আমি তোমাকে ভালোবাসি

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

দুদিন আগেই তুষারপাত হয়েছে। চারদিকে এখন হিমশীতল পরিবেশ। দূরের উঁচু পাহাড়ের চূড়ার সঙ্গে শুভ্র সাদা তুষারকণা যেন এখনো আলিঙ্গনে আবদ্ধ। সূর্যোদয়ের দেশ হলেও সূর্যমামা সাপ্তাহিক ছুটি কাটাচ্ছে। এদিকে শীতের বুড়িও হাড়কাঁপানো শীতের ডালি নিয়ে বসে আছে। এত ঠান্ডায় কম্বলের মায়া ত্যাগ করে বাইরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই নিকিতার ছিল না। কিন্তু আজ যে ছুটি নেই। জাপানের মতো একটা দেশে টিকে থাকতে হলে তাকে সব প্রতিকূলতা জয় করতেই হবে। পড়াশোনা, চাকরি আর আত্মীয়ের আশ্রয়ে থাকা নিদারুণ কষ্টের দিনগুলো নিকিতার জীবনটাকেই দুর্বিষহ করে তুলেছে।

প্রতিদিনের মতো আজও নিকিতা রেলস্টেশনে বসে আছে কাঙ্ক্ষিত ট্রেনের প্রতীক্ষায়। এই স্টেশনে ট্রেন আসে বিশ মিনিট পর পর। নিকিতার এই বিশ মিনিট ভীষণ অপছন্দ। জাপানের অন্যান্য রেলস্টেশনে সাধারণত এত দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ট্রেন আসে না। কিন্তু জেআর লাইনের ট্রেনগুলো যথেষ্ট সময় নেয়। তাই প্রতিদিন নিকিতা হাতে সময় নিয়ে বের হয় যাতে ট্রেন মিস না হয়। বিশ মিনিটের প্রতীক্ষার এই সময়টুকু খারাপ লাগলেও, এক জোড়া প্রতীক্ষিত আঁখি নিকিতার বিবর্ণ পৃথিবীকে একটু হলেও রঙিন করে তোলে।

দুই বছর আগের ঘটনা। সেদিনও নিকিতা ট্রেনের প্রতীক্ষায় বসে আছে। যথারীতি ট্রেন এল। নিকিতা ট্রেনে উঠল। হঠাৎ লক্ষ্য করল, দূর থেকে একটা জাপানি ছেলে দৌড়ে আসছে। ঘড়ির কাটার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ট্রেনও বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুত। ছেলেটা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছে। এই ট্রেন মিস হলে আবার সেই বিশ মিনিটের অসহ্য প্রতীক্ষা। আর জাপানে কর্মক্ষেত্রে সময় পার হওয়ার পরে পৌঁছালে, অনেক কোম্পানিতেই বেতনের অংশ থেকে কিছু অর্থ কেটে নেওয়া হয়। সময়ের গুরুত্ব বোঝানোর চমৎকার কৌশল। এখানে সম্মানেরও একটা বিষয় জড়িয়ে থাকে। জাপানিরা খুবই পরিশ্রমী জাতি। এরা কাজে কখনো ফাঁকি দেয় না। নিকিতা তাকিয়ে আছে প্রাণপণে ছুটে আসা ছেলেটির দিকে। ইলেকট্রিক ট্রেনের দরজা এখনই বন্ধ হয়ে যাবে। দরজার পাশে লাল আর সবুজ বোতাম আছে। লাল বোতাম চাপলে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে আর সবুজ বোতামে দরজা খুলে যাবে। নিকিতা শক্ত করে সবুজ বোতাম চেপে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা দৌড়ে দরজার সামনে আসতেই নিকিতা হাত বাড়িয়ে দিল। ছেলেটা কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও বাড়ানো হাতের আহ্বানকে উপেক্ষা করতে পারল না। নিকিতার হাত ধরেই ট্রেনের ভেতরে প্রবেশ করল। নিকিতা এত ঠান্ডার মধ্যেও ঘামছে। ছেলেটা নিকিতার কাছে এসে মৃদু হেসে জাপানি ভাষায় ধন্যবাদ জানাল—আরিগাতো গোজাইমাস। নিকিতাও নীরবে হাসির উত্তর দিয়ে বলল—দোমো। ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড় থাকায়, দুজনেই ট্রেনের মুখোমুখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। ট্রেন চলছে গন্তব্যে আর একটু পর পরই দুই জোড়া চোখ একে অপরকে দেখে অপ্রকাশিত লজ্জায় নত হয়ে যাচ্ছে।

