আমি তো আছি

‘কেমন আছ?’
—‘আছি’। শাহেদের প্রশ্নের জবাবে নিতুর ছোট্ট উত্তর। তবে এই উত্তরে বুকের তৃষ্ণা মেটে না। কেমন যেন হাহাকার ওঠে। মনে হতে থাকে নিতু বুঝি এড়িয়ে যেতে চায়। আবার কখনো মনে হয়, না তেমনটি নয়। নিতু তাকে ভালোবাসে। তার হৃদয় মন সবই শাহেদের জন্য। কিন্তু ঠিক পরিষ্কার করে কথা বলে না নিতু। মনের গভীরে কী ঘটছে জানা যায় না। বোঝা যায় না। মেঘটাকে ঢেকে মুখে তার হাসি। তার মনের গোপন ঘরে শাহেদের জন্য এক টুকরো জায়গা কি শেষ পর্যন্ত হয়েছে, বোঝা যায় না।
‘আছি, কেবল এটুকুই। ভালো আছ, নাকি মন্দ?’-শাহেদের প্রশ্ন।
—‘ভালো মন্দের হিসাব করছি না। জীবনের সব সিদ্ধান্ত তো আমার হাতে না। তুমি ভালো আছ তো?’ নিতুর প্রশ্নে শাহেদের কষ্ট বাড়ে। সে বুঝতে পারে না, এই মেয়েটাকে ছাড়া কী করে সে ভালো থাকতে পারে। সব বুঝেও কেন এমন প্রশ্ন করে নিতু। সে কি বুকের ভেতরে পাথর বেঁধেছে?
‘তোমাকে ছাড়া কী করে ভালো থাকি নিতু? তুমিই বলো!’
—‘কিন্তু আমাকে ছাড়াই তোমাকে জীবনের বাকি পথ ভাবতে হবে। আমরা কেবল বন্ধু, এর চেয়ে বেশি কিছু না। কখনো ছিলামও না।’ নিতুর উত্তর।
শাহেদ বলে, ‘কেবল বন্ধু! কোনো ভালাবাসাবাসি নেই? একটু বেশি কি আমি হতে পারতাম না?’
—‘না। পারতাম না। তবে তুমি বোধ হয় বেশি কিছুই ভেবেছ। ভুল করেছ। ইউনিভার্সিটির দিনগুলোয় আমরা এক সঙ্গে ছিলাম। ঘুরেছি, ক্লাস করেছি। কত হাসি আনন্দের দিন ছিল। কিন্তু তুমি কোনো দিন মুখ ফুটে বলোনি, ভালোবাসো। তা ছাড়া বাবাকে তো জানোই, অনেক রাগী মানুষ। তিনি চান তাঁর বন্ধুর ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হোক। গত মাসে বাবার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তাই বাবাকে কষ্ট দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি ভালো থেকো।’
নিতুর কথায় এক ধরনের কাঠিন্য। কানের ভেতর দিয়ে গরম কিছু একটা ঢুকে যাচ্ছে। শাহেদের মাথা দুলতে থাকে। সে কোনো দিন ভাবেনি, এমনটা হবে। সে অনেকটা নিশ্চিত ছিল, নিতু তাকেই ভালোবাসে। যদিও তারা ছিল বন্ধু। যদিও কেউ কখনো ‘ভালোবাসি’ কথাটি বলেনি।
শাহেদ বলল, ‘দেখো নিতু। তুমি বলছ, আমরা কেবল বন্ধু। এ ছাড়া তুমি কষ্টও পেতে চাও না। ভালো কথা। তোমাকে একদম কষ্ট পেতে হবে না। যুদ্ধটা যেহেতু আমার তাই সেটা আমাকেই শেষ করতে হবে। বন্ধু হলেও ভালোবাসার যুদ্ধ আমরা দুজন এক সঙ্গে শুরু করিনি। তাই তোমাকে মুক্তি দিলাম। আর আমাদের দেখা হবে না, কথা হবে না, মৃত্যু হবে না, ছায়া হবে না।’
শাহেদের কথায় চুপচাপ নিতু। ওপাশ থেকে কেবল একবার দীর্ঘ একটা নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া যায়। ফোনটা কেউ কেটে দেয় না। অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়, তবুও দুজনের কেউ কোনো কথা বলে না। কারও মুখে কোনো কথা নেই। শাহেদের মাথা টন টন করছে। নীরবে চোখের পানি ফেলে নিতু। কারণ শাহেদকে সে বলতে পারে না, আসলে তাকে কতটা ভালোবাসে সে।

দুই.
