আসমানির ঘর আমাকে মাতাল করে

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

অত্ত সুন্দর হইলদা রইদ। উজানি চরে দুই ফসলি জমি। গন্ধরাজ তেল। বয়ের সাবান। তয় ক্যান বুক জ্বলে। কার লাগি? বেইন্যালা চারমুখ চুলায় টেইন্যার খেতের নয়া চালের ভাত বসাইছি। লগে চুক্কা বাইগনের টক। মেসতাপাতার ভর্তা আর বিছরার আগাডোগা, লতাপাতায় শিদলের ছালুন।

চার মুনি কামলা খাটে। মরিচবাটা না হইলে কামলাগো বিষ হরে না। আর মোটা চাইলের ভাত। পোলার বাপের আবার সওরা লাগে। শুকনা ভাত গলায় লাগে। খাইতে বইলেই, ‘হজল্যার মা কিতা রানছস, গিলতারি না।’ অমনই কুয়া থেইকা ঠান্ডা পানি তুইল্যা দেওন লাগে। পিতলের গেলাসে পানি খাইতে খাইতে পোলার বাপ জওয়াব দেয়, ‘বউ অতক্ষণে কইলজাডা জুড়াইছে।’

হুরু ননদ করফুল নাইওর আইছে। মনটা ভার ভার! উঠতে বইতে ফুপানি কান্দন: ‘বাউজ আমার কোন্তা ভাল্লাগে না, বুকটা খাঁ খাঁ করে, সোয়ামি জব্বর ভালা, আদর করে। গঞ্জ থেইকা টেট্রন কাপড়ের ব্লাউজ বানাইয়া দেয়। লগে পাবনার মিহিন সুতার শাড়ি, ছয় ছাঁটের সায়া, না চাইতেই দেয়। আমার মনডা ভালা রাখনের লাইগা হের যে কী চেষ্টা! রাইতবিরাইতে খোয়াবে বুল্লার হিরণরে দেহি। বেড়ার ফাঁক দিয়া আমারে ডাহে, ‘করফুল, করফুল, ঘরে মন টেহে না, তরে দেখবার আইছি...। চানবাজার থেইকা এক ডজন লাল চুড়ি আনছি, তোর লাইগা...পিন্দা আমার দেখা...দুই চোখ ভইরা তরে দেহি!’

করফুলের বুক হু হু কইরা ওঠে। ‘আমি তো আর তর নাইরে, তর নাই।’ তরিকুল মুনসি তরে দেখলে আমারে ফতুয়া দিব, ঘর ভাইঙ্গা যাইব, তখন আমি কী খাইয়া বাঁচুম। কী দিয়া গতর ঢাকুম...দুইডা ভাত আর শরম বাঁচানের লাইগাই তো ঘর করি। আর দুই মুট মাটি যদি মইরা গেলে কবরে দেয়। মনের দাম কে দিছে, কবে দিছে! মাইয়া মাইনসের আবার জীবন। ভাত পাইলেই জনম উদ্ধার হয়। মাইয়া মানুষের ঘর ভাঙলে ঠাডা পড়ে আর মইরা গেলে, কী ভালা মাইয়া আছিল, অত্ত কষ্ট কইরা জামাইর ভাত খাইছে...তয় মুখ ফুইটা কিচ্ছু কয় নাই। বড় ভালা মাইয়া আ আ! আল্লাহ বেহেশত নসিব করুন।

হুরুকালে মঠপাড়ায় হরমুজ বয়াতিরে মন দিছি। এক লগে বাতাসা লাড্ডু, কলাপাতায় শিন্নি ভাগ কইরা খাইছি। দিলও ভাগ করছি। হের ভাগ আমি লইছি। আমার ভাগ হ্যায়। একলগে বইয়া কানছি। খুশির বন্যায় ভাইস্যাও গেছি। আর অহন ঘর করি অন্য মাইনসের লগে। চারভিটা ঘর, ফল ফসলিতে ভরা। বছরে দুইবার বাপের বাড়ি নাইওরও যাই। ঘর করি, বড় ঘর। ভাতঘর। এর লাগি দামও পাই। মায়ের একটাই কথা, ‘জামাইর বাড়ি থেইকা যদি বাইরই হইতে হয়, তয় পিন্দনে যেন থাকে সাদা কাপড়। জামাইর হাতে মরণও ভালা। তখন বেহেশতই ঠিকানা।

কামরাঙা গাছে নয়া পাতা উঁকি দিছে। বাছুর গোলানরে গোয়ালে দিয়া বড়বাড়ির ইস্কুল ঘর, পুষ্কুনি, এক বিঘার বাঁশবাগান দেখতে দেখতে পাঁচগাঁও বাগদিয়া পার হইয়া পাহাড়পুর সইয়ের বাড়িতে যাই। সই সখিনা উঠানে ধান নাড়ে। রইদের আলো পইড়ে সইয়ের নাকছাবিটা ঝিলমিল ঝিলমিল করছে। সোহাগী বউ হইতে হইলে মন মানুষ পাইতে হয়। তখন দুইখান মিঠা পানেও শান্তি। জেওরপাতি নেই, সোনার সিন্দুক নেই—তাতে কী? সখিনার বুকপাঁজরে যে দখিন হাওয়ার নিত্য আসা–যাওয়া, লীলাময় ভুবনে অমন খুশি কজনাই–বা হতে পারে।

তয় মন মানুষ পাইতে হইলে সাধন করতে হয়। সাধন—বাউলজীবন আর তাঁর সাধনায় অনন্তলোকে দেখা মেলে মন মানুষের। দীক্ষায় নয়া জনম তখন সার্থক হইয়া ওঠে।

দখিনা বাতাস বয়। বুকে চিনচিন ব্যথা। এলোচুলের জট জীবনজটের দ্বারস্থ হয়। দাখতর বাড়ির বউ হওয়ার স্বপ্ন মাথাচাড়া দিয়া ওঠে। আসমানির ঘর আমাকে মাতাল করে। নয়া ঘর। তয় বুকের খাঁচায়। কী ঘেরান। আমি ছাড়া অমন গহিন আর অনন্ত সরোবরে কেউ পৌঁছাতে পারে না। কখনোই না!

বুকে বাজে...

‘আমার চোখের পানি মিলব যায়া কোন সে দরিয়ায়
সেই অজানা পারের লাইগারে আমার কান্দে ভাটির সুর।’

মুক্তা মাহমুদা: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।