সেদিন থেকেই শুরু। এরপর আর কখনো ছেলেটি দেরি করে রেলস্টেশনে আসেনি। প্রতিদিন আগে এসে স্টেশনে বসে থাকত। নিকিতা বসত ঠিক বিপরীত দিকের আসনে। প্রতিদিনের সাক্ষাতে কেবল হাসি বিনিময় আর দুটো চোখের আবেশমাখা মায়া। ছেলেটার চোখগুলো ঠিক জাপানিদের চোখের মতো নয়। জাপানিদের চোখ হয় ছোট ছোট। কিন্তু এই ছেলেটির চোখগুলো বেশ বড় আর ভাসা ভাসা। কেমন যেন একটা মায়া মায়া ভাব আছে দুই চোখের মাঝে। কেন জানি, প্রতিদিনের নিঃসঙ্গ ক্লান্তিতে অচেনা এই মানুষটা মনে এক ভিন্ন রকম প্রশান্তি এনে দেয় নিকিতাকে। নিকিতা একা। ভীষণ একা। বাবা-মা হারানো এতিম মেয়েটি মামার কাছে বড় হয়েছে। এইচএসসি পাশের পর জাপানপ্রবাসী চাচা তাকে জাপানে নিয়ে আসে। জাপানের একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। শুরুতে চাচা-চাচি বেশ ভালোই ব্যবহার করত নিকিতার সঙ্গে। চাচাতো ভাই রকির সঙ্গে নিকিতার বিয়ে দেবে বলে মনস্থির করে চাচা-চাচি। সেই থেকেই নিকিতার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। রকিকে নিকিতার মোটেই পছন্দ না। নেশা করে, বারে যায়, জাপানের পাচিংকো স্লটে নিয়মিত জুয়া খেলে। এদিকে বাবার বিশাল সম্পত্তির মালিক নিকিতা। নিকিতার কোনো ভাই–বোন নেই। অসহায়, এতিম মেয়েটির সম্পত্তির লোভে চাচা চালাকি করে জাপানে নিয়ে এসেছে। ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সেই সম্পত্তিতে ভাগ বসাবে। নিকিতা বিয়েতে অসম্মতি জানানোর পর থেকে ওর ওপর শুরু হয় সবার মানসিক নির্যাতন। তাদের দুর্ব্যবহারে নিকিতার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

ট্রেন আসতে আর দুই মিনিট বাকি। নিকিতা শূন্য আসনের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা এখনো আসেনি। মনটা কেমন যেন করছে। চারপাশে তাকাল। কোথাও নেই। দূর থেকে সময়ের তালে তাল মিলিয়ে ট্রেন আসছে, কেবল আসেনি সেই ছেলেটি। ট্রেনে ওঠার সময় আবারও তাকাল নিকিতা। সে আসেনি। ট্রেন চলছে তার গন্তব্যকে সাথি করে। নিকিতার মন পড়ে আছে শাকে স্টেশনে। অদৃশ্য অনুভূতি বারবার পিড়া দিচ্ছে। মনে হাজারো প্রশ্ন। সে কী অসুস্থ? নাকি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে?

পুরোটা দিন নিকিতার মনটা বিষণ্নতার কালো মেঘে ছেয়ে ছিল। কাজেও মন বসাতে পারেনি। দুই বছরের অভ্যাস কী আর একদিনে বদলানো যায়? প্রতিদিনের মিষ্টি সেই আঁখি মিলন নিকিতার কাছে যে কত মূল্যবান সেটা যদি সে বুঝত! ছেলেটির অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই সেটা গেল দুই বছরে নিকিতা একটু হলেও বুঝতে পেরেছে। অন্তত ছেলেটি অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসলে নিকিতাকে প্রতিদিন ওভাবে দেখত না। জাপানে কত মেয়েইতো আছে। স্টেশনে কত সুন্দরী ডানাকাটা পরি ঘোরাঘুরি করে কিন্তু কখনো দেখেনি তাদের কারও দিকে অন্যভাবে তাকাতে। নিকিতাকে হয়তো সে ভালোবাসে কিন্তু দুজনের মাঝে অদৃশ্য দেয়াল ভেদ করে সে ভালোবাসা নির্বাক থাকে। নিকিতা প্রায় স্বপ্নে দেখে নাম না জানা সেই ছেলেটি নিকিতার চোখে চোখ রেখে বলছে—‘আই শিতেই মাস্’ অর্থাৎ আমি তোমাকে ভালোবাসি। ছেলেটিকে নিয়ে ভাবনায় এতটাই ডুবে ছিল যে ওর রুমের দরজায় কেউ এতবার টোকা দিচ্ছে, নিকিতা টের পায়নি।

নিকিতার চাচি একটু ধমকের সুরেই ডাক দিলেন, কানে কি তুলা দিয়েছ নাকি যে শুনতে পাচ্ছ না?

