আমার মায়ের কথা

আমার মায়ের কপালটা ছিল যেন কেমন।
তা না হলে দশ বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হবেন কেন? বড় মেয়ে হিসেবে তাই তাঁর ঘাড়ে ওঠে আমার নানা জানের সংসার।
এরই মধ্যে কষ্টসৃষ্টে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত উঠে ওনার লেখাপড়া আর এগোয়নি।
মা হয়ে গেলেন পুরা রকমের সংসারী। ভীষণ এক সংগ্রামমুখর জীবন শুরু করলেন। বাস্তবতার নিরিখে মা হয়ে গেলেন একজন জীবনসংগ্রামী যোদ্ধা। একজন ফাইটার। সেই অপরিণত বয়স থেকেই।
সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়াও দেখিয়ে দিতেন তিনি এবং তদারকিও করতেন।
মার ছোট এক বোন ছিলেন খুবই পড়ুয়া ও মেধাবী। আমার সেই খালামণি লেখাপড়ায় অনেক মনোযোগী ছিলেন। ক্লাসে রেজাল্ট খুব ভালো করতেন। তিনি এতই ব্যস্ত থাকতেন পড়ালেখা নিয়ে, যে খাওয়ার সময়টুকুও পেতেন না।
মা আমার সেই খালামণিকে মাঝে মাঝে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। পরে সেই খালামণি রসায়ন শাস্ত্রে মাস্টার্স ডিগ্রি নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং লন্ডনে পিএইচডি করে ঢাকায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারের পরিচালক হয়ে অবসর নেন।
১৯৪৬ সালে মাতৃহারা সংসারী এক মেয়ে আমার মায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় আমার বাবার।
তখন বাবার কর্মস্থল ছিল আসামে। তাই মার নতুন সংসার জীবন শুরু হয় আমার দাদা বাড়িতে।
বাবা ছিলেন রাগী তেজি আর গুরুগম্ভীর। সেই মানুষটির অনুপস্থিতিতে আবারও সংসারের হাল ধরতে হয় আমার মাকে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে বাবা বদলি হয়ে চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে।
তখনকার দিনে আমার বাবার সরকারি চাকরি থেকে আয় করা উপার্জন দিয়ে আমার মা সংসার চালাতেন। ধীরে ধীরে সেই সংসারের পরিধি বাড়তে বাড়তে আমরা আটজন ভাইবোন এসে হাজির হলাম মা বাবার কাছে।
আমার মা ছিলেন খুবই হিসাবী। কোনো কিছুতেই অপচয় করতেন না। উপরন্তু মা সংসার থেকে টাকা বাঁচিয়ে সঞ্চয় করতেন।
এক সময় মার সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে আমাদের সংসারের কোনো একটা জিনিস কেনা হতো।
আমাদের বেশ বড়সড় পরিবারের সংসারের সকল কাজকর্ম দেখাশোনা ছাড়াও মা আমাদের লেখাপড়া দেখিয়ে দিতেন। সকাল সন্ধ্যায় পড়াতে বসতেন।
আমার বাল্যকালের শিশু শিক্ষা পাঠ, স্লেট পেনসিল দিয়ে লিখতে শেখা, তারপর সবুজ সাথি প্রথম পাঠ, বাংলা বইয়ের বিভিন্ন গল্প ও ছড়া মার কাছ থেকে শিখতাম। যেগুলোর মধ্যে ছিল, অমলা কণা উষা, জুলেখা বাদশাহর মেয়ে, গণি মিঞা একজন কৃষক, সারস পাখির গল্প, টোনাটুনির গল্প, সেই সব কথা আজও স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে।
রঙিন ছবিওয়ালা সে সব বই মার সঙ্গে পড়তে কতই না আনন্দ লাগত। না পরতে পারলে বা ভুল করলে মা কখনো গায়ে হাত তুলতেন না বা বকাঝকা দিতেন না। কিন্তু বাবা একটু ভুল করলেই বকুনি দিতেন। তাই বাবার কাছে আমরা কেউ পড়তে বসতাম না।
মা আমার শিক্ষার হাতেখড়ি দিয়েছিলেন। তিনিই আমার প্রথম শিক্ষিকা।
রাতে আমাদের সবার লেখাপড়া শেষ হলে মা আমাদের খেতে দিতেন। আমরা ছোট কজন একসঙ্গে খেতে বসতাম।
খাওয়াদাওয়া হলে বিছানায় গিয়ে মা আমাদের গান গাওয়ার সুরে সুরে—হারাধনের দশটি ছেলে ঘোরে পাড়াময়, একটা কোথা হারিয়ে গেল রইল বাকি নয়,
বলে বলে আমাদেরকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতেন। অথবা ছেলে ঘুমাল, পাড়া জুড়াল বর্গি এল দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে।। ধান ফুরল, পান ফুরল খাজনার উপায় কী? আর ক'টা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি, এই সব শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন।
