আমার লতা
ষাটের দশক থেকে ২০২২। প্রায় তিন প্রজন্মের প্রত্যেকেরই একটা করে নিজস্ব লতা মঙ্গেশকর আছে। আমারও আছে। মনে প্রথম প্রেমের কলি ফোটার লতা, ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা, লিখ দিয়া নাম ইসমে তেরা।’ আবদারের লতা, ‘না যেয়ো না রজনী এখনো বাকি।’ বিদায়ের লতা, ‘আজ তবে এইটুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে।’
লতা মঙ্গেশকরকে প্রথম দেখি আশির দশকের গোড়ায়। তখন পকেটে পয়সা নেই। এক রোজগারি দাদার কৃপায় লতার কনসার্টের টিকিট পেলাম কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে। আগেভাগে গিয়ে বসে পড়লাম। স্টেজে ভায়োলিন–অনসাম্বলসহযোগে পুরোদস্তুর অর্কেস্ট্রা। লতাজি এলেন। পরনে চিরাচরিত আড়ম্বরবিহীন সাদা শাড়ি। কপালের টিপটা ছাড়া আর কোনো সাজসজ্জা নেই।
কোনো ভণিতা নয়। খুব সংক্ষিপ্ত সম্ভাষণ করেই গান। প্রথম চমক লাগল, ওনার সাধারণ কথা বলার কণ্ঠস্বর ও গানের গলা একদম এক। যে স্কেলে গান করেন, সেই স্কেলেই কথা বলেন। এমনটা বড় একটা শোনা যায় না। তাই ওনার কথা বলাটাও যেন একটা গান—উঁচু স্কেলে, আস্তে আস্তে, মিষ্টি করে।
গান শুরু হলো। পুরো স্টেডিয়াম নিথর হয়ে শুনছে। দুটি গানের মাঝে কোনো চটকদারি কথা নয়। খালি ফার্স্ট ভায়োলিনিস্টের সঙ্গে একপলক চোখ চাওয়াচাওয়ি করে পরের গানের স্কেলটা ঠিক করে নেওয়া। তিনটি গানের পর দর্শকদের কাছ থেকে কিছু ফরমাশ এল, এ গানটা, ওই গানটা। মিষ্টি হেসে লতাজি বললেন, আমাকে আমার মতো করেই গাইতে দিন, আপনারা আরাম করে বসে শুধু শুনুন। এর পরে কারোর আর ফরমাশ করার সাহস হয়নি। তবে তার প্রয়োজনও ছিল না। একটার পর একটা গানের তরঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন, বাংলা আর হিন্দিতে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। এত নিখুঁত পরিবেশন যে জলসায় গান শুনছি না রেকর্ডে গান শুনছি বোঝার উপায় নেই।
বাংলার লতা
‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে, দূরের তারার পানে চেয়ে’। এ গান দিয়ে লতা মঙ্গেশকরের বাংলা গানের জয়যাত্রা শুরু। তবে এরও আগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন, ‘তোমার হলো শুরু’, আর ‘মধু গন্ধে ভরা।’ ৩৬টি ভাষায় গান করেছেন। তবে হিন্দি ও নিজের মাতৃভাষা মারাঠি ছাড়া, বাংলা ভাষাতেই তাঁর সবচেয়ে বেশি গান। ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা’, ‘কে প্রথম কাছে এসেছি ...’ আরও কত গান।
সুরকার সলিল চৌধুরীর সঙ্গে লতার জুটি বাংলা গানে এক অনন্য মাত্রা এনেছিল। ‘না মোনো লাগে না’, ‘কেন কিছু কথা বলো না’। এমন অসংখ্য গান, যা সৃষ্টির কষ্টিপাথরে অমর হয়ে থাকবে। সেকালে একবার বিদেশে কনসার্ট করতে গিয়ে সলিলদার জন্য বেঠোফেনের সিম্ফনির রেকর্ড এনেছিলেন।
১৯৭৪ সালে পুজো সংখ্যার গান নিয়ে লতা মঙ্গেশকর আর কিশোর কুমারের মধ্যে এক মজার চুক্তি হয়। দুজনের মধ্যে ঠিক হয় সেই বছর লতার পুজোর গানের সুর দেবেন কিশোর আর কিশোরের গানের সুর লতা দেবেন। সেই বছরের কিশোর কুমারের হিট গান—‘তারে আমি চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি’—লতা মুঙ্গেশকরের সুরে গাওয়া।