নিকিতা ভেজা চোখটা নিমেষেই মুছে ফেলে দরজা খুলে দিল।

: কী করছিলে ভেতরে? এতবার ডাকছি, শুনছ না?

নিকিতা শান্ত স্বরে জবাব দিল, চাচি খেয়াল করিনি। সারা দিনের ধকলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

: তোমার তো দেখাই পাই না। সকালে বের হয়ে যাও আর আস রাতে। এসেই দরজা বন্ধ। বাড়িতে যে আরও মানুষ আছে, তাদেরও যে খোঁজ খবর নিতে হয়, সেটা কি শিখিয়ে দিতে হবে?

নিকিতা চুপ করে শুনল। কিছু বলল না। চাচা-চাচির দুর্ব্যবহারে নিকিতা অতিষ্ঠ! সামনে পড়লেই রকির প্রসঙ্গ। আর ভালো লাগে না। নিকিতা ঠিক করেছে একটা বাসা নেবে। যে কোম্পানিতে চাকরি করে সেই কোম্পানির কাছেই বাসা নেবে। আর কারও কাছে বোঝা হয়ে থাকবে না।

: কী চুপ করে আছ কেন? শোন যে কথা বলতে এসেছি। তুমিতো এতিম। আমরা ছাড়া তোমার আর কে আছে? আমরা চেয়েছিলাম রকির সঙ্গে তোমাকে বিয়ে দিয়ে ঘরের মেয়ে ঘরেই রেখে দেব। তুমি তো বেঁকে বসলে। তোমার চাচা মনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমার রকি যদিও একটু নেশা করে কিন্তু তোমাকে ওর ভীষণ পছন্দ! আমার বিশ্বাস তোমাদের বিয়ে হলে রকি এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তোমার চাচা আর আমি আমি ঠিক করেছি আগামী রোববার তোমাদের বিয়ে দিয়ে দেব। এখানকার একটা কনভেনশন হলে বুকিংও দিয়ে দিয়েছি। পরিচিতদের নিমন্ত্রণ করে ফেলেছি।

নিকিতা আকাশ থেকে পড়ল।

: আমার বিয়ে রোববার? মানে কী? চাচি আমার মত না নিয়েই কী করে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন?

: তোমার আবার কীসের মত? ভুলে যেও না আমরাই তোমাকে জাপানে এনে পড়াশোনা করিয়েছি। আমাদের কারণেই আজ তুমি এখানে অর্থ উপার্জন করছ। তা না হলে কোথায় বাংলাদেশে মামার গ্রামের বাড়িতে পড়ে থাকতে। এত দিনে বিয়ে হয়ে বাচ্চার মা হয়ে যেতে।

নিকিতার চোখ ছলছল করে উঠল।

: চাচি আমাকে জোর করে আপনারা বিয়ে দিতে পারেন না। আমি রকিকে বিয়ে করতে পারব না।

নিকিতার কথা শুনে নিকিতার চাচা পাশের রুম থেকে ছুটে আসলেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, এত দিন তোমার সবকিছু আমরা সহ্য করেছি। আর না। তোমার বাবা বেঁচে নেই। তার অবর্তমানে আমরা তোমার লোকাল গার্ডিয়ান। আমাদের সিদ্ধান্তই তোমাকে মেনে নিতে হবে।

নিকিতা হুংকার দিয়ে উঠল, আমি পুলিশের কাছে যাব। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমরা কিছুই করতে পারবে না।

চাচি এসে নিকিতার মুখোমুখি দাঁড়াল। বললেন, পুলিশের কাছে যাবি? তোর এত বড় সাহস? বেইমান! নিমক হারাম! তোকে দেশ থেকে এখানে এনে পড়াশোনা করিয়েছি এদিন দেখার জন্য? নিজের চাচাকে পুলিশে দিবি?

