আমি গর্বিত বাংলাদেশি বলে

পাহাড়ের মাথায় মেঘের ভেলা, নিচে পিয়াইন নদ। ছবি: আনিস মাহমুদ
পাহাড়ের মাথায় মেঘের ভেলা, নিচে পিয়াইন নদ। ছবি: আনিস মাহমুদ

দুই মাস আগের ঘটনা। আমি মেয়েকে নিয়ে বাসার পাশের পার্কে বেড়াতে গিয়েছি। সেদিন মঙ্গলবার আর দুপুরবেলা হওয়ায় পার্ক প্রায় ফাঁকা। আমরা লেকের পাশে একটা ছাউনির নিচে বসে আছি। মেয়ে কাগজ-পেনসিল নিয়ে আঁকাআঁকি করছে। আমি বসে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে আছি। এমন সময় একজন অজি দম্পতি এলেন ছাউনির কাছে। ভদ্রলোক আমার কাছে অনুমতি চাইলেন ওখানে বসতে পারেন কিনা। তাদের হাতে দেখলাম বড় বড় খাবারের বক্স। বুঝলাম তাঁরা এখানে লাঞ্চ করতে এসেছেন। আমি তাঁদের বসতে বলে উঠতে যাচ্ছি, তিনি তাড়াতাড়ি করে বললেন, আমি কি তাঁদের জন্য চলে যাচ্ছি? আমি হেসে বললাম, না। বাসায় যেতে হবে অনেকক্ষণ হয় আমরা এসেছি। তিনি আলাপ জুড়ে দিলেন আমার মেয়ের সঙ্গে। আমার দিকে তাকিয়ে তার নাম বললেন ও পরিচয় জানালেন। আমিও পরিচিত হলাম।

তার নাম বব আর স্ত্রীর নাম ক্লারা। বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। ক্লারা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ইন্ডিয়ান কিনা? আমি বললাম না, বাংলাদেশ। ভদ্রমহিলা চিনতে পারলেন না। আমি একটু অবাক হলাম তিনি ভারত চেনেন বাংলাদেশ নাম শোনেননি। আমি চিরায়ত চেনানোর পদ্ধতিতে ভারতের পাশের দেশ বাংলাদেশ বলে তাকে চেনানোর চেষ্টা করছি ঠিক তখন ভদ্রলোক আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, হেই তোমার দেশতো ক্রিকেটের জন্য বিখ্যাত। এর কিছুদিন আগে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলে জিতেছিল। তার কথায় আমি অবাক হলাম এবং এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি একে একে কয়েকজন খেলোয়াড়ের নাম বলে যেতে লাগলেন ভুল উচ্চারণে। আমি নিজেও হয়তো সবার নাম বলতে পারব না। ভদ্রলোক খুব বাংলাদেশের খেলা আর খেলোয়াড়দের নিয়ে অনেক কথা বললেন। আমাকে বললেন, তুমি কি প্রাউড ফিল কর না তোমার দেশ নিয়ে। মনে মনে আমি বলছি সেটা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? প্রস্তুত হচ্ছি আরও কিছু বলার জন্য।
আমি একে বলে যেতে লাগলাম আমার দেশ ছয় ঋতুর জন্য বিখ্যাত, যেটা পৃথিবীর আর কোথাও নাই। অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশে। অনেক টুরিস্ট স্পট আছে যা দেখতে প্রতি বছর অনেক টুরিস্ট আসেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। পৃথিবী বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আছে আমাদের দেশে। এ ছাড়া কাপড় রপ্তানিতে আমার দেশ সেরা। অজি দম্পতি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন আর আমি বলে যেতে লাগলাম। ভদ্রমহিলা তখন মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, তিনি এই নাম কেমার্ট আর বেস্ট এন লেস শপে দেখেছেন। আমি মোবাইলের গুগলে গিয়ে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিয়ে সার্চ দিতেই অনেক পেজ চলে এল। তারা দেখছেন আর বলছেন, ওয়াও অনেক সুন্দর, তোমার সঙ্গে কথা না বললেতো জানতেই পারতাম না এত সুন্দর একটি দেশের কথা। আমার সামনেই ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ডার্লিং চল এই বছর ক্রিসমাসের ছুটিতে বাংলাদেশ ভ্রমণ করে আসি। আগেতো শুধু খেলা দেখেছি এবার দেশটা দেখে আসি।
তারা জানালেন, প্রতি বছর নভেম্বর আর ডিসেম্বর প্রথমে ইংল্যান্ড পরে অন্য কোনো দেশ ভ্রমণ করেন। তারা প্রায় ৪৫ বছর ধরে এই দেশে আছেন। তাদের অরিজিন ইংল্যান্ড। সেদিন ওই পার্কে এসেছেন নাতি-নাতনিদের সঙ্গে লাঞ্চ করবেন বলে। ওরা পারামাট্টা থাকে আর তারা ব্যাংকসটাউন থেকে এসেছেন। ব্যাংকসটাউন অনেকটা দূর ওখান থেকে। আমাকে বব জিজ্ঞেস করছেন আমি কি দেশে ব্যাক করব কিনা। এত সুন্দর তোমার দেশ কেন এখানে আছ? বললাম, সবকিছুর যেমন ভালো দিক আছে তেমন মন্দও দিক আছে। হয়তো একটু নিরাপত্তা, উন্নত জীবন, রাজনীতি, ধর্মীয় শান্তি এসবের কারণে পড়ে আছি এখানে, কিন্তু মন পড়ে আছে ওখানেই। আমরা কি আর আমাদের শিকড় ভুলে যেতে পারি? তুমি কি পেরেছ তোমার শিকড় ভুলে যেতে। বাংলাদেশ এখনো উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা কাটিয়ে উঠছে। তাদের আরও জানালাম, বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃত। পৃথিবীতে একমাত্র বাংলাভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে, যা বিশ্বের অন্য কোথাও ভাষার স্বীকৃতির জন্য হয়নি।
আমি সব সময় বাংলাদেশি হিসেবে গর্ববোধ করি, করব।
আমি বাংলাতে বললাম—
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি।
সে যে আমার জন্মভূমি।’
তারা কি বুঝলেন জানি না, হেসে বললেন কিপ ইট আপ। এর মধ্যে তাদের নাতিনাতনিরা এসে পড়েছে সেটা খেয়াল করিনি। ওদের সঙ্গে আমার মেয়ে খেলছিল। দেখলাম কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেছে। ক্লারা আমার মেয়েকে চকলেট আর একটা ফ্রুট ইয়োগার্ট দিলেন। তারপর তাদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। অনেক দিন পর মনের মধ্যে একটা পরিতৃপ্তি কাজ করছিল। সেটা যে নিজের দেশ নিয়ে একটু বলতে পেরেছি তাই সেটা বুঝতে আর বাকি থাকল না।

সুস্মিতা পাল জেমী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।