নিতুর বাবা সোবহান সাহেবের অবস্থা ভালো না। খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার ভয় যেকোনো সময় হয়তো মরে যাবেন। তাই মেয়েটাকে দ্রুত বিয়ে দিতে চান। বন্ধু জয়নালের ছেলে একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। ফ্ল্যাট-গাড়ি সবই আছে। ছেলেটাও বেশ ভালো। ভদ্র, মার্জিত। নিতুকে দেখে পছন্দ করে গেছে। তবে এখনো বিয়ের কথা পাকাপাকি কিছু হয়নি। দুই পরিবারের মধ্যে ভেতরে-ভেতরে কথা হচ্ছে। অনেকটা ভেঙে পড়েছে নিতু। শাহেদের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে নিজের জন্যও। কারণ শাহেদকে নিতুও খুব ভালোবাসে। অথচ কখনোই বলা হয়নি। বলা হবে না। ছেলেটা জানল নিতু নামের মেয়েটা কেবলই তার বন্ধু ছিল। কখনোই ভালোবাসেনি। এই যন্ত্রণা সে কোথায় রাখবে!
সেদিনের পর সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেছে। একবার মাত্র এসএমএস আদান-প্রদান হয়েছে। নিতু জানতে চেয়েছিল, ‘কেমন আছ?’
ওপাশ থেকে জবাব এল, ‘কিছু বলতে চাইছি না। আমি আর কখনোই কিছু বলব না।’
নিতুর বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠল। কষ্ট উথলে উঠল। আবেগের ঢেউ আছড়ে পড়ল হৃদয়ের তীরে। কী এক তীব্র যন্ত্রণা। কিছু ভালো লাগছে না। কষ্ট, কষ্ট আর কষ্ট। ছেলেটারও নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে। কেন এমন হয়? মানুষ যা চায়, তা কেন পায় না? প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগে। কোনো উত্তর পায় না। কোনো উত্তর হয়তো নেই।

তিন.
শাহেদের অবস্থা অনেক খারাপ। ঘুম নেই। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। কয়েক দিন হয়ে গেল অফিসেও যাচ্ছে না। নিতুকে হারাতে হবে কিছুতেই ভাবেনি সে। অনেকটা নিশ্চিত ছিল তারা দুজনে ঘর বাঁধবে। কীসের অভাব তার? ভেবে পায় না। লোকে বলে সে নাকি দেখতে সুন্দর, স্মার্ট। লেখাপড়া শেষে বাবার ব্যবসায় হাল ধরেছে। বেশ সফল। নতুন বাড়ি করেছে ধানমন্ডিতে। ভেবেছিল, বাড়ির কাজ শেষ হলেই নিতুকে নিজের ভালো লাগার কথা বলবে। বাড়ির কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু নিতু তত দিনে পর হয়ে গেছে। থেকে থেকে খুব খারাপ লাগে। বাড়ি, টাকা, ব্যবসা সব অনর্থক লাগে। খাবারে রুচি উঠে গেছে। পানিও বিস্বাদ লাগে।
