আরাকান ও রোহিঙ্গা

রোহিঙ্গা শরণার্থী। ছবি এএফপি
রোহিঙ্গা শরণার্থী। ছবি এএফপি

সাড়ে তিন শ বছর আগের কথা। আরাকান রাজ্যের বৌদ্ধরাজ, শ্রীচন্দ্র সুধর্ম্মার। সে রাজ্যের মন্ত্রী মাগন ঠাকুর। তিনি কবি আলাওলকে আশ্রয় দিলেন। গুণীর কদর করলেন। আলাওল লিখলেন পদ্মাবতী। রাজ্যের সমরসচিব ছিলেন কাজী আশরাফ খাঁ। তিনি দৌলত কাজীকে কাব্য রচনার নির্দেশ দেন। দৌলত কাজী লিখলেন লোর-চন্দ্রানী কাব্য। লোর হলো প্রণয় কুমারের নাম। চন্দ্রানী হলো নপুংসক বৌদ্ধরাজের রানির নাম। তাদের মধ্যে প্রেম হলো। কবি লিখলেন-কি কহিব কুমারীর রূপের প্রসঙ্গ/অঙ্গের লীলায় যেন বান্ধিছে অনঙ্গ।/কাঞ্চন-কমল-মুখে পূর্ণশশী নিন্দে/অপমানে জলেত প্রবেশে অরবিন্দে। (কুমারীর সৌন্দর্য দেখে পূর্ণিমা নিন্দা করে, অপমানে পদ্মফুল পানিতে ডুবে)।
এই ছিল সেসময়ে আরাকান ও বাংলা। বৌদ্ধরাজের রাজসভার কবিরা সব মুসলিম। সাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত মেলে। আর এখন? আরাকানের রোহিঙ্গারা হয়ে যায় উদ্বাস্তু। মিয়ানমার বলে তারা বাংলাদেশি। কেউ বলে, ওরা মুসলিম! নাফ নদী, ইতিহাসের এক কাল সাক্ষী।
বাংলাদেশের ফেসবুকে হঠাৎ রোহিঙ্গা রোহিঙ্গা করে চিৎকার বেড়ে গেল। লক্ষ্য করে দেখি দুই দল মুখোমুখি। কেউ কেউ রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রচার-অপপ্রচার চালাচ্ছে। কেউ সেটা রুখে দিতে অতন্দ্র প্রহরী হয়েছে। কে সত্য, কে মিথ্যা, কে জানে? বাংলার অলীক সামাজিক মাধ্যমে (Virtual Social Media) নামহীন, পরিচয়হীন অসংখ্য মানুষে ভরা। যেকোনো হট্টগোলে কনের বাপ ও বরের বাপ কে, এই তথ্য এখনে খুঁজে পাওয়া যায় না। আটপৌরে চিৎকার চেঁচামেচি চলবে। এ অলীক ধরায় কে ধলা কে কালা, খুঁজে না পাই দিশা। তবে এই চেঁচামেচিতে রোহিঙ্গাদের চোখের পানি মুছবে না, এটা বলা যায়।

বাঙালির সবকিছুতে ধর্ম অ্যালার্জি। কে মারল, ধর্ম খোঁজো। কাকে মারল, ধর্ম খোঁজো। পৃথিবীর সব জাত, সব ধর্ম, সব দেশেই যে কিছু অসভ্য বর্বর মানুষ থাকে, সেটা তারা ভুলে যান। রোহিঙ্গারা নির্যাতিত। পৃথিবীর বড় বড় প্রচারমাধ্যমেই খবর হয়েছে। প্রামাণ্যচিত্র হয়েছে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করার অধিকার যে কারও আছে কিন্তু সে প্রতিবাদ অবশ্যই ধর্মীয় প্রতিহিংসা বর্জিত হতে হবে। রোহিঙ্গাকে মুসলমান আর রাখাইনদের বৌদ্ধ হিসেবে দাঁড় করিয়ে নির্যাতনের প্রচার-অপপ্রচার অনাকাঙ্ক্ষিত। রোহিঙ্গা নির্যাতনের দায় বুদ্ধ কিংবা তাঁর বাণীর নয়। এ দায় মিয়ানমারের।

লেখক
লেখক

মিয়ানমারের সংখ্যালঘু হিসেবে বহু বছর ধরে নির্যাতিত এই রোহিঙ্গারা। তারা দরিদ্র ও অশিক্ষিত। তাদের কণ্ঠ পৌঁছে না পৃথিবীর দরবারে। অসহায় মানুষগুলো নাফ নদী পাড়ি দিয়ে প্রাণে বাঁচতে চায়। তাদের একমাত্র ভরসা বাংলাদেশ। কিন্তু এই অনুপ্রবেশ নতুন নয়। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে নিয়মিত বাস করছে। হর হামেশা আসছে আরও কত। তাই বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ নিয়ে কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের কথা তুলে ধরতে হবে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনে। স্থায়ী সমাধানের জন্য দাবি জানাতে হবে। তাদের অধিকারের কথা তুলে ধরতে হবে। মানুষের জন্যই তো মানুষ, জীবনের জন্যই তো জীবন! রোহিঙ্গাদের জন্য দাঁড়াতে হবে, রাষ্ট্রীয় ও মানবিক স্বার্থে।
*ড. রউফুল আলম, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: <[email protected]>