আশাবাদী পাগল

এ বছরের জানুয়ারি মাসের কথা। মোটামুটি দীর্ঘ এক ছুটি দেশে কাটিয়ে আবার প্রবাস জীবনে ফিরেছি; পরিবার পরিজন ছাড়া। তাদের এবং স্বজন, মা ও দেশের জন্য মনটা পুড়ছে। এমন অবস্থায় একদিন গেলাম এক বাসায় দাওয়াত খেতে। তাঁরা অনেককে দাওয়াত দিয়েছেন। বড় সমাবেশ। সব অতিথি মনে হয় তখনও আসেননি। তাই যা হয় আর কি, শুরু হলো দেশ-বিদেশ (বিশেষ করে বাংলাদেশ) নিয়ে আলোচনা। এক ভাই আমাকে বললেন, কি ভাই, দেশের অবস্থা কী দেখে আসলেন?
আমি উত্তর দিলাম, ‘ভালো’।
‘বলেন কী ভাই, আগুন দিয়া মানুষ মাইরা ফালাইতেছে। প্রতিদিন হরতাল–অবরোধ, তা–ও বলতাছেন দেশের অবস্থা ভালো।’
তাঁর কথা শুনে মনে মনে ভাবলাম, খাইছি ধরা।
আমি বললাম, ‘না মানে আমি তো এইসব কিছু দেখি নাই। বরং যানজটবিহীন ঢাকা আমার ভালোই লেগেছে।’
ভদ্রলোক খুবই আহত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হলো মনে মনে বলছেন, এই রকম হৃদয়হীন লোকের সঙ্গে কথা বলাই ভুল। সারা দেশের মানুষ কষ্টে আছে, আর উনি ঢাকার রাস্তা ফাঁকা বলে মনে সুখ পাচ্ছেন।
আমি ভাবলাম, যাক বাঁচা গেল।
‘কিন্তু দেশের সব নেতানেত্রী তো জেলে। এভাবে কি দেশ চলে, আপনিই বলেন?’ পাশ থেকে আরেক ভাই আমাকে প্রশ্ন করলেন।
তাঁর প্রশ্ন শুনে আমি মনে মনে ভাবলাম, কি জ্বালা, এ তো দেখি মুক্তি নাই।
‘ভিডিও বার্তা পাঠাইয়া আন্দোলন করবে আর রাস্তাঘাটে পেট্রলবোমা মাইরা মানুষ মারবে, জেলে নিবে না তো কী করবে?’ আমি বললাম।
আমার এ কথায় বেশ কজন চেয়ার ঘুরিয়ে বসলেন। কয়েকজনের চোখে ‘আজকে পাইছি তোরে’ জাতীয় চাহনি দেখতে পেলাম। বেশ কয়েকজন মনো হলো জামার হাতা গুটাচ্ছেন। তাঁদের কারও মনোভাব মনে হলো, ব্যাটা (অর্থাৎ আমি) আওয়ামী লীগের দালাল, আজকে তোরে সাইজ করা হবে।
‘তাহলে ভাই এই যে নির্বাচনটা হলো, এটাও তো মনে হয় ঠিক হয়েছে, কি বলেন?’ এক ভাই জিজ্ঞেস করলেন।
তার প্রশ্নের স্টাইল শুনে মনে চিন্তা করলাম, ১০ নম্বর বিপদসংকেত। নাহ আর বাড়ানো ঠিক হবে না।
‘ভাই এটা তো কোনো নির্বাচন না। হুদাই জনগণের পয়সা নষ্ট হয়েছে। আর শোনেন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার তো বলেই দিয়েছেন, এটা হলো গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার। এর ওপরে তো আর কোনো কথা নাই।’ আমি বললাম।
আমার এ বক্তব্যে কারও চোখেমুখে বিভ্রান্তি। কারও কারও চোখে ‘ইশ, আজকেও ফসকাইয়া গেল’ জাতীয় হতাশা। অধিকাংশের আগ্রহ উবে গেল। দু–একজন দেখি তবুও ঝুলে আছেন। তাঁদেরই একজন আবার বললেন, ‘দেশের ভবিষ্যৎ কী, বলেন?’
