আমার বাবা
আমার বাবা বেঁচে থাকলে এখন তাঁর বয়স হতো ১৩৪ বছর। ১৮৮৭ সালে তাঁর জন্ম। ব্রিটিশ ভারতে পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। সে আমলে সরকার তাঁকে ‘খান সাহেব’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছে।
আমরা ভাই-বোন এক কুড়ি। একটানা কয়েক বছর বাবার একান্ত সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ কারও হয়নি, ব্যতিক্রম আমি। একটানা ১২ বছর তাঁর (মৃত্যুর আগ পর্যন্ত) একান্ত সঙ্গী ছিলাম অথবা বলা যায় তাঁর সঙ্গেই আমাকে থাকতে হয়েছে।
ভাই-বোনদের কেউ কেউ মনে করেন, আব্বা সম্পর্কে আমিই সবচেয়ে ভালো বলতে বা লিখতে পারব। অনেক কিছু আমি লিখি, এটা কেন লিখছি না?
আমি যে ভাবিনি, তা নয়। তবে এই অভিজ্ঞতা এতই বিশৃঙ্খল, সাজানো বা গোছানোর সুযোগ মিলছিল না। আমার শৈশব কঠোর শাসন ও শৃঙ্খলার মধ্যে বন্দী ছিল, যার সবটাই পূর্ণ ছিল চঞ্চলতা ও দুষ্টুমিতে।
কঠোরতার বিরুদ্ধে এটা বিদ্রোহ ছিল কিনা জানি না। তবে এখনো মন বলছে, সে সময় প্রকৃতি আমাকে চালিয়েছে তার ইচ্ছামতো। আমার দুষ্টুমির বিচার হতো ঘরে-বাইরে। স্কুলে ছাত্রদের খোলা মাঠে জড়ো করে। সে জীবন সম্পর্কে আমার মায়ের বিখ্যাত স্মৃতিচারণ ছিল, ‘বিকেলে ঘরে ফেরার দিকে আমার চোখ থাকত না, আমি তাকিয়ে থাকতাম তার পেছনে পেছনে আজ কতজন নালিশ জানাতে এসেছে!’
সেই আমি আব্বার মৃত্যুর পর বদলে গেলাম, পুরোপুরি। শান্ত, দায়িত্ব সচেতন এক কিশোর, এক যুবক, এক পুরুষ। আব্বার সময়ে মোগলাবাজারের আমাদের বাড়িটি ছিল বই-পুস্তকে ভরা। সারা বছর খেতের ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু, দুধ, হাঁস-মোরগ, ডিম, ডজন ডজন জাতের ফলের গাছ, টাটকা শাক-সবজি। সুপারি ও বাঁশ বাগানসহ আরও কত কী! আব্বা সারা দিন ব্যস্ত থাকতেন এসবের পরিচর্যায়।
একদিনের ঘটনা মনে পড়ে। পুকুর পাড়ে বাংলো ঘরের পাশে শাক-সবজির গাছে নিড়ানি দিচ্ছিলেন। তাঁর পরনে ছিল গেঞ্জি ও লুঙ্গি। এ সময় এক দারোগা সঙ্গে দুজন সিপাহি এসে আব্বাকে ডাক দিলেন, ‘ওই বুড়ো মিয়া, যান তো, ডিএসপি সাহেবকে গিয়ে বলেন, আমরা থানা থেকে এসেছি।’
আব্বা তাঁদের বাংলো ঘরের প্রশস্ত বারান্দায় চেয়ার-টেবিলে বসিয়ে ভেতর বাড়িতে গেলেন। হাত মুখ ধুয়ে, মাথায় টুপি ও পাঞ্জাবি পরে তাঁদের সামনের চেয়ারে এসে বসে বললেন, বলুন আপনাদের কী সাহায্য করতে পারি? দারোগা সাহেব লজ্জা পেয়ে বললেন—‘স্যার আমরা চিনতে পারিনি’। আব্বা স্মিত হেসে পরিবেশটা হালকা করে দিলেন।
তখন আমার সাংবাদিকতার এক দশক পার হয়েছে। এরশাদ আমলে সিলেট কোতোয়ালি থানায় বসে মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা আবদুর রহিমের সঙ্গে আলাপ করছি। এ সময় আবদুর রহিম পাশের তাক থেকে হাত বাড়িয়ে একটি পুস্তিকা নিলেন। আসাম সরকারের একটি গেজেট। ১৯৪৭-এর আগে সিলেট আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। গেজেটের এক পৃষ্ঠায় তাঁর চোখ আটকে গেল। ‘মাহবুব সাহেব, ভেরি ইন্টারেস্টিং, এই দেখুন এখানে আপনার আব্বার কথা লেখা আছে’। হাতে নিয়ে দেখি, ১৯৩৪ সালের গেজেট। আব্বা জোড়হাটে কর্মরত। ডিএসপি। মাসিক মূল বেতন ৪০০ টাকা।
এরশাদ আমলের আরেকটি ঘটনা। এম এ হক (পাকিস্তান আমলে ডিআইজি ছিলেন) তখন ভূমিমন্ত্রী। আমাকে সিলেট শহরে তাঁর জিপে তুলে রওনা দিলেন জকিগঞ্জের উদ্দেশ্যে, তাঁর বাড়ি ও নির্বাচনী এলাকায়। রাস্তা ভালো না, ভাঙাচোরা। আসা-যাওয়ায় সাত-আট ঘণ্টা লাগবেই। এই দীর্ঘ সময় অনেক কিছু নিয়ে আমরা আলাপ করলাম। তিনি শোনালেন ১৯৪৭ সালের গল্প। ওই সময় তিনি করিমগঞ্জ মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। এক সপ্তাহ করিমগঞ্জে তাঁর কার্যালয়ে পাকিস্তানের পতাকা টানিয়ে রেখেছিলেন। কোনো সাহায্য না পেয়ে পরে পতাকাটি নামিয়ে সিলেট চলে আসেন। আলাপের এক ফাঁকে বললেন, আপনার আব্বা আমাদের অনেক সিনিয়র ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমার হয়নি।
আমার এক চাচা বলেছিলেন, তোমার বাবা ছিলেন দুরন্ত সাহসী, জাঁদরেল অফিসার। আমার এক অভিজ্ঞতার কথা বলি। তোমার বাবা তখন মৌলভীবাজারের এসডিপিও। তিনি তাঁর গাড়ির চালক নিয়োগ দেবেন। এক চালককে বললেন, এত মাইল বেগে গাড়ি চালিয়ে আমার তিন হাত সামনে ব্রেক কষতে হবে। এত কঠিন পরীক্ষায় অনেকে রাজি হতো না বা ফেল করত।
আমাদের বাড়ির সামনে দুটি স্কুল। একটি আমার বাবার নামে, বজলুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশে মায়ের নামে, সৈয়দা হাসিনা খাতুন গার্লস হাইস্কুল। দুটিরই প্রতিষ্ঠাতা আমার অনুজ আতিকুর রহমান। স্কুলের পরেই মোগলাবাজার রেলস্টেশন। ঘর থেকে দুই মিনিটের রাস্তা। সিলেট শহরের ধোপাদীঘির উত্তর পাড়ে আমাদের বাসা। সিলেট-মোগলাবাজার দূরত্ব সাত-আট মাইল। আসা যাওয়ার জন্য আমরা বেশির ভাগ সময় ট্রেন ব্যবহার করতাম। আব্বা আটটার ট্রেনের জন্য সাড়ে সাতটায় গিয়ে স্টেশনের বেঞ্চে বসে থাকতেন। ট্রেন প্রায়ই বিলম্ব হতো, দুই ঘণ্টা। রেল কর্মচারীসহ কেউ কেউ আব্বাকে পরামর্শ দিতেন, ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে। বিনয়ের সঙ্গে না বলে বেঞ্চে বসেই অপেক্ষা করতেন। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা রক্ষায় তিনি ছিলেন নিবেদিত।
আমার বড় ভাইকে (আতাউর রহমান, কক্সবাজার জেলার প্রথম এসপি, আটলান্টা, মরহুম) সমীহ করতাম আব্বার মতো। বড় ভাইও ছিলেন আব্বার মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। ভাই-বোনেরা আব্বাকে এতটা মান্য করতেন, শুনেছি পায়ের স্যান্ডেল বা খড়ম খুলে আব্বার রুম অতিক্রম করতেন, পাছে যদি আওয়াজ হয়।
একদিন এক বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছি। বড় এক রুমের ফ্লোরে চাদর ও দস্তরখানা বিছানো। গোল হয়ে বসেছি। সেখানে আমি একমাত্র শিশু। খাবার পরিবেশন করা হলো। একটু পর টের পাই আমার কোমরে প্রচণ্ড চিমটি। কে কাটছে? এদিক-ওদিক তাকাই। আবারও চিমটি। চেয়ে দেখি আব্বা, চোখ বড় করে ইশারা করছেন প্লেটে নজর দিতে। দাওয়াত শেষে ফেরার পথে বললেন, মজলিশের আদব তুমি রক্ষা করোনি। খাওয়ার সময় এদিক-সেদিক দেখছিলে, যা মজলিশে মানায় না।
শহরের বাসা ধোপাদীঘির উত্তর পাড় থেকে হেঁটে হেঁটে বন্দরবাজারের দিকে আসছি, জেলের মূল ফটকের সামনে আসার আগেই ছাতা খুলে মেলে ধরলেন। বৃষ্টি-রোদ নেই, ছাতা? আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বলো তো কেন? বোকার মতো চেয়ে রইলাম। হেসে বললেন, ওপরের গাছে কত পাখি, বিষ্ঠায় রাস্তা সাদা হয়ে গেছে। ছাতা না হলে আমাদের মাথায় এসে পড়বে।
একইভাবে কীনব্রিজ অতিক্রমের সময় রিকশার হুড বা ছাতা মেলে ধরতেন। কীনব্রিজে বসবাস হাজারো কবুতরের।
বাড়ির বড় পুকুরের এক কোণে দোচালা এক মসজিদ ছিল। ভোরে আব্বা ডেকে তুলতেন, যাও, আজান দাও। আমি আসছি অজু করে। আঁধার তখনো কাটেনি। ভেতর বাটি থেকে মসজিদ খানিকটা দূর। এ অবস্থায় গিয়ে আজান দিলাম। আব্বা আসলেন। দুজনে নামাজ পড়লাম।
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় মোগলাবাজার থেকে আমাকে নিয়ে শহরের নাইওরপুলের শাহ মীর মক্তবে ভর্তি করিয়ে দিলেন। শহরে আমার নতুন আসক্তি হলো মার্বেল খেলা। জেলের কোনায় রাস্তার ধারে একটা জায়গা আমরা পেয়ে গেলাম নিয়মিত খেলার। সে সময় আবুল ভাই (একাত্তরে শহীদ, সাবেক পৌরসভা চেয়ারম্যান বাবরুল হোসেন বাবুলের ভাই), দুই পাঞ্জাবি ভাই মো. আলী ও হাবিব, পটলসহ আরও কয়েকজন ছিলেন আমার সঙ্গী। আব্বা খবর পেলেন, খেলা নিয়ে মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি করি। ডেকে নিয়ে বললেন, তোমার মার্বেলগুলো আমাকে দাও। এক বার্লির কৌটায় রাখা ছিল, দিলাম। আমাকে চৌদ্দ পয়সা দিয়ে বললেন, এই নাও মার্বেলের মূল্য। আজ থেকে এ খেলা বন্ধ। মার্বেলগুলো রেখে দিলেন সিন্দুকে।
চতুর্থ শ্রেণিতে আবার মোগলাবাজারে ফিরে আসি। আব্বার মৃত্যুর পরে কুটি ভাইয়ের (মরহুম ইনামুর রহমান) হাতে ছিল সিন্দুকের চাবি। তাঁকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি, মার্বেলগুলো সিন্দুকে আছে কিনা।
