আমার বাবা, আমার দেখা বাবারা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমার মনে হয় না বাবা দিবস আলাদা করে থাকার দরকার আছে। পৃথিবীতে নাকি কোনো খারাপ বাবা নেই! প্র্যাকটিক্যালি দ্বিমত থাকলেও, টেকনিক্যালি নেই। আসলেই বাবারা কেমন হয়? আমার বাবা কেমন?

আমার বাবা সহজ সরল, সততায় বিশ্বাসী, কাছের এবং দূরের মানুষদের সহজে আপন করে নেওয়া, সহজে ভালোবাসতে পারা একজন মুক্তিযোদ্ধা।


বাবাকে সত্যি কথা, ভয় এবং শ্রদ্ধা দুটোই করতাম ছোটবেলা থেকেই। ছোটবেলায় সেই সকালে বেরিয়ে যেত, ফিরত রাতে! ছুটির দিনগুলো বাজার, শপিং বা ঘুম, কখনো কখনো সপরিবার সিনেমা দেখতে নিয়ে যেত। শিশুপার্ক, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, সেগুলোও সেই ছুটির দিনগুলোতে। বন্ধুদের বাসায় যাওয়া, তাদের দাওয়াত দেওয়া, আবার সময় করে দু–এক দিনের জন্য হলেও নিজের মা–বাবাকে দেখতে যাওয়া! সঙ্গে নিত আমাকে। আমিও সবার আদর মেখে, ফ্রেশ গ্রামের আলো–বাতাস আর খাবার খেয়ে আসতাম তার সঙ্গে। আমার মামাদের, চাচাদের সবাইকে দেখে রাখা নিজের কর্তব্য ভেবেই করত। এখনো তাই। মনে করিয়ে দিতে ভোলে না, তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথা। যদিও আমরা (আমি) মাঝেমধ্যেই হাঁপিয়ে যাই, অন্যরা কেউ তাদের দায়িত্ব পালন করে না! তাদের যে দায়িত্ব আছে, সেটাই মনে করে না। তার একটাই কথা, ‘যে যা করে করুক, তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করে যাও।’ মাঝেমধ্যেই ভাবি, এটা কোন কথা?


অসুস্থ বাবার বড় ছেলে, সৎ ভাইয়েরা আগেই আলাদা! বোনদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে! অথচ তার কাছেই সবাই দরকারে আসে, বিশ্বাস করে, আশ্রয়স্থল মনে করে আসে। মামারা বড় হয়েছে আমাদের সঙ্গেই! কিছু বললেই বলত, ‘তোর নানা তোর মাকে খুব ভালোবাসত! তার অনুরোধ ফেলতে পারি না!’ ভীষণ সম্মান করত নানাকে আর নিজের বাবাকে। বলত, ‘আমার জন্য কারও কিছু করতে হবে না, আমার বাবা আমার জন্য দোয়া করে গেছে!’ দাদার কথা মাথায় করে রাখত। আবার শুধু দাদাই নয়, যাঁরাই আমার বাবাকে জানেন, তাঁদের সবার দোয়াই তার সঙ্গে আছে! পারতপক্ষে কোনো মানুষ তার সাহায্য বা উপকার চেয়ে ফিরে যায়নি। আমাদেরও সব সময় মানুষদের দান করতে, উপকার করার তাগিদ দিয়ে বেড়ায়। আমরা চেষ্টা করলেও তার মতো হতে পারব বলে মনে হয় না।


ছোটবেলায় আমাদের চিন্তা সারা দিন করত। আমাদের কিছু হলে, কেমন যেন তার দিন ভালো যেত না, বাসায় এসেই বলত, ‘আজ সারা দিন মনে কু গেছে!’ তখন ল্যান্ড লাইনও ছিল না। মোবাইল তো আরও দূর। সাধ্যের মধ্যে চাইলে চাঁদ পেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল।
ছোটবেলায় ভাতটা মেখে দেওয়া, কোলে তুলে খেলা বা গল্পের ছলে জিজ্ঞেস করত, ‘যদি কোথাও হারিয়ে যাও, কীভাবে ফিরবা?’ আমাদের পুরো সিনারিওর বর্ণনা করতে হতো কিভীবে ট্রাবলশুট করে ফিরে আসব। ফ্রিডমের প্রথম পাঠ।