বাংলাদেশের লতা
১৯৭১। প্রখ্যাত অভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমান তখন মহারাষ্ট্রের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির প্রধান। তহবিল সংগ্রহের জন্য বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) ব্রেবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে জলসার আয়োজন করবেন। গান দিয়ে একটা আস্ত ক্রিকেট স্টেডিয়াম ভরানোর ক্ষমতা একমাত্র লতা মঙ্গেশকরেরই ছিলেন। তাই দ্বারস্থ হলেন লতার কাছে। ‘তুমি তো জানো আমি এখন কনসার্ট করি না। তবে এই ভালো কাজের জন্য আমি গাইব।’ এর পরের বছরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন অনুষ্ঠান করতে। বাংলায় একটি গানও গেয়েছেন।
স্ত্রী শক্তির লতা
‘আচ্ছা, এই গানের জন্য তুমি কত টাকা নেবে, ফিল্মের প্রযোজককে বলতে হবে তো?’ জানতে চাইলেন ছবির সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেটা ১৯৫২ সাল। কথা হচ্ছিল বোম্বেতে লতার ছোট্ট ভাড়া করা ফ্ল্যাটে, যেখানে তখনো বাপহারা চারটি ছোট ভাইবোন নিয়ে জীবনযুদ্ধের উথালপাতালে নাকাল। ‘দাদা, আমার ঝগড়া প্রযোজকের সঙ্গে, আপনার সঙ্গে নয়। এ গান আমি শুধু আপনার জন্য গাইব। প্রযোজককে টাকাপয়সার ব্যাপারে কোনো কথা বলার দরকার নেই।’
পুরুষশাষিত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একপলকের জন্যও নিজের অধিকার নিয়ে সমঝোতা করেননি লতা মঙ্গেশকর। সম্রাজ্ঞীর মতো দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। দরকার হলে ইন্ডাস্ট্রির তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। একবার গানের রয়্যালটি নিয়ে দ্বিমত হলো রাজ কাপুর ও মোহাম্মদ রফির সঙ্গে। কিছুকাল ওঁদের সঙ্গে কাজই বন্ধ করে দিলেন। ওঁরাই আবার মিটমাট করে লতার সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তারপর এ ব্যাপারে তিক্ততার রেশ মাত্র ছিল না। জীবনে সবচেয়ে বেশি ডুয়েট গান রেকর্ড করেছেন মোহাম্মদ রফির সঙ্গে।
লতা মঙ্গেশকরের এ আপসহীন মনোভাব ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আসা বহু নারীর কাছে বিরল অনুপ্রেরণা। অভিনেত্রী ঊর্মিলা মার্তন্ডকর বলেন, ‘বয়সে আমি লতাজির নাতনির সমান। তবে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এসে কী করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়, তা ওঁর কাছেই শেখা।’
সেই লতা মঙ্গেশকর চলে গেলেন। সত্যি কি তাই?
সুচিত্রা সেন অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্র আঁধির গানের রেকর্ডিং হচ্ছে।
নাম গুম জায়েগা,
চেহেরা য়ে বদল জায়েগা,
মেরি আওয়াজ হি পেহচান হ্যায়।
স্টুডিওতে রেকর্ডিংয়ের পর সেদিন গানের গীতিকার গুলজার লতাকে বলেছিলেন, তোমার এ আওয়াজই চিরকাল তোমার পেহচান, তোমার পরিচয় হয়ে থাকবে।
লেখক: আশীষ দত্ত, বেঙ্গালুরু, ভারত