নিকিতার চাচা সামনে এগিয়ে এসে বললেন, আগামী রোববার তোমার বিয়ে। মানসিকভাবে প্রস্তুত থেকো।

চাচা-চাচি চলে গেলেন। নিকিতা নীরবে দরজাটা লাগিয়ে দিল। জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। আঁধার ভেদ করে সাদা তুলার মতো তুষারকণা উড়ে বেড়াচ্ছে। নিকিতার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিকিতা জানে চাচার বিরুদ্ধে কখনো সে পুলিশের কাছে যেতে পারবে না। তারা ওকে আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু রকির মতো ছেলেকে বিয়ে করাও অসম্ভব!

পুরোটা রাত কেঁদেছে নিকিতা। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। রাতে তুষারপাত হওয়ায় পুরো রেলস্টেশনের চারদিক তুষারের ছোঁয়ায় শুভ্র বরণ ধারণ করে আছে। নিকিতা অপেক্ষায় আছে সেই মানুষটির জন্য যে কিনা ওর দুঃখ ভরা জীবনে একটু হলেও সুখের পরশ বুলিয়ে দেয়। কিন্তু আজও সে আসেনি। আজও নিকিতার মনে হাজারো প্রশ্ন! কেন সে এল না? মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিল। কেন সে দুই বছরে একটি বারের জন্যও ছেলেটির সঙ্গে কথা বলেনি। কেন সে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেনি। অন্তত, বন্ধুত্ব করলে আজ তার একটা খোঁজ নেওয়া যেত।

পরপর ছয় দিন পার হয়ে গেল। সে এল না। এই ছয়টা দিন নিকিতা বুঝতে পেরেছে, মনের অজান্তেই সে ভিনদেশি তারাকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে। শনিবার, রোববার নিকিতার ছুটি। তবুও শনিবার নিকিতা রেলস্টেশনে গিয়েছে। কিন্তু ছেলেটি আসেনি। এদিকে নিকিতার বিয়ের সব প্রস্তুতি শেষ। রোববার বিয়ে। নিকিতা কী করবে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। রকির মতো মাতালকে বিয়ে করার চেয়ে মরে যাওয়াও অনেক ভালো।

রোববার। নিকিতার জীবনে সবচেয়ে ভয়াবহ দিন হয়তো আজ। সকাল থেকে চাচি চিৎকার চেঁচামেচি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছেন। তুষারপাতের পরিমাণ আজ আরও বেড়েছে। নিউজে জাপানের বিভিন্ন স্থানে তুষারপাতে আটকে যাওয়া রাস্তাঘাট দেখাচ্ছে। নিকিতার চাচা–চাচি এই দুর্যোগেও বিয়ের আয়োজন করেছেন। হল ভাড়া করেছেন। নিমন্ত্রিত অতিথিরা বিয়েতে আসতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে চাচির মাথা খারাপ হয়ে আছে। নিকিতা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির কাছে শুধু এটুকু প্রার্থনা করছে, যেখানেই থাকুক, সে যেন ভালো থাকে। যে ভালোবাসা কখনো প্রকাশিত হয়নি সে ভালোবাসার প্রতীক্ষাও বেমানান। আরেক ভিনদেশি মানুষ তার জন্যই বা কেন প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকবে? নিকিতার বুক ভরা নীরব আর্তনাদের শব্দ দেয়াল ভেদ করে তার কাছে পৌঁছবে না।

সন্ধ্যায় নিকিতার চাচি খুব সুন্দর কারুকাজ করা সাদা রঙ্গের একটা ওয়েডিং গাউন নিয়ে এলেন। রকির খুব ইচ্ছে নিকিতা বিয়েতে ওয়েডিং গাউন পরবে। এ পোশাকে নিকিতাকে পরির মতো সুন্দর লাগবে। নিকিতা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে নিজেকে দেখল। সত্যিই নিকিতাকে শুভ্র বসনে অপূর্ব সুন্দরী কোনো স্বর্গের দেবী মনে হচ্ছে। নিকিতা তাকিয়ে আছে অপলক। কল্পনার জগতে হানা দিয়েছে নাম না জানা সেই ছেলেটি। ঝিরিঝিরি তুষারের মাঝে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। যেন কল্পলোকের কোনো রাজপুত্র রাক্ষসপুরী থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে এসেছে। নিকিতা হাত বাড়িয়ে দেয়। এমন সময় রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করে মাতাল রকি। বিয়ের সাজে নিকিতাকে দেখে রকির পাগল হওয়ার উপক্রম। অনুমতি না নিয়ে নিকিতার রুমে ঢোকায় নিকিতা রকির ওপর মনঃক্ষুণ্ন হয়। রকিকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বললে রকি ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়। নিকিতাকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় রকি উন্মাদ হয়ে ওঠে। মাতাল রকি যখন ধীরে ধীরে নিকিতার কাছে তার অতৃপ্ত বাসনা মেটাতে এগিয়ে আসছিল, তখন নিকিতা কৌশলে রকিকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়। নিকিতার চাচা-চাচি আগেই সেন্টারে চলে গিয়েছিলেন। রকির কথা ছিল হবু বধূকে নিয়ে বিয়ের আসরে পৌঁছাবে। কিন্তু রকির নোংরা লালসার কথা হয়তো কেউ কল্পনাও করতে পারেননি।