আমার মা ছিলেন খুব দিল দরিয়া একজন নিরহংকার মানুষ। গরিব ফকির-মিসকিনদেরকে সব সময় সাহায্য করতেন। কখনোবা টাকা পয়সা না দিতে পারলে তখন নিজের ঘর থেকে চাল দিয়ে দিতেন।
আমার খুব ছোটবেলাকার একটা কথা মনে পড়ে।
শুকুর আলী নামে একজন গরিব লোক যিনি স্থানীয় এক মসজিদের খাদেম ছিলেন। তিনি প্রতি বৃহস্পতিবারের রাতে আমাদের বাড়িতে খেতেন। ওই দিন মা অনেক কিছু ভালোমন্দ রান্না করতেন শুধুই ওই মানুষটির জন্য।
রাস্তার দুস্থ মহিলা ফকিরদের যত আবদার ছিল আমার মায়ের কাছে। মা তাদের খোঁজখবর রাখতেন আর অনেক দান খয়রাত করতেন। ওই সব চেনাজানা ফকিরদের জন্য মা আলাদা করে ফিতরার টাকা ও কোরবানির মাংস রেখে দিতেন।
আমার মা ছিলেন খুব মিশুক একজন মানুষ। বাবার চাকরির সুবাদে আসা তখনকার ছোট্ট থানা শহরের সব সরকারি কর্মকর্তারা মিলেমিশে থাকতেন।
মার সঙ্গে আমি সন্ধ্যার পর সার্কেল অফিসারের বাসায় না হয় ওসি সাহেবের বাসায় বেড়াতে যেতাম। আমাদের নাশতাপানি দিয়ে তাঁরা আপ্যায়ন করতেন। সেখানে থাকত ছানার জিলাপি নতুবা গরম-গরম রসগোল্লা। আমি সেই লোভে লোভে মার সঙ্গে বেড়াতে যেতে বায়না ধরতাম।
পৃথিবীর অন্যান্য সব মায়েদের মতো আমার মায়ের হাতের রান্নাও ছিল খুবই স্বাদের। সব ধরনের রান্না মা পারতেন। লুচি পুরির সঙ্গে মার হাতের ঘিয়ে ভাজা সুজির মিষ্টান্ন খুবই সুস্বাদের হতো।
আমার মা ছিলেন যে কোনো ধরনের ঘন্ট রান্নায় স্পেশালিস্ট। সেটা মুড়ো ঘন্ট হোক বা মিষ্টি কুমড়ো ঘন্টই হোক। মার নিজস্ব মন-মসলার একটা রেসিপি ছিল সব ধরনের রান্নার ভেতরে।
একদিন আমার মায়ের হাতের লাউ ঘন্ট খাওয়ার আবদার শুনেছিলাম আমার এক নানার মুখে। মা নাকি তখনো জানতেন না যে, ওনার হাতের রান্না এত ভালো।
ঈদের দিনে মার হাতের দুধ সেমাই ছিল অনন্য।
মা পোলাও ও গোসের রেজালা রাঁধতেন খুব যত্ন নিয়ে এবং স্বাদ করে। ঈদের দিনে আব্বার অফিসের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীরা আমাদের বাসায় খেতেন। ওনারা মার রান্নার খুব প্রশংসা করতেন।
মায়ের আট আটটি ছেলেমেয়ে আমরা সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। জীবদ্দশায় সব ছেলেমেয়েদের তিনি চাকরি করতেও দেখে গেছেন।
আমার মা খুব নামাজি ছিলেন। আল্লাহপাক তাঁকে মক্কায় যাওয়ার তৌফিকও দিয়েছিলেন। তাই নবীজির রওজা মোবারককে সালাম করতে পেরেছিলেন।
ঘুরতে গিয়েছিলেন বিলেতও।
এই অধম ছেলের প্রবাস জীবনও দেখতে তিনি কানাডা পর্যন্ত এসেছিলেন।
কিন্তু হায়...কানাডা থেকে দেশে ফিরে গিয়েই দুরারোগ্য মরণঘাতী ব্যাধি ক্যানসার ধরা পড়ে আমার মায়ের। দেখতে দেখতেই টার্মিনাল ইলনেস।
আমার জীবনসংগ্রামী মা জননী ক্যানসারের সঙ্গে ফাইট করে জয়ী হতে আর পারলেন না। দেশে ফেরার ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় পরাজিত সৈনিকের বেশে আমার মা চিরবিদায় নিলেন।
মায়ের আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই এখন।
মায়ের মতো এমন মমতাময়ী আর কে আছে এই পৃথিবীতে?
তাই যাদের মা এখনো জীবিত আছেন তাদের কাছে আমার অনুরোধ, মাকে প্রতিদিন জানিয়ে দিন, মা গো আমরা তোমার সন্তানেরা তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। তুমি আমাদের মাঝে আরও অনেক দিন বেঁচে থেকো, তুমি ভালো থেকো মা।
বিশ্ব মা দিবসে দুনিয়ার সকল মার প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সকল মাকে আন্তরিক অভিবাদন।
(লেখকের ইমেইল: [email protected])