এই মুহূর্তে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে গাছের নিচে বসে আছে সে। ছোট ছোট ইটের টুকরো নিয়ে পানিতে ছুড়ে মারছে। পানি দুলে উঠছে। তৈরি করছে এক ধরনের তরঙ্গ। ইটের টুকরো পানিতে ডুবে না গিয়ে কেমন ছুটে ছুটে যাচ্ছে কিছু দূর। অনেকবারই নিতুকে নিয়ে এখানে এসেছে শাহেদ। এমন খেলায় খুব আনন্দ পেত নিতু। রীতিমতো শিশুদের মতো হাতে তালি দিয়ে উঠত। আর একটা খেলা ছিল তার খুব প্রিয়। বন্দুক দিয়ে ফেলুন ফোটানো। নিতুর ভালো লাগে জেনে এই খেলা বারবার খেলত শাহেদ। হাতের নিশানাও বেশ ভালো। তাই নিতুর সামনে নিজেকে বেশ বাহাদুর বাহাদুর লাগত। ওই তো একটু দূরে বন্দুক আর বেলুন সাজিয়ে লোকটা বসে আছে। কিন্তু শাহেদের সেখানে যেতে মন চাইছে না। তাকে কোনো কিছুই টানছে না আর। এই জীবনটাকে কীভাবে বয়ে বেড়ানো সম্ভব, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। কেবল নিতুর কথা মনে পড়ছে। একবার ভাবে বাবা-মাকে পাঠাবে নিতুদের বাড়িতে। কিন্তু পরেই মনে হয়, নিতু যদি না চায়, তাহলে কীভাবে হবে? পাঠিয়ে কী লাভ? আশা হারিয়ে ফেলে। দূরের আকাশে তাকায় শাহেদ। হঠাৎ করে মেঘ জমতে শুরু করেছে। অদ্ভুত শব্দে আকাশ ডাকছে। চারপাশ অন্ধকার করে হঠাৎ বৃষ্টি নামল। মানুষজন বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছুটোছুটি করতে থাকল। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই শাহেদের। বৃষ্টিতে ভিজে গেল সমস্ত শরীর। তবুও অশান্ত মন শান্ত হলো না। বাড়ল হৃদয়ের জ্বালা। এমন বৃষ্টির দিনে নিতুর সঙ্গে অনেকগুলো দিন কেটেছে। ভালো করে হাত ধরা হয়নি। ঠোঁটে ঠোঁট রাখা হয়নি। বলা হয়নি ভালোবাসি। অথচ দুজন মিলে ভিজে একাকার হয়েছে। কী সেই সব দিন। তারা কেন এমন ছিল? অনেক ক্ষোভ জন্মে শাহেদের মনে। সে বিড়বিড় করে বলতে থাকে—
‘ভালো থেকো তুমি
হৃদয়ের ভূমি
ভালো থেকো।’

চার.
মেয়েটা বেশি মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ায় ইদানীং। সোবহান সাহেবের ভালো লাগে না। তিনি স্ত্রী রাহেলাকে ডেকে কাছে বসান। জানতে চান, ‘মেয়েটার কী হয়েছে বলো তো?’
রাহেলা জানায়, ‘কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। যে চাপা স্বভাবের মেয়ে তোমার। কিছু তো বলে না।’
সোবহান সাহেব জানতে চান, ‘ও কি এই বিয়েতে খুশি না? নিতু কি কাউকে পছন্দ করে?’
—‘জানি না তো। কখনো বলেনি। তবে শাহেদ নামে একটা ছেলের সঙ্গে ঘুরত। ওরা দুই বন্ধু। কখনো শুনিনি বা বুঝিনি ওদের মধ্যে বিশেষ কিছু হয়েছে। আমার মনে হয় সব ঠিক আছে। তুমি অহেতুক ভাবছ।’
‘না, আমি ঠিকই ভাবছি। আমি আমার মেয়েকে চিনি। মনে হচ্ছে কোথাও একটা গন্ডগোল হচ্ছে। তুমি ওকে ডাকো। ও অসুখী হলে, আমি মরেও শান্তি পাব না।’-সোবহান সাহেবকে খুব উদ্বিগ্ন দেখায়। রাহেলা উঠে গিয়ে নিতুকে ডেকে নিয়ে আসেন।
—‘আয় মা, বাবার কাছে আয়।’ সোবহান সাহেব মেয়েকে ডেকে কাছে বসান। প্রশ্ন করেন, ‘তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন মা?’