শুভ্র বসনে শুভ্র সাদা তুষারপাতের মধ্য দিয়ে ছুটছে নিকিতা। দুই চোখ ভরা সাথিহারা তীব্র বেদনার জল। গন্তব্য শাকে স্টেশন। হৃদয়ে শুধু একটাই প্রত্যাশা, জীবনে যে প্রথম প্রেমের আবেদন জাগিয়েছে, তার জন্য মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রতীক্ষা করার প্রতিজ্ঞা! নিকিতা জানে না, নাম না জানা সেই ভিনদেশি তারা আর ফিরবে কিনা কিন্তু নিকিতা রেলস্টেশনে তার জন্য প্রতীক্ষা করবে।

হু হু করে বাড়ছে তুষারপাতের পরিমাণ। রাতের আঁধার ভেদ করে তুষারকণা যেন দিনের আলোর মতো প্রতিচ্ছায়া ফেলছে। টিভিতে খবরে বিভিন্ন এলাকায় তুষারপাতের খবর প্রচার করছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সাবধান ও নিরাপদ স্থানে থাকবার জন্য সতর্কবাণী শোনানো হচ্ছে।

নিকিতা পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে সেই স্থানটিতে যে স্থানে ছেলেটি বসত! জীবনে আজ সব চাওয়াই বুঝি ফুরাল। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছে। একটা এতিম মেয়ে বুকে হাজারো কষ্ট লুকিয়ে কোনোরকমে বেঁচে ছিল কিন্তু আজ যাকে সে নিঃসঙ্গ হৃদয়ে স্থান দিয়েছে সেই হারিয়েছে কোনো অজানায়। আর কী কোনো দিনও দেখা হবে না তার সঙ্গে? সে কী কোনো দিনও জানবে না নিকিতা তাকে কতটা ভালোবাসত? নিকিতার দুই চোখ বেয়ে নীলকষ্টের নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। নিকিতা দুই চোখ বন্ধ করে ফেলল।

এ সময় হঠাৎ ভাঙা ভাঙা বাংলায় কেউ একজন বলে উঠল, তোমার কষ্টগুলো আমায় দেবে?

নিকিতা চমকে উঠল! চোখ খুলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেই ছেলেটার দিকে। ছেলেটি হাত বাড়িয়ে আছে নিকিতার চিবুকের নিচে। হাতের তালুতে নিকিতার চোখেরই দুফোঁটা জল টলমল করছে।

নিকিতা আর্দ্র চোখে ছেলেটির চোখের দিকে তাকাল। মনে হাজারো প্রশ্ন!

ছেলেটি আলতো করে নিকিতার দুই হাত চেপে ধরল।

: আমি আকিহিকো। আমার বাবা ছিলেন জাপানিজ, মা বাংলাদেশি!

নিকিতা এই প্রথম ছেলেটির নাম জানল। ছেলেটির চোখ দেখে পুরোপুরি জাপানিজ মনে হয়নি কখনো। কিন্তু ওর মুখে বাংলা শুনে নিকিতা অবাক!

