আমেরিকায় স্কুল শুটিং ও সবার কর্তব্য

বন্দুক
প্রতীকী ছবি

আমেরিকায় স্কুল শুটিং অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়ার ঘটনা যেমনটা ঘটে, ঠিক তেমন। এ জন্য দায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প, টেড ক্রুজ, গ্রেগ এবোট শ্রেণির কিছু রাজনীতিবিদ। মানুষের জীবনের মূল্য তাঁদের কাছে শূন্য। বন্দুকধারীরা মিলিয়ন ডলার তাঁদের দেন, তাঁরাও তখন মুখ দিয়ে তোতাপাখির মতো বুলি আওড়ান। তা না হলে স্কুল শুটিংয়ের মাত্র তিন দিনের মাথায় সেই স্কুল থেকে মাত্র আড়াই শ মাইলের দূরত্বে কেউ এনআরএ কনভেনশন করে? কতটা নির্লজ্জ হলে ‘মানুষ’ এমন কাজ করে!

সেই কনভেনশনে অংশ নেওয়া একজন এক সাংবাদিককে বলেন, ‘বন্দুক মারেনি, খুন করেছে মানুষ। মানুষকে দোষ দাও, বন্দুককে কেন দোষ দিচ্ছ?’ তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষকেরা কেন দরজা ঠিকমতো লাগাল না।’

সাংবাদিক সরাসরিই জিজ্ঞাসা করেন, ‘তাহলে সব দোষ টিচারের, দরজা কেন লাগাল না?’

তিনি তখন ইনবিন শুরু করে, কিন্তু বলে না যে ‘আমি এইটা বলতে চাইনি। ভিকটিম নির্দোষ।’ বরং বোঝাতে চাইল, এখানে দুই পক্ষেরই দোষ আছে।

যেকোনো স্কুল শুটিংয়ের পর আমরা জানতে পারি, শুটার আগে থেকেই ওর সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন যে তিনি এমনটা করতে চলেছেন। বন্দুক কিনে বন্ধুবান্ধবকে (বেশির ভাগই লোনার হওয়ায় তাঁদের হাতে গোনা দু-একটা বান্ধব থাকে) জানিয়েই কাজটা করে। মানে, লোকজন সময়মতো অ্যাকশন নিলেই এমন দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।

যেমন এই অতি সাম্প্রতিক ঘটনাতেই তরুণ নিজের ১৮তম জন্মদিনে এ-১৫ রাইফেল কিনলেন। এরপর সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত এক মেয়েকে জানাল যে তিনি কী ঘটাতে চলেছেন। মোটামুটি সব শুটারই বন্দুক কিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করেন, কেউ কেউ গুলি চালিয়ে প্র্যাকটিসও করেন। বন্ধুবান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশী, পরিবারের লোকজন ভালো করেই এসব দেখেন ও জানেন। কিন্তু সময়মতো কেউই অ্যাকশন নেন না।

এবার এক মায়ের কথা বলি। আমেরিকান মা। তিন বছর আগে (২০১৯ সালে) নিজের ছেলের জার্নালে তিনি পড়েন যে ছেলে স্কুল শুটিংয়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। বোমা মেরে মানুষ মারবে, যাঁরা বেঁচে যাবেন, তাঁদের গুলি করে খুন করবে ইত্যাদি। মা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেন, ছেলে বলে, ‘ওটা ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রজেক্ট।’

আমি নিজে দুই ছেলের বাবা। আমি ভালোভাবেই বুঝি, এ ধরনের পরিস্থিতিতে মা–বাবা কী মানসিকতা অবস্থার মধ্য দিয়ে যান। সবাই সেলফ ডিনায়েলে থাকেন। ‘আমার ছেলেমেয়ে খারাপ কিছু করতে পারবে না।’

বাস্তবতা হচ্ছে, আমি অস্বীকার করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। ঘটনা যা ঘটার, ঘটবেই এবং এর ফলাফল আরও খারাপ হবে।

ওই মা জানেন, তাঁর ছেলে ডিপ্রেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানেন, তাঁর ছেলে স্কুলে বুলিড হয়, বন্ধুবান্ধব তেমন নেই। এখন তিনি দেখলেন, ছেলে এই পরিকল্পনা ফেঁদে বসে আছে। তিনি সেই কাজই করলেন, যা প্রত্যেক মা–বাবা–বন্ধুবান্ধবের অবশ্য কর্তব্য। ফোনে তিনটি বাটন টিপলেন—নাইন ওয়ান ওয়ান।

ওই মার জন্য কাজটি কতটা কঠিন, সেটা যে মা নন, তিনি কল্পনাও করতে পারবেন না। একজন বাবার পক্ষেও সম্ভব নয়। নয়টা মাস এ সন্তানকে মা পেটে ধরেছেন। তাঁর শরীরের একটি অংশ সে। বছরের পর বছর নানা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে এ সন্তানকে তিনি বড় করেছেন। সেই সন্তানকেই তিনি পুলিশে ধরিয়ে দিলেন। নিঃসন্দেহে কঠিন সিদ্ধান্ত। তাঁর মনেও বারবার সন্দেহ জেগেছে, ‘আমি ভুল করছি না তো?’

না। ওই মা মোটেই ভুল করেননি। তিনি শুধু বহু শিশুর প্রাণ রক্ষা করেননি, নিজের সন্তানেরও প্রাণ রক্ষা করলেন। ছেলে জেলে আছে, তো কী হয়েছে! বেঁচে আছে। অন্য শিশুদের হত্যা করে কোটি মানুষের অভিশাপ নিয়ে নরকে যায়নি। তার চিকিৎসা দরকার, চিকিৎসা হবে। সুস্থ হলে বেরিয়ে আসবে। তা না হলে থাকুক নাহয় কারাগারে, তবু তো বেঁচে থাকবে। অন্যেরও ক্ষতি করবে না।

আমার মা আমাদের একটি ঘটনা প্রায়ই শোনাতেন। তাঁরা যখন স্কুলে পড়েন, তখন তাঁদের এক বান্ধবী এক বখাটের প্রেমে পড়েন। পরিকল্পনা করেন যে একদিন ওই গুন্ডার সঙ্গে পালিয়ে যাবেন। ঘটনার দিন মা ও তাঁর বান্ধবীরা মিলে সেই আন্টির মা–বাবাকে জানিয়ে দেন যে মেয়ে পালাতে যাচ্ছেন। অভিভাবক সময়মতো ব্যবস্থা নেন এবং মেয়ের জীবন রক্ষা হয়।

সেই আন্টি সেই বান্ধবীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি।
কিন্তু সেই বান্ধবীরাই কি তাঁর জীবন রক্ষা করল না?
এ সিদ্ধান্ত বন্ধুবান্ধব সময়মতো নিতে পারেন?

আমেরিকায় আমরা যারা অভিভাবক আছি, আমাদের সবার দায়িত্ব নিজের বাচ্চাদের সঙ্গে খোলাখুলি এসব বিষয়ে কথা বলা। জানতে হবে, তাদের নিজেদের এমন কোনো পরিকল্পনা আছে কি না; তাদের কোনো বন্ধুবান্ধব এমন কিছু বলে কি না; সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে কি না; তাদের স্কুলের পরিবেশ কেমন; ও নিজে বুলিংয়ের শিকার হয় কি না বা অন্যকে বুলিং করে কি না; কারও সঙ্গে শত্রুতা আছে কি না, হলে সেটা কতটুকু; কে ওর ভালো বন্ধু ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন আমাদের করতেই হবে। ওরাও বিরক্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। মা–বাবাকে সবকিছু জানাতে চাইবে না। কিন্তু আমাদের কোনোই উপায় নেই। আমরা অতি অসুস্থ সমাজে বাস করছি। ওদের নিরাপত্তার জন্যই আমাদের এসব করতে হবে।

আর আল্লাহ মাফ করুক, যদি এমন কোনো পরিস্থিতি চলে আসে, আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে ওপরে উল্লিখিত মায়ের মতো।

কয়েক বছর আগেই আমাদের ডালাসের পাশের শহরে দুই বাংলাদেশি ভাই নিজেদের পুরো পরিবারকে খতম করে ফেলেছিল গুলি করে। পরিবারকে না মারলে হয়তো স্কুলেও এমন হামলা করত। ‘এইটা শুধু আমেরিকান বাচ্চাদের কাজ, আমাদের এসব ডিপ্রেশন–টিপরেশন হয় না’—জাতীয় কথা বলার সুযোগ একেবারেই নেই। সময় থাকতে সাবধান না হলে পরে আফসোস করে লাভ নেই।