কখনো বলত, ‘যদি কখনো কোনো অপরিচিত কেউ হঠাৎ এসে বলে, তোমার বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছে, কি তোমার মা হসপিটালে, কখনো ভুলেও বিশ্বাস করে তাদের সাথে যাবা না!’
মায়ের সঙ্গে রাগ করে না খেয়ে থাকলে, সে রাগ ভাঙিয়ে খাইয়ে তবেই ঘুমাতে দিত।


প্রথম যেদিন স্কুলে চান্স পেলাম, এক প্যাকেট চুইংগাম হাতে এনে দিয়ে, স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন সেটাই ছিল বিশাল প্রাপ্তি! বইমেলায় বই কেনা, চাইলে কখনো না নেই। কিন্তু অন্যায় করা যাবে না।
একবার খুব হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেলাম, দাঁতের ব্যথায়! বর্ষাকাল, আমাদের ওখানে রাস্তাঘাট ছিল না, নদীর মতো পানি রাস্তায়, সেই রাস্তায় আমায় কাঁধে ফেলে ছুট। ডাক্তার কোথায়? কোথায় নিয়ে যাবে? কীভাবে যাবে? কোনো হুঁশ নেই! আধা ঘণ্টা ঝড়বাদলে ভিজে সেদিন লোকাল ডাক্তারের খোঁজ পেয়েছিল। ডাক্তারই তখন পাওয়া যেত না, তায় আবার ডেন্টিস্ট! মালিবাগে একজন বসত হয়তো!

আরও অনেকবার অসুস্থ হয়ে যন্ত্রণা দিয়েছি। প্রথমবার পা ভেঙে ক্লিনিকে ভর্তি ছিলাম! মাঝরাতে ওষুধ কিনতে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ছিনতাইকারীর হাত থেকে কোনোরকমে বেঁচে এসে সে গল্প করেছিল পরে। পরেরবার অ্যাকসিডেন্টে সারারাত অ্যাম্বুলেন্সে এক হসপিটাল থেকে আরেক হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি। সব হাসিমুখে। আবার আমার ছেলেমেয়েদেরও কাঁধে বসিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটতে যাওয়া! ভালো করে পড়াশোনা করার উপদেশ, সঙ্গে ভালো মানুষ হওয়ার উপদেশ কোনোটাই বাদ পড়ে না। হাতের কাছে যা–ই পায়, হাত ভরে নাতি–নাতনিদের দেয়। আমি না চাইতেই সব পেয়ে বড় হয়েছি, ভীষণভাবে স্পয়েল্ড করা আমিসহ আমার পরিবারকে, নিজের বাবার কথা শুরু করলে শেষ হয় না।
কিন্তু আমি আরও কিছু বাবার কথাও বলব।


প্রথমেই আসে আমার দাদা। নীতিমান, ধার্মিক কিন্তু উদার মনের মানুষ। নিজের মসজিদে নামাজ পড়ান, নাতি–নাতনিদের কোরআন শেখান। কিন্তু গোঁড়ামি নেই। মিষ্টি মনের মানুষ, নাতনিদের স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে, শিক্ষার ব্যাপারে আপস নেই। আমাকে ছোট থেকেই বলতেন, ‘বু আমার ডাক্তার হবে।’ সম্মান দিয়ে সবাইকে কথা বলতেন। কোনো মন্দ কথা আমি তাঁর মুখে কোনো দিন শুনিনি। আমার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। সব ছেলেমেয়েকেই ভালোবাসতেন। সবার জন্য তাঁর দরজা সব সময়ই খোলা ছিল।
এর পরে আসে আমার নানার কথা। যতটা দেখেছি, নানাবাড়িতে গেলে সবার একটা অন্য রকম আদর ছিল। একবার মা তার হাত রাঁধতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলায় তাঁকে যে কী অশান্ত হতে দেখেছি, একবার পারলে ডিম এনে লাগান, একবার কলের ঠান্ডা পানি! কী করবেন বুঝতে না পেরে নানিকেই বকাবকি। আমার মায়ের মুখেই শোনা, পাকিস্তান আমলে ঢাকাই ড্রেসে শৌখিনভাবে মেয়েকে লালন–পালন করেছেন। ভীষণ সুন্দর করে গল্প করতে পারতেন, ছোট মামা শিখিয়ে দিত, ‘খালা আব্বাকে গল্প বলতে বলো!’ ওরা বাপকে একটু সমীহ করত। সেই সময়ে আমরা সবাই বাপদের সমীহ করেই চলতাম। গল্প শুরু হতো, ঘুমানোর আগ পর্যন্ত নতুন নতুন গল্প বলে যেত। নানার ছিল গাছপালার শখ, কলম দেওয়া বরইগাছ, আমগাছ...বাড়ির তিন ভাগ নানা গাছগাছড়ায় ভর্তি, শৌখিন মানুষ।


