আমি তো দেখেছি কত যে স্বপ্ন...
প্রবাসের অনেক সংসারে বিদেশি বধূ রানি হন! কিন্তু অনেক দেশি স্বামী প্রবাসে রাজা হন না! রাজ্যে রাজা না থাকলে কেউ রানি হতে পারেন কি? রাজ্যের মানুষ তা ভালো জানেন। কথায় আছে, বুদ্ধিমান নারীরা স্বামীকে রাজা বানিয়ে নিজে রানি সাজেন। অনেক তরুণী সংসারে স্বামীকে রাজা মানতে না পারলে তাঁরা রানি না দাসী হন, তা প্রবাসের সমাজ-সংসারের ওপর যাঁরা পর্যবেক্ষণ রাখেন, তাঁরাই ভালো বলতে পারেন। প্রবাসের সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ, অশান্তি, সন্দেহের আগুন জ্বলে ওঠার পেছনে অধিকার, স্বাধীনতা ও ভোগ-বিলাসী জীবনযাপন ক্রিয়াশীল। একচ্ছত্র অধিকার আর ভোগ-বিলাসে মগ্ন থাকা নিয়ে অনেকের সুখের সংসারে দুঃখের দাবানল জ্বলে ওঠে। জ্বলেপুড়ে ছারখার হয় সোনার সংসার। সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার ভাষায় আমার কৈফিয়তের জায়গা থেকে বলি, ‘আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই!’ সংসারে স্বামী-স্ত্রীর অসম প্রতিযোগিতার বিরোধ, একক ভোগ-বিলাসে মগ্ন থাকা ও একে অন্যের ন্যায্য অধিকার হরণের ঘটনা হৃদয়বান সবার হৃদয় স্পর্শ করে। নিষ্পাপ-নিরপরাধ শিশুসন্তানদের অনাথ আশ্রমে পাঠাতেও কোনো কোনো পিতা-মাতার হৃদয় কাঁপে না। অনাথ আশ্রমে ঠাঁই নেওয়া শিশুসন্তানের জন্য পিতা-মাতার হৃদয়ে আঘাত লাগে না। যে শিশুসন্তানেরা পিতা-মাতার স্নেহচ্ছায়া-ভালোবাসায় হেসেখেলে আনন্দ-হাসিতে বেড়ে ওঠার কথা, তাদের বেঁচে থাকার ঠাঁই হয় সিটির সরকারি নিরাপদ শিশু আশ্রয়কেন্দ্রে। এতে অনেকেই অমানবিক অন্যায় মদদ জোগান।
বাংলার সুন্দরী তরুণী যুগলবন্দী হয়ে, প্রিয়তম স্বামীর সঙ্গে রঙিন স্বপ্ন দেখে স্বপ্নের দেশে আসে। প্রবাসজীবনে সংসার শুরুর পর একদল মানুষ তরুণী বধূ ও স্বামীর দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে খুঁত খোঁজেন, আঘাত করতে সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। খুঁত ধরা স্বভাবের স্বজনদের কারণে-অকারণে নববধূকে দোষারোপ ও জ্বালাতনের কুশলী হয়ে উঠতে বিবেকে বাধে না। দেশ থেকে আসা অনেক তরুণী বধূ বা উদ্যম স্বামীর জীবনের সুখের গল্পের আড়ালে দুঃখের দহনে মনভাঙার খবরে নিন্দুকেরা অট্টহাসি দিয়ে সুখ পায়। উচ্ছল আত্মমর্যাদাশীল সাহসী যুবক বা উচ্চশিক্ষিত তরুণীরা যখন অভিমানে মুখ ভার করেন, তখন তাঁদের নিগৃহীত হয়ে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে সময় লাগে না। তরুণী বধূ বা নবযুবকের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে আশপাশের দুষ্টুবুদ্ধির লোকজনের বিবেকে বাধে না।
গত বছর নিউইয়র্কের রাস্তায় দেশ থেকে আসা এক নববধূর কান্না অনেক পথচারীর হৃদয়ও স্পর্শ করে। গ্রামের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা প্রাণোচ্ছল শিক্ষিত তরুণী বধূ প্রবাসের সংসারে রানি হতে পারেন না। রঙিন স্বপ্ন ডানা মেলার আগেই দুঃস্বপ্নে পতিত হয়। অকালে ঝরে যায় স্বপ্নের মুকুল। হৃদয়বান কোনো মানুষ এমন অমানবিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর তিনি ‘আমি তো দেখেছি কত যে স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে যায়/ শুকনো পাতার মর্মরে বাজে কত সুর বেদনায়/ আকাশে-বাতাসে নিষ্ফল আশা হাহাকার হয়ে রয়’ গানের পঙ্ক্তিগুলো গেয়ে উঠতে ভুল করবেন না।
সম্প্রতি নিউইয়র্কে একাধিক নারীর আত্মহত্যার পেছনে পারিবারিক অশান্তি-অস্থিরতা, পরস্পরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস, নির্যাতনের বিষয় বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিদেশি বধূ স্বামীর সংসারে রানি হলেও স্বামীর বাড়ির আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে রানির আদর-আপ্যায়ন থেকে বঞ্চিত হওয়ার খবর অনেকের মুখে শোনা যায়। কবিতার ভাষায় বলি, ‘রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানি, রানির দরদে ধুইয়া গেছে রাজ্যের যত গ্লানি।’ প্রবাসের সংসারে বিদেশি বউরানির আদর-সোহাগ-ভালোবাসার আঁচলে স্বজনদের গ্লানি মুছে দেওয়ার তালিম জানা নেই। দম্ভ-অহমিকা ও সংকীর্ণ চিত্ত ত্যাগ করতে না জানলেও চলনে-বলনে-পোশাকে আধুনিক হতে অনেক নারী ভুল করেন না। ওপার বাংলার স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, জি বাংলায় ‘সাত পাকে বাঁধা’ সিরিয়াল দেখা অনেক আমুদে মেয়ে দুষ্টুর কবলে পড়েছেন কি না? ‘কিরণমালা’র পৌরাণিক চরিত্রগুলো টিভির পর্দা থেকে সংসারে মঞ্চস্থ হচ্ছে। সংসারের ঝগড়াঝাঁটি, সন্দেহ, অবিশ্বাস, স্বার্থের দ্বন্দ্বে পারিবারিক বন্ধন অটুট থাকছে না। স্ত্রীর সন্দেহের চোখ স্বামীর ওপর। স্ত্রীর ওপর সন্দেহ স্বামীর। ভাই ভাইয়ের শত্রু, ভাই বোনের শত্রু, আবার ভাই-বোন-ভাবি মিলে অন্য সহোদরদের বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র চক্রান্তের দৃশ্য দেখতে এখন টিভির সামনে আসতে হয় না।
প্রবাসে অনেক নারী-পুরুষ উচ্চশিক্ষায় বাঙালি সমাজের মুখ উজ্জ্বল যেমন করেছেন, তেমনি মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণাও জুগিয়েছেন। সংসারজীবন ও সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলতে একজন স্ত্রী, একজন মা হিসেবে কঠিন সংগ্রামী দায়িত্ব পালন করে সুনাম অর্জন করেছেন। তাই বলে কিছু নারী-পুরুষের সাংসারিক ও ব্যক্তিজীবনের ঔদ্ধত্যমূলক কর্মকাণ্ডের দায় সব নারী-পুরুষের ওপর বর্তায় না। এর দায়ভার সবার নয়।
লেখক: সাংবাদিক, নিউইয়র্ক।