: মা আমাকে রাজপুত্র ডাকতেন, তাই বাবা আমার নাম রেখেছিলেন আকিহিকো। বাবা আমি ছোট থাকতেই মারা যান। এরপর মা তার সর্বস্ব দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছেন। আমি বাংলা বুঝতাম কিন্তু বলতে পারতাম না। বাংলা ভাষা শেখার প্রতি তেমন আগ্রহ আমার কোনো দিন ছিল না। আমার মা ছিলেন এতিম। এক জাপানিজ নিঃসন্তান দম্পতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর আমার মাকে দত্তক নিয়ে জাপানে চলে আসেন। মার কাছে বাংলাদেশের কথা অনেক শুনেছি। বাবা মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বাবা খুব তাড়াতাড়ি মা আর আমাকে রেখে পরপারে পাড়ি জমান। বাবার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে মা আমাকে নিয়ে সারা জীবন জাপানেই থেকে গেলেন। বাংলাদেশে আর কোনো দিন ফেরা হয়নি।

আকিহিকো থামল।

নিকিতা মৃদু স্বরে বলল, তারপর?

: তোমাকে যেদিন প্রথম দেখি সেদিনই তোমাকে আমার ভালো লেগে যায়। তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম তুমি বাংলাদেশি। তোমাকে ফোনে একদিন বাংলায় কথা বলতে দেখে আরও নিশ্চিত হই। ধীরে ধীরে তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। তোমার আমার প্রতিদিনের আঁখি মিলনে অন্তত এইটুকু বুঝতে পারি, মনের অজান্তে আমরা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছি কিন্তু প্রকাশ করতে পারছি না। একটা মেয়ে নিজে থেকে এসে আমাকে প্রস্তাব করবে না। ছেলে হিসেবে আমারই আগে হাত বাড়াতে হবে। কিন্তু আমি যে বাংলা জানি না? তুমি জাপানি ভাষা জান। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে আমি তোমার ভাষায় ভালোবাসার কথা বলব। তাই মায়ের কাছে বাংলা ভাষা শেখা শুরু করলাম। মাকে তোমার কথা বললাম। আমি বাঙালি মেয়ে বিয়ে করতে চাই শুনে মা ভীষণ খুশি হলেন।

আমি বাংলা ভাষা শিখলাম কিন্তু মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হাসপাতালে ভর্তি করলাম। অবস্থার অবনতি হলো। অফিস থেকে ছুটি নিলাম। মাকে বাঁচাতে প্রাণপণে চেষ্টা করলাম কিন্তু মা...! আকিহিকো ডুকরে কেঁদে উঠল। দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল।

নিকিতা আকিহিকোর চিবুকের নিচে হাত রাখল। নিকিতার হাতের তালুতে দুফোঁটা জল টুপ করে এসে পড়ল। নিকিতা পরম আবেগে আকিহিকোকে বলল, তোমার কষ্টগুলো আমায় দেবে?

উত্তরে আকিহিকো নিকিতাকে বলল, দেব, যদি তোমার মনটা আমায় দাও!

জবাবে নিকিতা বলল, আগে বলো, আমি এখানে সেটা তুমি কী করে জানলে?

: মা চলে যাওয়ার পর আরও দুদিন অফিসে যাইনি। তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ছিল। তুমিও যে আমাকে খুঁজছ, সেটা আমার মন বলছিল। গতকাল থেকে তুষারপাতের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। রাতে তোমায় স্বপ্ন দেখলাম। সকালে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। আজ ছুটি তারপরও স্টেশনে এসে বসে আছি। আমার মন বলছিল তুমি আসবে। তুমি যেখানটায় বসতে আমি সেখানেই বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম বিয়ের পোশাকে তুমি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এসে আমার জায়গায় বসেছ। আমাকে তুমি খেয়াল করোনি।

: এত তুষারপাতের মধ্যে সকাল থেকে তুমি আমার জন্য বসেছিলে? আমাকে তুমি এত ভালোবাসো আকিহিকো? নিকিতা কেঁদে ফেলল।

আকিহিকো দুহাত দিয়ে ভালোবাসার স্পর্শে নিকিতার দুই চোখ মুছে দিয়ে বলল, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমি আমাকে ভালোবাসতো?

আকিহিকোর মুখে বাংলায় ভালোবাসার কথা শুনে নিকিতা জাপানি ভাষায় বলল, আই শিতেই মাস্ (আমি তোমাকে ভালোবাসি)।

দুজন পরস্পরকে পরম মমতায় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল।

রাতের আঁধারে ঝিরিঝিরি তুষারকণাগুলো যেন জোনাক পোকার মতো আলোর মশাল জ্বালিয়ে দুজন কপোত-কপোতিকে শুভকামনা জানাল। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা উজ্জ্বল তারাগুলো মুচকি হেসে ভালোবাসার যুগলবন্দীকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করল।
...

শাহীন আক্তার স্বাতী: কানাগাওয়া কেন, জাপান।