আমার মায়ার শহর
কী মায়ার শহর আমার। আমার মন কেমন করে। কিসের জন্য? দেশের জন্য? নাকি দেশের মানুষের জন্য। মা, মাটির জন্য? কী এক হাহাকার বুকের ভেতর অহর্নিশি কাঁদে।
যে দেশ ভর্তি মশা, সেই দেশ। ময়লা–আবর্জনা আর নোংরা রাজনীতি ভরা দেশ। এসব ভাবালেও মন ভরে থাকে সেই দেশের জন্য ভালোবাসা। সেই দেশের কোণে এক ছোট শহরে নীল পাহাড়ের ঢেউ আছে। যে পাহাড় থেকে কথা কওয়া ময়না নিয়ে এসেছিল আমাদের ছোটবেলায়। সেই ময়না আমাদের মানুষের গলায় ‘আপা’ ডাকত। দূরের সেই নীল পাহাড় হাতছানি দেয় সারাক্ষণ।
জাদুকাটা, চলতি, রক্তি, বৌলাই আর সুরমা নামের নদী আছে। শিমুলের এক বাগান আছে। সিরাজ লেক বা নীলাদ্রি নামের এক লেক আছে। শাপলা ভরা বিল আছে। সূর্যমুখী ফুলের হাসি আছে। সেই শহরের এক কোণে আমার বাবা–মা কবরে ঘুমিয়ে আছেন। এই শহরের মানুষের বুকভরা ভালোবাসা আছে। এখনো চিতল, বোয়ালের পেটি রান্না করে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয়। এই শহরের ছেলেরা কবি, মেয়েরা কবি। কবিতার বুক চিরে এখানে নদীর কলতান শোনা যায়। টাঙ্গুয়ার হাওর নামে এক বিশাল জলসম্ভার আছে; মাছ–পাখির অভয়ারণ্য।
এখানে হাছনরাজার আধ্যাত্মিকতা যেমন লোকমুখে গীত হয়, তেমনি শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, রাধারমনের গানও।
এক সময় জুবিলি স্কুলের মাঠে স্কাউটের জাম্বুরিতে গিয়েছিলাম। সেই ছেলেবেলার কথা।
‘এই যে দেখছ পল্লিখান
এই পল্লি মোর জন্মস্থান
এই পল্লিতে বাস করে ভাই
হিন্দু মুসলমানরে
প্রেম ডোরে বাঁধা আছে
হিন্দু মুসলমান।
বাংলার নদীতে বয় স্নিগ্ধ জল
মাঠেতে সোনার ফসল
ধরা তলে সেরা বাংলা
বাংলাই স্বর্গস্থান রে,...’
কে গীতিকার, কে সুরকার সঠিক জানি না। তবে পিআই স্যার মানে শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক সম্ভবত। স্কাউটের ছেলেরা ক্যাম্প ফায়ার এর সামনে গান গেয়ে নাচতো। সেই স্মৃতির শহরে এসে এখনো দেখি একই রকম সম্প্রীতি।
আমি দেশে আসলে দেশ আমাকে মুগ্ধ করে। স্মল টাউনের সব সৌন্দর্য আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। আমার বন্ধু কৃষ্ণার বাসায় যাই। ভালোবাসার বারিধারা বর্ষিত হয়। করোনাকালে নিয়ন্ত্রিত ঘোরাঘুরি, তবুও মন মানে না।
পথে পথে পুরোনো বাড়ি খুঁজে বেড়াই। স্মৃতির শেওলায় নোনা ধরা দেয়াল দেখি। আমার বাবা চলে গেছেন এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। মা চলে গেলেন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। এই শহরের এক কোণে আরপিননগরের কবরস্থানে শুয়ে আছেন তারা।
‘কেন পিরিতি বাড়াইলায়রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি’
আধ্যাত্মিক এই মর্মবেদনা জীবনের হাহাকার বাড়িয়ে দেয়। এই শহরের শিল্পকলা একাডেমি সব সময় অনেক বেশি এগিয়ে। হাছন রাজা, রাধারমণ, দুর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিমরা এই মাটির মায়ায় গীত রচনা করে গেছেন আর সুরের ঢেউ শিল্পীর মুখে মুখে পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
‘আঁকা-বাঁকা মেঠো পথে
তোর রাখাল হৃদয় জানি হাসে
ও… পদ্মকাঁপা দিঘি-ঝিলে
তোর সোনার স্বপন খেয়া ভাসে
তোর এই আঙিনায় ধরে রাখিস আমায়
চিরতরে।’
মনিরুজ্জামান মনির জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকার। এই সুনামগঞ্জের বর্তমান সময়ের তরুণ গীতিকার সেজুল হোসেনও সর্বশেষ জাতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ গীতিকারের পুরস্কার পেয়েছেন।
এই শহরের তরুণ জেলা শিল্পকলা একাডেমির অফিসার আহমেদ মঞ্জুরুল হকের আমন্ত্রণে আমরা অংশ নিই শিল্পকলা একাডেমির বর্ষপূর্তির র্যালিতে। এরপর দলীয় শিল্পকলা প্রদর্শনী, অতিপ্রাকৃত প্রকৃতির উদ্বোধন করা হলো। এই শহরের তরুণ–তরুণীরা রং–তুলির আঁচড়ে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। ছোট এই শহরের ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকের ছবিতে ভিন্ন ধারা। এরা কাজ করে যাচ্ছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। শিল্পকলা একাডেমিতে পাঁচ দিনব্যাপী চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গেলাম।
এখানে সত্তরের দশকের হেরাল্ড রশীদ, সুনীল শুক্লা রয়েছেন। নব্বইয়ের রুনা লেইস আমার ছোট বোন, যে সুনামগঞ্জের প্রথম মেয়ে চারুকলায় পড়তে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু ও কারুকলার শিক্ষার্থী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রত্নেশ্বর সূত্রধরের চমৎকার অ্যাক্রেলিক পেইন্ট প্রদর্শনীতে স্থান পায়। এ ছাড়া নবীন শিক্ষার্থীদের আঁকা চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে স্থান পায়।’ জাতির পিতা ও তাঁর কন্যা’ এই চিত্রকর্মটি অসাধারণ।’ জাতির পিতার পোট্রেটটিও চমৎকার। প্রতিটি কর্ম ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে করা। কার্ভিন করে, জল রং, তেল রং, কাদা মাটিতে জামদানি মোটিফ উল্লেখযোগ্য।
সুনামগঞ্জের পাহাড়–নদী–হাওরের সৌন্দর্য প্রতিটি মানুষকে নিভৃতচারী শিল্পী করে তোলে যেন। সুনীল শুক্লার চিত্রকর্ম অপরাজেয় বাংলা আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়ে আসি। নবীন–প্রবীণের সম্মিলিত এই প্রয়াস আমাকে মুগ্ধ করেছে। এই স্বপ্নচারী তরুণ–তরুণীরা স্বপ্নকে ছুঁয়ে ফেলুক, এই কামনা করি।