যার কথা এরপরে আসবে, তিনি আমার শ্বশুর, আমার দ্বিতীয় বাবা। তাঁর জীবনের একমাত্র মেয়ে আমি! আমার বাবারও তাই। আমাকে সেইভাবে আদরে, ভালোবাসায় সিক্ত করে গেছেন। আমার পড়াশোনার পেছনে তাঁর অবদান, আগ্রহও কম নয়! আমি আমেরিকায় প্র্যাকটিস করব, সেটা ওনার স্বপ্ন ছিল, সঙ্গে যেন আমার বাবাকে দেওয়া কথার সম্মান। যেদিন পরীক্ষাগুলো পাস করতাম, ভীষণ খুশি হতেন। রেসিডেন্সি পাওয়ার আনন্দে, আমার অবর্তমানেই বিশাল পার্টি, আমরাও তাঁকে সারপ্রাইজ দিতে সেদিন সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম। আমাদের দেখার পর যে ভীষণ আনন্দ দেখেছি ওনার চোখেমুখে, যেন কৃতজ্ঞ আমরা সেখানে থাকতে পেরেছিলাম বলে!


আমার বর যখনই ট্যুরে গেছে, আমি একা বাসায় ভয় পাব বলে, রাতে খেয়েদেয়ে চলে আসতেন (এখানে সবাই বিকেলেই রাতের খাবার খেয়ে নেয়)। সঙ্গে কখনো কখনো খাবারও নিয়ে আসতেন! আবার আমার ঘুম থেকে ওঠার আগেই চলে যেতেন। তাঁর জন্য আমাকে কখনো আলাদা করে নাশতা বানানো কি কোনো ঝামেলা করতে হয়নি। একটি কাপ চা দিলেই ভীষণ খুশি। আসার আগে ছোট ছেলের খাবার রেডি করে রেখে আসতেন। ছেলেদের ব্যাপারে তার যে ডেডিকেশন দেখেছি, আমার শাশুড়িকে বাচ্চাদের জন্য কখনো কিছু করতে হয়নি। নিজেই ছেলেদের জন্য রেঁধেছেন, বেড়েছেন, খাবার কেনা, খাবারের স্টক সব, সব এই বাবা করেছেন। তাদের জন্য রাত জাগা, তাদের পছন্দ–অপছন্দ সব এই বাবা এক হাতে সামলেছেন। ডেডিকেশনের অনন্য উদাহরণ হতে পারেন। আবার আমার জন্মদিন কি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি, নিজেই রান্না করতেন। সবাইকে খাওয়াতে খুব পছন্দ করতেন। কার রাইড লাগবে, কার গাড়ি লাগবে, কার ভিসা লাগবে বা কোন ডকুমেন্ট লাগবে, উদার হস্তে পরিবারের বাইরেও সবার জন্য করেছেন। সারাক্ষণ হাসিমুখে যত দিন বেঁচে ছিলেন, করে গেছেন। আবার আমাদের ট্রিপের পয়সাও হাতে তুলে দিতেন। হজ থেকে ফিরে একটু অসুস্থ ছিলেন, আমি তাঁকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভোলেননি। যখন হসপিটালে অবচেতনে ছিলেন, চেতনা ফিরলে ছেলেদের না চিনলেও আমাকে চিনতে পারতেন।

