আসুন, একবার দাঁড়িয়ে যাই

আমার-আপনার গ্রামে বা পাড়ায়-মহল্লায় কয়জন দুর্নীতিবাজ-চোর আছে? একজন, দুজন? বা একজনও নেই। অথবা এরও বেশি! কত বেশি? দশ-বিশ? তাই তো? আমার-আপনার গ্রামে-পাড়ায়-মহল্লায় মোট কত মানুষের বাস? সংখ্যায় দুর্নীতিবাজ-চোরদের চেয়ে নিশ্চয়ই কম নয়, নাকি?

তাহলে কিসের এত ভয়? এই দুর্নীতিবাজ চোরেরা বীরদর্পে চলে কীভাবে? এদের সঙ্গে অনেক চ্যালা-চামুণ্ডা থাকে? খুব বেপরোয়া? যা খুশি তাই করে ফেলতে পারে এমন ভয়?

একবার দাঁড়িয়ে যাই, উপভোগ করি এদের পলায়নপর দৃশ্য।

পশ্চিম পাকিস্তানের প্রয়াণ ঘটেছিল কীভাবে? কী অন্যায় করেনি পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে মানে আমাদের সঙ্গে? যখন থেকে পূর্ব পাকিস্তান তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তখন থেকেই কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে লুণ্ঠন করা যায়, সেটাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।

কিন্তু তারাও কি রক্ষা পেয়েছিল? না, রক্ষা পায়নি বরং তাদের লেজ গুটিয়ে চলে যেতে হয়েছিল, সারেন্ডার করতে হয়েছিল আমাদের কাছে। কেন চলে যেতে হয়েছিল। কারণ, জনস্রোত ছিল তাদের বিরুদ্ধে এবং সে স্রোতের কাছে তারা ছিল একেবারেই নস্যি। রেহাই পায়নি তাই।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের কথা ধরুন। তিনি দীর্ঘ ৯ বছর দেশ শাসন করেছেন। যা চেয়েছেন তাই করেছেন। মনে হয়েছিল তাঁকে থামানোর মতো কেউ দেশে নেই। কিন্তু তিনিও থেমে গিয়েছিলেন। কী ছিল না তাঁর? সবই ছিল। পুলিশ ছিল, বিডিআর ছিল, সেনাবাহিনী ছিল। নিজের দল ছিল, নিজের গুন্ডাপান্ডা ছিল। বিরোধী বিশ্বাসঘাতকেরা ছিল। কিন্তু কিছুই তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি। তাঁকে যেতে হয়েছিল। কেন যেতে হয়েছিল? তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য কি সমান্তরাল কোনো বাহিনী গড়ে উঠেছিল? না, একদমই নয়। বরং আবালবৃদ্ধবনিতার সম্মিলিত অংশগ্রহণ তাঁকে পরাস্ত করেছিল। দীর্ঘ ৯ বছরের শাসনের অবসান ঘটাতে তিনিও বাধ্য হয়েছিলেন।

ওপরের দুটো উদাহরণ হয়তো অনেকের কাছেই প্রাসঙ্গিক না–ও লাগতে পারে। কিন্তু কেবল সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে যেকোনো বৃহৎ শক্তিকেও কাবু করে ফেলা যায়, এটা বোঝাতেই এমন উদাহরণটা দিয়েছি।

আমাদের পাশে থাকা অফিস-আদালতের কোনো কোনো জায়গায় সেবার নামে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই আচরণ করে যাচ্ছে এবং আমরা নীরবেই সব সহ্য করে যাচ্ছি। ইদানীং কোনো কোনো জায়গায় ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সচিব বা কর্মচারীরাও জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যুর নামে বা সংশোধন করে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদেরই ইউনিয়নবাসী বা পাশের বাড়ির লোকদের হয়রানি করে যাচ্ছেন, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

আমাদের ভূমি অফিসে গেলে জনগণের অসহনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। নতুন সরকার আসে, নতুন মন্ত্রী আসেন, অনেক আশার কথা বলেন, আমরাও আশাবাদী হই, কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই তথৈবচ অবস্থা হয়ে যায়। কোনো পরিবর্তন আর দেখা হয়ে ওঠে না।

আমাদের হাসপাতাল, যা সৃষ্টিকর্তার পরেই মানুষের জীবন–মরণের দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত, অথচ সীমাহীন অব্যবস্থাপনা-দুর্নীতি মানুষের জীবনের দেখভালের পরিবর্তে জীবন সংহারে ব্যস্ত বলেই অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়।

দেশের কোনো কোনো জেলায় বা উপজেলায় মাঝেমধ্যে কিছু ব্যক্তির বা দায়িত্বশীলদের কিছু ইতিবাচক ভূমিকা মনে আশার সঞ্চার করলেও এটা যথেষ্ট বলে মনে হয় না। কারণ, সেখানে সাধারণ মানুষের খুব একটা অংশগ্রহণ থাকছে না। যাতে মনে হতে পারে ওই ব্যক্তি হয়তো নিজের স্বার্থেই বা ভবিষ্যতে আরও বড় মানুষ, বড় নেতা হওয়ার জন্য এসব করে যাচ্ছেন। আর যত বড় মানুষ বা বড় নেতা হওয়া মানেই অন্য কিছু, যা দেশবাসী ইদানীং প্রত্যক্ষ করে যাচ্ছেন।

আমাদের দেশে দুর্নীতি আজকার অনেকটা শিল্পের পর্যায়ে চলে গেছে এবং সবাই এর পেছনে ছুটছে। কারও ন্যূনতম লজ্জাবোধ থাকছে না। বড় সচিবদের অনুসরণ করে ইউনিয়নের সচিবেরাও দুর্নীতি আত্মস্থ করে চলেছেন। এমনকি প্রতিবাদকারীদের নিয়ে বিদ্রূপের হাসি হাসছেন। যেন কেউ দেখার নেই।

তাই আমাদের দাঁড়িয়ে যাওয়া ব্যতীত আর কোনো বিকল্প নেই। যার যার এলাকার অসংগতি-দুর্নীতি রোধকল্পে এখনই এবং এ মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে যেতে হবে। তবেই সুন্দর দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে উঠবে, অন্যথায় প্রতি পদে পদে ভুগতে হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মও ভুগতেই থাকবে।

*জামিলুর রহমান চৌধুরী, কিগালি, রুয়ান্ডা