আর কতকাল এমন পারাপার

জুন-জুলাই, এ সময়টায় আমাদের দেশে নদী উত্তাল থাকে খুব। তাই ফ্লাইটের দুদিন আগেই বের হওয়ার কথা ছিল সন্দ্বীপ থেকে। সন্ধ্যায় বাজারে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বড় পর্দায় আরেকটি ফুটবল ম্যাচ দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। ভাবলাম, এক দিন আগে গেলেও তো চলে। আর্জেন্টিনা-সুইজারল্যান্ড ম্যাচ দেখেই বাড়ি ফিরলাম। আম্মা অনেক খুশি, ছেলে আরেক দিন থাকছে বলে, কাল কী কী রাঁধবেন সেটা হিসাব শুরু করেছেন।
একসময় বর্ধিত দিনটিও শেষ হলো। পরদিন ভোরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি আর গুমোট আকাশে বের হয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। না বের হয়ে উপায় নেই। আগামীকাল সকালেই ফ্লাইট। গুপ্তছড়া ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছার পর কানে অনবরত হুইসেল বাজিয়ে একটি গাড়ি অতিক্রম করে গেল আমাদের। পরে দেখলাম আসলে ওটা অ্যাম্বুলেন্স ছিল। ভাবতে ভালোই লাগল আমাদের সন্দ্বীপে অ্যাম্বুলেন্স চলতে দেখে। ঘাটের শেষ প্রান্তে যাওয়ার পর জানতে পারলাম জাহাজ বিকল হয়ে পড়ে আছে, আজ ছাড়বে না। শুনলাম সদরঘাট রুটেও আজ জাহাজ আছে। বাহন ঘুরিয়ে এবার চললাম সেদিকে।
মাঝপথে বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম এমভি বারোআউলিয়া হাতিয়ায় বিকল হয়ে আটকে আছে। আজ আর আসবে না। চিন্তায় পড়ে গেলাম! বড় ভাই গাছুয়া ঘাটে ফোন করে খবর নিলেন, এক ঘণ্টা পর ট্রলার ছাড়বে কিন্তু এক ঘণ্টায় সেখানে পৌঁছাতে পারব না।
যাওয়াটা আবশ্যক না হলে বাড়ি ফিরে যেতাম। বাহন আবার ঘুরালাম গুপ্তছড়ার দিকে। ওদিক থেকে কিছু না কিছু ছেড়ে যায়। সেই কিছু না কিছু পাওয়ার আশায় ছুটে চললাম। খোঁজ নিলাম ঘাটে, সাড়ে চারটায় কয়েকটি মালবাহী বোট ছেড়ে যাওয়ার কথা। যদিও নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না।
ঘাটে এসে দেখলাম ভ্যানগাড়িতে শুয়ে আছে সেই অ্যাম্বুলেন্স আরোহী রোগী! ফ্লুইড-স্যালাইন চলছে শরীরে! পাশে দাঁড়িয়ে আছেন উৎকণ্ঠিত আপনজন। সেই নয়টায় আসতে দেখেছি তাঁদের, এখন বাজে তিনটা! অথচ এখনো ঘাটে! এতক্ষণে রোগীর মৃত্যুও হতে পারত! কী বলব? এসব তো প্রায়ই দেখি আমরা। আমাদের তাই সয়ে গেছে এসব! যতটুকু জানি একটা সি-অ্যাম্বুলেন্স আছে ঘাটে, কখনো ব্যবহার হয়েছে কিনা সন্দেহ!
একসময় ঘড়ির কাঁটা চারটে অতিক্রম করল। এতক্ষণ পর আশার প্রদীপ দেখতে পেলাম। যাত্রীবাহী একটি ট্রলার ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিল ঘাট কর্তৃপক্ষ। টিকিট কেটে উঠে পড়লাম। যাক ফ্লাইটটা অন্তত মিস হচ্ছে না তাহলে। একটু পর বাধল বিপত্তি! ঘাট মালিকের ফোন এসেছে, ট্রলার ছাড়বে না আজ! টিকিটের টাকা ফেরত দিয়ে দিল সবাইকে।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি ফিরে যাওয়ার। ফ্লাইট মিস হলে নতুন টিকিট করে যেতে হবে। হাজার বিশেক টাকার ধকল হয়তো। কি আর করা জীবনের চেয়ে তো টাকা বড় নয়! যদিও আমার মতো প্রবাসী চাকুরের কাছে টাকার অঙ্কটা নেহাত কম নয়।
বাড়ি থেকে একের পর ফোন আসছে। নদী উত্তাল অনেক আজ। কুমিরা থেকে মাল নিয়ে আসা কিছু ছোট লাল বোট ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আব্বার এমন পরিস্থিতিতে আসা হয়েছে হয়তো, তাই তিনি সাহস করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠিক বোটে ওঠার আগে আম্মাকে ফোন দিলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল শেষবারের মতো কথা বলে নিচ্ছি। আম্মা ফিরে যাব শুনে খুশি হয়ে চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়েছেন। ছেলে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই গরম গরম খেতে দেবেন বলে। আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে পড়লাম ছোট্ট তরিতে। বোটটিতে আরও জনা বিশেক যাত্রী, সবার না গেলেই নয় এমন পরিস্থিতি!
বোট যখন এগোতে শুরু করল, ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল আমাদের শরীরের ওপর। আমি মাঝখানে লোকজনের ব্যাগের ওপর হেলান দিয়ে বসে পড়লাম চোখ বন্ধ করে। ভাবটা এমন যা হবে হোক আমি দেখতে রাজি না! মনে মনে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছিলাম। ঢেউ যাতে ভেজাতে না পারে তার জন্য মাঝি একটা প্লাস্টিক দিল। সবাই মিলে তা মাথার ওপর ধরে রাখলেও ঠিক বাঁচতে পারছিলাম না ঢেউয়ের আঘাত থেকে, ঠিকই সে ভিজিয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ খুলে মাঝেমধ্যে বোটের কিনারায় বসা লোকটিকে ইশারায় জিজ্ঞেস করছিলাম, কতটুকু এলাম? কূল-কিনার দেখা যাচ্ছে?
ইশারায় লোকটি বুঝিয়ে দিল এখনো দেখা যাচ্ছে না। আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। চোখের সামনে শুধু ভেসে আসছে প্রিয়জনগুলোর সঙ্গে কাটানো শেষ মুহূর্তগুলোর কথা।
কিছুক্ষণ পর আবার চোখ মেলতেই বোটের কিনারায় বসা লোকটি ইশারায় জানান দিল কিনার দেখা যাচ্ছে! কিছুক্ষণ পর আমরা ওপারে পৌঁছাতে যাচ্ছি। মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানাচ্ছি। বোট থেকে নামার পর আব্বা আর ভাইকে দেখলাম। এই দুই ঘণ্টা দুজনের সঙ্গে একবারও চোখাচোখি হওয়ার সুযোগ হয়নি!
বোট থেকে নামার পর সেই রোগীর কথা মনে পড়ল। আমি তো সাঁতরে আসার মতো করে এসেছি! শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল সে অভাগীর? আসার পথে দেখেছি সেই সি-অ্যাম্বুলেন্সটি কূলে পড়ে আছে অযত্নে!
এভাবে আর কতকাল নদীর কূলে এসে আমাদের মৃত্যু-যন্ত্রণায় ছটফট করতে হবে?