নিতুর চোখ ফোলা। লাল হয়ে আছে। মনে হয় অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছে। কিন্তু মুখে তেমন কিছু বলছে না।-‘আমি ঠিক আছি বাবা।’
—‘মা রে, তুই ঠিক নেই। বাবা হয়ে এটা তো বুঝি। তোর যদি কিছু বলার থাকে বাবাকে বল। কারণ আমি তোর শান্তি চাই।’
বাবার কথায় চমকে ওঠে নিতু। এই বাবা ছিলেন ভীষণ রাগী আর একরোখা। তিনি যা বলবেন, তার ওপর আর কোনো কথা নেই। বন্ধুর ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক, মানে সেটাই চূড়ান্ত। তিনি কিনা বলছেন, অন্য কথা! আসলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর অনেকটাই বদলে গেছেন বাবা। তাই বলে এতটা! ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেল নিতু। চিন্তা করতে থাকে, বাবাকে কি তবে সব খুলে বলবে?
—‘কী হয়েছে মা, বল।’
নিতু চুপচাপ। কোনো কথা বলে না। বাবা তার স্নেহের হাত বুলিয়ে দেন মেয়ের মাথায়। চোখের বাঁধ ভেঙে যায় তার। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। মা রাহেলা এসে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন মেয়েকে। এভাবেই কেটে যায় কিছুটা সময়। একটু পর শান্ত হয়ে আসে নিতু। অনেক কষ্টে জানতে চায়, ‘বাবা এই বিয়েটা না করলে তুমি কি খুব রাগ করবে?’
সোবহান সাহেব অসুস্থ শরীরেও উচ্চ স্বরে হেসে ওঠেন। বলতে থাকেন, বিয়ে বাদ। তুই কি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাস?
নিতু কান্নার সঙ্গে হাসি মিশিয়ে অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করল। বলল, ‘শাহেদকে।’

পাঁচ.
‘কেমন আছ?’-নিতুর এমন প্রশ্নে নিরুত্তর শাহেদ।
‘বলবে না কেমন আছ?’-আবারও প্রশ্ন।
—‘ভালো আছি, সুখে আছি, বেঁচে আছি।’-শাহেদের উত্তর।
‘তুমি কি নিতুকে বিয়ে করতে চাও?’-এমন প্রশ্নে এবার চমকে ওঠার পালা। কী শুনছে এসব। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না সে। চুপচাপ। নিরুত্তর। কেবল বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। টেলিফোনের ওপার থেকে কোনো শব্দ ভেসে আসছে না। ‘তুমি কি নিতুকে বিয়ে করতে চাও, উত্তর দাও।’-তাগাদা দেয় নিতু।
—‘চাই, খুব চাই।’-বলে ছেলে মানুষের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠল শাহেদ। নিতু অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই থামাতে পারছিল না তাকে।
‘এই ছেলে এভাবে কাঁদছ কেন, আমি কোথাও যাচ্ছি না। তোমারই থাকছি। বন্ধু থেকে জীবন সাথি হয়ে। আরও ভালো বন্ধু হয়ে।’
নিতুর কথা যেন কানে ঢুকছে না শাহেদের। সে কিছু বুঝতে চাইছে না। এবার নিতু ধমক দেয়, ‘শাহেদ, শোন। থামো বলছি। আমি তো আছি।’
একটু থেমে কান্নার বদলে শব্দ করে হেসে ওঠে শাহেদ। আনন্দের হাসি। তার সঙ্গে যোগ দেয় নিতু। এই পৃথিবীতে যেন কোনো দুঃখ নেই। শাহেদ বলে, ‘তুমি আছ?’
উত্তর আসে, ‘আমি তো আছি।’