‘দেশের ভবিষ্যৎ অবশ্যই খুব ভালো। নেতা–নেত্রীরা দেশের অগ্রযাত্রাকে শুধু একটু ধীর করে দিতে পারবেন। তা–ও খুব সামান্য। শেষ পর্যন্ত দেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাবে।’ আমার এই কথার পরে দেখি সবার সমস্ত আগ্রহ নিমিষেই শেষ। কথায় বলে, অতি আশাবাদীরা হয় পাগল আর না হয় বোকা। আর যা–ই হোক পাগল কিংবা বোকার সঙ্গে আলাপ চালাবার তো কোনো মানে হয় না ।
যা হোক, দেশে থাকার সময় এক অবরোধের দিনে রিকশা করে কারওয়ান বাজার থেকে গুলশান ফিরছি। রিকশাচালক চাচার সঙ্গে টুকটাক গল্প শুরু করলাম।
চাচা দেশের অবস্থা কী বুজতাছেন?
এইটা আমারে জিগাও কেন বাবা। তোমরাই তো ভালো বুজ। কোথাও কোনো শান্তি নাই।
এই যে অবরোধের মধ্যে রিকশা বাইর করছেন, ভয় করে না।
নারে বাবা, আমাগো কি ভয় পাইলে চলব? কাম না করলে কী খাইবাম?
তবুও বাসায় থাকলে অন্তত জানের ওপর ভয় থাকে না। তাই না?
নারে বাবা, বাসায় বইয়া থাকলেও মইরা যাইবাম পারি। হায়াত–মউত ওপর আল্লাহর হাতে।
আমি তখন স্বাভাবিক মৃত্যু আর অস্বাভাবিক মৃত্যু সম্বন্ধে চাচাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। চাচা স্পস্টতই এইসব আজাইরা প্যাচালে বিরক্ত। তাঁর কাছে মৃত্যু মৃত্যুই। স্বাভাবিক–অস্বাভাবিক আলাদা কিছু নেই। এখন আপনিই বলেন, যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই রকম যুক্তিহীন অদম্য মানসিকতার অধিকারী, তাদের আপনি ঠেকাবেন কীভাবে। এই রকম দেশ নিয়ে আশাবাদী হয়ে আমি পাগল হতেও রাজি আছি।
এবার বহু পুরনো একটা কৌতুক বলে এই আজাইরা প্যাঁচাল শেষ করছি—এক গৃহস্থ লোক আরেক লোককে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই আপনি কী করেন?’
‘আমি নাবিক।’ লোকটা উত্তর দিল।
‘তাই নাকি। আপনের বাবা কী করতেন?’
‘তিনিও নাবিক ছিলেন।’
‘তিনি মারা গেছেন কীভাবে?’
‘তিনি জাহাজডুবিতে মারা গেছেন।’
‘আপনার দাদা?’
‘তিনিও নাবিক ছিলেন এবং জাহাজডুবিতে মারা গেছেন।’
‘কী বলেন ভাই! আপনি জাইনাশুইনা আবারও এই কাজ করতাছেন।’
‘হুম করি। এখন বলেন আপনার বাবা কী করতেন এবং কীভাবে মারা গেছেন?’
‘উনি গৃহস্থ ছিলেন এবং বিছানায় শুইয়া মারা গেছেন।’
‘আপনার দাদা?’
‘উনিও গৃহস্থ ছিলেন এবং বিছানায় শুইয়া মারা গেছেন।’
‘তো এখন আপনিই বলেন তফাতটা কোথায়। বিছানায় শুইয়া থাইকাও তো আপনার বাপ–দাদারা বাঁইচা থাকতে পারেন নাই। আর কে বলতে পারে, আমার বাবা-দাদার হঠাৎ মৃত্যুর চাইতে আপনার বাবা-দাদার রোগভোগের মৃত্যু বেশি কষ্টের কি না।’
মোস্তাফিজুর রহমান
ব্রিজবেন, অস্ট্রেলিয়া