আমি এক নিখোঁজ বাংলাদেশি

যখন দেশ ছাড়ি, তখন আমি এক উড়ন্ত কিশোরী। আবেগ ছিল, আবেগের সীমারেখা ছিল না। যদিও আমেরিকা আমার স্বপ্নের দেশ ছিল না, তবু এসেই পড়লাম। তবে আমার আসাটা ছিল ভিন্নভাবে, ভিন্ন কারণে।
এখানে এসেই খুব হতাশ হয়ে গেলাম। সারাক্ষণ ঘরে আটকে থাকা। বাইরে গেলে যাদের দেখি তারা সব ঠাস ঠাস ইংরেজি বলে। সাধারণ ইংরেজিগুলো বুঝতে পারলেও আমেরিকান ফ্রেইজ ব্যবহার করা বাক্যগুলো একেবারেই বুঝতাম না। সব কেমন মেকি মেকি। বিদেশি মানুষগুলো কথার থেকে চোখ-মুখ-হাতের অঙ্গভঙ্গি বেশি করে। কেমন যেন কৃত্রিম। জ্যাকসন হাইটস ও জ্যামাইকা না গেলে কোনো বাঙালির দেখা মিলত না। দেশে ফোনকলে কথা বলার জন্য তখন ফোনকার্ড ছিল না। এস্টোরিয়াতে একজন বাঙালির দোকানে গিয়ে লাইন দিতে হতো ঘণ্টা ধরে। ছোট ছোট খুপরিতে ফোন থাকত। ৫০ সেন্টস মিনিট হিসেবে কথা বলতাম দেশে। কথা শেষে পরবর্তী তারিখ জানিয়ে দিতাম ফোন করার। বলে দিতাম সবাই যেন ফোনের সামনে থাকে।
কী ভীষণ মন খারাপ নিয়ে ভাবতাম দেশের কথা, প্রিয় মানুষগুলোর কথা, বাড়ির ফটকে রাতে পাহারায় বসে থাকা কুকুরটির কথা! প্রতিদিন চিঠি লিখতাম। সপ্তাহ শেষে সব এক সঙ্গে পাঠাতাম প্রিয় মানুষগুলোকে।
তারপর একদিন, কচুরিপানার মতোই সময়ের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে নিজের ভেতর আবিষ্কার করলাম ভিন্ন এক আমিকে। পড়াশোনা শুরু করলাম। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন আমাকে পেয়ে বসল। গ্র্যাজুয়েশন করলাম ম্যাগনা কাম রাওডি অ্যাওয়ার্ড নিয়ে। গ্র্যাজুয়েট স্কুলে গেলাম আরও ওপরে উঠব বলে। শিক্ষা দপ্তরে চাকরি হলো। জীবনধারা বদলে গেল। একটা জীবন পিছনে ফেলে নতুন জীবনের স্বাদ পেলাম। ১৯টি বছর কেটে গেল আমেরিকার মাটিতে।
আজ যখন কেউ বলে, বিদেশ আর কত দিন! এবার দেশে চলে আয়, তখন মনে হয়, দেশে যাব? এমন বেতন, এমন সুবিধা কী সেখানে পাব? মশার যা উৎপাত! লোডশেডিং সহ্য হবে তো? যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, জীবনের নিশ্চয়তা কই? যা ভেজাল সব খাবার ওদেশে! অরগানিক খাবার তো পাব না। আমার নিউরোপ্যাথিক ডিসঅর্ডার নির্ঘাত বেড়ে যাবে তাহলে। তারওপর অনুন্নত চিকিৎসা। না বাবা, থাক! বছরে দুবার বেড়াতে যাই সেই যথেষ্ট।
শৈশবের সেই নানুবাড়ির লাল মাটির ঘর এখন আমার কাছে কেবল বেদনাবিধুর স্মৃতি। গাছ পাকা কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া, উঠোন জুড়ে দাদিমার শখের পাকা ধানের গন্ধ, লোডশেডিংয়ে তাল পাতার পাখার বাতাস, টিউবে নদী সাঁতরে এপার হতে ওপার যাওয়া কেবল অতীত। ঝড়ের দিনে আম কুড়াতে ছুটোছুটি করা, বৃষ্টিতে গোসল, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে ধ্যানমগ্ন, জ্যোৎস্না রাতে ছাদের কার্নিশে পা ঝুলিয়ে ভাবনায় হারিয়ে যাওয়া, রিকশায় চড়ে আইসক্রিম খাওয়া... কেবলই স্মৃতি।
এখন ভালো লাগে রুজভেল্ট আইল্যান্ড। ভালো লাগে রকওয়ে বিচ, কনি আইল্যান্ড। এখানের আকাশে কোনো রং নেই, তবু ভালো লাগে! বিশুদ্ধ বাতাস, পরিচ্ছন্ন পথ, নিশ্চিত জীবন, চাকরির নিরাপত্তা, উন্নত চিকিৎসা—সবই উপভোগ করি! নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে এখন সবকিছুই মেনে নিয়েছি।
মাঝে মাঝে যখন স্মৃতির পাতা খুলে বসি একাকী-নিভৃতে, তখন মনে হয়, আমি কে? আমি কি একজন বাংলাদেশি? নাকি আমেরিকান? জন্মসূত্র আগে? নাকি নাগরিকত্ব?
অবশেষে জেনে যাই আমার পরিচয়। আমি এক নিখোঁজ বাংলাদেশি।