগ্রেসম্যান কিছুক্ষণ আগে দেখা করে গেছেন। বিদেশি সাংবাদিকদেরও ভিড়। অনেকেই আগাম তথ্য নিয়ে রাখছে শ্রী চিন্ময়ের নোবেল পদক পাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে স্টোরি করবে বলে।

আমি নিজেও কাজটি করলাম। বেশ কয়েকজন সাদা চামড়ার সাংবাদিকদের এ নিয়ে বিরাট উচ্ছ্বাস প্রকাশ দেখে নিজেকে খুব লজ্জিত মনে করলাম। বিশ্বের লোকজন আমাদের শ্রী চিন্ময়কে যে সম্মানের চোখে দেখে, আমরা ঠিক তাঁকে জানিই না বলে নিজেকে ধিক্কার দিলাম।

শ্রী চিন্ময় ডেকে কাছে নিয়ে বসালেন। চমৎকার বাংলায় কথা বললেন সবার সামনে। নিজের জন্মস্থান চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কথা বললেন।

নোবেল পদক ঘোষণার পর ফোন করলে অন্যদের বাদ দিয়ে আমার ফোন কলটি ধরবেন জানালেন। তাঁর ব্যক্তি জীবনে অন্য কোন আকাঙ্ক্ষা ছিল কিনা, জানা নেই। বিশ্বশান্তির দূত হিসেবে তিনি যে নোবেল পদক পাবেন, এ নিয়ে তাঁর মধ্যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করত।

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শ্রী চিন্ময়ের এবারেই শেষ সুযোগ। এ সাধক পুরুষের অনুসারীরাও এমনটি মনে করছিলেন তীব্রভাবে।

নিউজের প্রথম দুই প্যারা ছাড়া বাকিটা লিখে রাখলাম। নোবেল পদক ঘোষণা করা করা হলো। টিভি পর্দার সামনে বসে আছি। হাতে ফোন। টান টান উত্তেজনা। আগের বছর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পদক পেয়েছেন। কোন বাঙালির নোবেল পদক পাওয়া নিয়ে আবার সংবাদ করব। কথাটা দেশের লোকজনকে প্রথমে আমিই আমার মতো করে জানাব।

স্বচ্ছ নীল আকাশে চাঁদকে আরও উজ্জ্বল দেখায়
ফাইল ছবি: রয়টার্স

নিউইয়র্কে থাকা আমাদের অনেকের ব্যক্তিগত পরিচিয় ছিল শ্রী চিন্ময়ের সঙ্গে। আলাদা উত্তেজনা কাজ করছিল। টেলিভিশনে নাম ঘোষিত হলো।

না, শ্রী চিন্ময়ের নাম নেই। সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর পেলেন নোবেল পদক।

কষ্ট লুকিয়ে রাখতে আমি বাথরুমে যাই। জায়গাটাকে নিরাপদ মনে করি। নিজেকে লুকিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা যাকে বলে!

এবারও তাই করলাম। ফোন বাজছে আর থামছে! ধরতে ইচ্ছে করছে না। ক্রমাগত ফোন কল। উত্তর দেওয়ার জন্য হাতে নিয়েই দুঃসংবাদ! শ্রী চিন্ময় মারা গেছেন।

টিভিতে নোবেল পদকের ঘোষণা শোনার পরই তিনি ঢলে পড়েন!

আজও নিউইয়র্ক নগরের জ্যামাইকা এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় সাধক শ্রী চিন্ময়কে মনে পড়ে।

তাঁর বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে।

‘I am very happy

Because I have conquered myself

And not the world.

I am very happy

Because I have loved the world

And not myself.’

আমি সুখী। কারণ, বিশ্বকে নয়, নিজেকে জয় করতে পেরেছি! আমাকে নয়, বিশ্বকে ভালোবেসেছি।

ফাতিমা উঠে দাঁড়ালেন। শাহানার হাত ধরলেন। জর্জ জড়িয়ে ধরলেন তাঁর বন্ধু মোবারককে।

মোবারকই বলে উঠলেন, আসুন বন্ধুরা আজকের সন্ধ্যাটি আমরা উৎসর্গ করি প্রাচ্যের সাধক শ্রী চিন্ময়কে। নোবেল পদক না পাওয়ার বেদনা নিয়ে তিনি আমাদের ছেড়ে গেছেন। আমরা তাঁর স্মৃতিতে বলে উঠি, আসুন নিজেকেই আমরা জয় করি!

স্বচ্ছ নীল আকাশে চাঁদকে আরও উজ্জ্বল দেখায়।

শাহানা আর ফাতিমা—দুজনের কপালেই চাঁদ যেন উপচে পড়েছে!

চাঁদ দেখতে গিয়ে প্রাচ্য আর মধ্যপ্রাচ্যের এই সুন্দরীদের এড়িয়েও যাওয়া যায় না। কিছুতেই না!