সবশেষে যার কথা না বললেই নয়! আমার বাচ্চাদের বাবা। স্বামী হিসেবে তার কথা বলব না। বাবা হিসেবে অবশ্যই বলতে হবে। বাবা হওয়াটা তার জন্য সহজ ছিল না। বাচ্চাকাচ্চা দেখেও বড় হয়নি। নিজের ভাই যখন ছোট, তখন সে কলেজে। কিন্তু নিজের বাচ্চাদের ডায়াপার চেঞ্জ থেকে শুরু করে খাওয়ানো, গোসল, রাত জেগে কোলে নিয়ে হাঁটা। মাঝরাতে বাচ্চা কাঁদছে, সেই তাকে কোলে নিয়ে, নিজে ঘুম থেকে উঠে হাঁটা, বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানো, খেলা সব! দিনে যেহেতু তেমন সাপোর্ট দিতে পারত না, রাতে সেটা পুষিয়ে দিত। বাচ্চাদের কলিক হচ্ছে, কি ফর্মুলা, কোন দুধের বোতল লাগবে, সবকিছুর খোঁজ রাখা। এরপর একটু বড় হলে, ডে–কেয়ারের জন্য ভোরে ঘুম থেকে তুলে রেডি করে, কোলে করে ড্রপ করে দিয়ে আসা—আমাকে কখনো ভাবতে হয়নি এসব। ছেলেকেও তাই। তাদের উইকএন্ডে বা কাজের পরে পার্কে খেলতে নেওয়া, আমার ব্যস্ততায়...এদের সামাল দেওয়া, না বললেই নয়। ভীষণ সিম্পল কিন্তু আদর্শবান বাবা।


ছেলেমেয়েদের পূর্ণ স্বাধীনতা—কাপড় চয়েজ করা থেকে স্কুলের সাবজেক্ট। একটাই চাওয়া, ছেলেমেয়ে যেন গুড সিটিজেন হয়। বিশ্বাস, আদর্শকে সম্মান করবে। নাহ্ বুড়ো হলে, ছেলেমেয়ের কাছে তার কোনো এক্সপেক্টেশন নেই। বরং আমি ছেলেকে বলি, যে ওর রেসপন্সিবিলিটি হবে, আমাদের দেখে রাখা। ছেলে আবার বোনের ওপর দায়িত্ব চাপাতে চায়, যেহেতু বোনটা বড়। ছোটবেলা ওর বোনের কাছে আবদার ছিল, বোন যেন ওরে বোনের বাসায় একটা রুম দেয়, যদি বাপ–মা বয়সকালে বাসা থেকে বের করে দেয়, ওর যেন রাস্তায় পড়তে না হয়। আমার দেখা বাবারা সবাই ভীষণ আদর্শবান, পরোপকারী এবং সাদামাটা ভীষণ রকমের ভালো মানুষ। বাবাদের আমরা যেমন দেখতে চাই, ঠিক তেমনি। এতগুলো ভালো মানুষ বাবা আমার চারপাশে, চারপাশের মানুষকে এরা ভালোবেসেছে, মানুষ হিসেবে অসাধারণ আর বাবা হিসেবে ইরেপ্লেসেবল। তাদের তুলনা শুধু তারাই। স্পেশালি আমার বাবা, একটা জিনিস চাইতে না চাইতে দশটা হাজির করেছে, এমন স্পয়েল্ড মেয়েদের স্বামীদের কপাল পোড়া, তারা আদর্শ স্বামী হতে পারে না কখনো হয়তো; কিন্তু আদর্শ বাবা হয়। এমন বাবারাই আমাদের মতো ছানাপোনাদের শৈশব, কৈশোর, জীবন অসাধারণ রঙিন করে তোলে ভালোবাসা দিয়ে।


আমার বাবা এবং আমার দেখা বাবাদের জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা।