‘আমের শ্যাম্পেন হিমসাগর’

*বাংলাদেশের আমে মুগ্ধ নেদারল্যান্ডস
*নেদারল্যান্ডসে প্রথমবারের মতো তিন মেট্রিক টন আম রপ্তানি
*রাজশাহী থেকে সরাসরি যাচ্ছে হিমসাগর, আম্রপালি ও ল্যাংড়া

নেদারল্যান্ডস ইউনেসকো কমিশনের চেয়ার ও দেশটির সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য ক্যাথলিন ফেরিয়ার, সাবেক ডাচ্‌ কূটনীতিক কফি আনান কমিশনের সদস্য লেইটেশিয়া ভ্যান ডেন আসুম কিংবা দ্য হেগের মেয়র ইয়ান ভ্যান জানেনের কাছে হিমসাগরের স্বাদটা ছিল অচেনা। এবারই তাঁরা প্রথমবারের মতো স্বাদ পেলেন বাংলাদেশের হিমসাগরের। সুদূর রাজশাহীর বাগান থেকে নিজেদের বাড়িতে বসে এ আম খেয়ে এক বাক্যে স্বীকার করে নিলেন, আসলেই আমের শ্যাম্পেইন হিমসাগর!

বাংলাদেশের আমের স্বাদে মুগ্ধ লেইটেশিয়া ভ্যান ডেন স্লাম চাইছেন এখন থেকে নিয়মিতভাবে হিমসাগর সরাসরি নেদারল্যান্ডসের সুপারস্টোরগুলোয় যেন পাওয়া যায়।
ফল ও সবজি রপ্তানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানদণ্ড পুরোপুরি অনুসরণ করে এবার বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে আম রপ্তানি হয়েছে নেদারল্যান্ডসে। গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে নর্থ বেঙ্গল অ্যাগ্রো ফার্ম লিমিটেড শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আমস্টারডাম বিমানবন্দরে ওই আম নিয়ে গেছে। এ বছরের মে মাসে প্রথম চালান পাঠানোর পর ৮ জুলাই বাংলাদেশ থেকে আমের তৃতীয় চালান যাচ্ছে নেদারল্যান্ডসে।

নর্থ বেঙ্গল অ্যাগ্রো ফার্ম লিমিটেড গত বছর থেকে সুইজারল্যান্ডে আম রপ্তানি শুরুর পর এবার নেদারল্যান্ডসের পাশাপাশি জার্মানি ও সুইডেনে প্রথমবারের মতো আম পাঠাচ্ছে।

ছবি: দূতাবাসের সৌজন্য

নেদারল্যান্ডসে প্রথমবারের মতো আম রপ্তানির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, এর আগে জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের আম আসত নেদারল্যান্ডসে। তবে হিমসাগরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন আমের যে বিশেষত্ব ছিল, সেটা নেদারল্যান্ডসে অজানা ছিল। এবারই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে নেদারল্যান্ডসে আম রপ্তানি হয়েছে।

শুরুতে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের কথা ভেবে আম পাঠানো শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশ পাঠানো এসব আম দূতাবাসের পক্ষ থেকে নেদারল্যান্ডসের রাজপ্রাসাদ, মন্ত্রিসভার সদস্য, বেশ কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য ও দেশটির বিশিষ্ট নাগরিকদের কাছে পাঠানো হয়েছে। উপহারের আম নিয়ে তাঁরা ই-মেইল, টুইট, লিংকডইন, চিঠি ও মেসেজ দিয়ে যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়া পাঠিয়েছেন।

রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহর মতে, ডাচ্‌রা সাধারণত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে না। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আম নিয়ে তাদের এই উচ্ছ্বাস ভালো বাজারের ইঙ্গিত দেয়।

হিমসাগর
ফাইল ছবি

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্দেশনা অনুযায়ী সদস্যদেশগুলোয় বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে ফল ও সবজি আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি প্যাকিং হাউস থেকে প্যাকিংয়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে নেদারল্যান্ডসে আম পাঠানোর ক্ষেত্রে ইইউর শর্ত পূরণ করা হয়েছে কি না, তা জানতে চাইলে নর্থ বেঙ্গল অ্যাগ্রো ফার্ম লিমিটেডের ব্যবসা ও বিপণন উন্নয়ন পরিচালক শাহরিয়ার লীন আজ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ইইউতে রপ্তানির ক্ষেত্রে কন্টাক্ট ফার্মিংয়ের আওতায় গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস (জিএপি) মেনে চলতে হয়। প্রথমত, যে বাগান থেকে ফল বা সবজি রপ্তানি করা হবে, ওই বাগান কৃষি কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে পরিচর্যা হতে হবে। চাষের সময় একটি সনদ দিয়ে কৃষি কর্মকর্তা এটা নিশ্চিত করবেন যে বাগান তাঁর তত্ত্বাবধানে ছিল এবং বাগানের আম নিরাপদ। বাগান থেকে সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউসে নেওয়ার পর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কোয়ারেন্টিন বা সঙ্গনিরোধ বিভাগের উপপরিচালক একটি ফাইটো স্যানিটারি সনদ দেন। ওই সনদ দেওয়ার পর তাঁর তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা হয়ে যদি কোনো আম নিয়ে প্রশ্ন ওঠে—ওই আম নষ্ট হতে পারে, আমের বোঁটা সঠিক মাপে কাটা হয়নি, চাষ ঠিক নিয়মে হয়নি—তবে তিনি তা বাতিল করে দিতে পারেন। পরে কোয়ালিটি টেস্টের অনুমতি পেলে তা সেন্ট্রাল প্যাকিং থেকে সিলগালা করে বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিমানবন্দরে নেওয়ার পর সেখানকার কোয়ারেন্টিন কর্মকর্তা সিলগালা ভেঙে ওই আম গন্তব্যের উড়োজাহাজে তুলে দেন।

শাহরিয়ার লীন জানান, এখন পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসে পাঠানো আমের মধ্যে রয়েছে হিমসাগর, আম্রপালি, ক্ষীরসাপাত ও ল্যাংড়া। ৮ জুলাই স্যাম্পল হিসেবে ব্যানানা ম্যাংগো পাঠানো হচ্ছে। এই আম এখন পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশে চাষ হচ্ছে। সব মিলিয়ে তিনটি চালানে নেদারল্যান্ডসে তিন মেট্রিক টনের বেশি আম যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত আম পাঠানোর প্রস্তুতি রয়েছে।


শাহরিয়ার লীনের মতে, বাংলাদেশ থেকে নেদারল্যান্ডসে সরাসরি আম পাঠানোর ফলে দেশটিতে তৃতীয় গন্তব্য থেকে নেওয়া আমের তুলনায় দাম কম পড়বে। আর নেদারল্যান্ডসের বিশিষ্টজনদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া মনে হচ্ছে, সেখানকার বাজারটাও বেশ বড় হবে।