একদিন দেখি, শহরের বিখ্যাত চিকিৎসক শামসুদ্দিন আহমদ (একাত্তরে শহীদ) বাসায় এসেছেন। তিনি আব্বাকে দেখেছেন। আব্বা খুব অসুস্থ। অনেক পরে সাদ ভাই (আলতাফুর রহমান) আমাকে বলেছিলেন, সন্দেহ করা হচ্ছিল আব্বা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
বড় আপা (সফিকুন্নেসা খাতুন চৌধুরী) বিশেষত মেধার কারণে আব্বার খুব প্রিয় ছিলেন। সফিকুন্নেসা খাতুন ১৯৬৪ সালে মেট্রিকে তৎকালীন কুমিল্লা বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল ও সরকারের স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। তিনি অংশ নিয়েছিলেন কিশোরী মোহন গার্লস হাইস্কুল থেকে।
বড় বোনদের সঙ্গে বেয়াদবি বা দুষ্টুমি আব্বা মোটেই সহ্য করতেন না। কঠিন শাস্তি দিতেন। একদিন সত্যি সত্যি আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলেন। রাতে রান্নাঘরের দরজা খুলে আম্মা ভেতরে ঢোকালেন এবং খাইয়ে চুপি চুপি বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আরেক দিন আব্বা এতটাই রেগেছিলেন যে, সোজা ঢিল ছোড়ার মতো বড় পুকুরে নিক্ষেপ করলেন। আমি অভিমান করেছিলাম, যদি সাঁতার না জানতাম! অবশ্য পরে জেনেছিলাম, আব্বা জানতেন, অল্প বয়সেই আমি সাঁতার শিখে ফেলেছি।
এক কঠিন আবরণের মাঝে একটি নরম মন যে বাস করত তা জানার কোনো সুযোগ ছিল না। আব্বার হৃদয়েও প্রবাহিত ছিল স্নেহ-ভালোবাসার ঝরনাধারা। বুঝতে দিতেন না। সন্তানদের লেখাপড়া ও মঙ্গলের জন্য সব সময় ছিলেন নিবেদিত।
একদিন এক প্রতিবেশী যুবক আমাকে বিনা কারণে মেরেছিল। দেখলাম, বাঁশের লম্বা এক কঞ্চি নিয়ে আব্বা ওই বাড়ির দিকে ছুটেছেন আর বলছেন, আমার ছেলের গায়ে হাত!
মেজ ভাইয়ের (রইছুর রহমান) বিয়েতে আব্বা আমাকে বরযাত্রী করলেন। আমরা গেলাম সুনামগঞ্জ শহরের জামাইপাড়ায়। যাওয়ার আগে আমাকে নিয়ে গেলেন খলিফার (দরজি) কাছে। হালকা হলুদ রঙের সিটের কাপড়ের সুন্দর শার্ট তৈরি করালেন, এই প্রথম জুতা পরার সুযোগ পেলাম।
মোগলাবাজারের রেবতীরমণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ব্রজেন্দ্র স্যার ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমাকে নির্বাচিত করলেন। পরীক্ষার দিন আমার প্রচণ্ড জ্বর। আব্বা কোলে করে পরীক্ষার হলে আমাকে নিয়ে গেলেন ও বাসায় ফিরিয়ে আনলেন। তাঁর স্নেহের স্পর্শ সেদিন অনুভব করলাম।
ষাটের দশকের প্রথম দিক। একদিন দুপুরে মোগলাবাজারের বাংলো ঘরের সিঁড়ি বারান্দায় বসে আছেন আব্বা। সুদর্শন এক পুরুষ, ধবধবে সাদা সাহেবি পোশাক, আব্বার পাশে এসে বসলেন। তিনি আফরোজ বক্ত, আব্বার নাতি। সিলেট সদর থানার সিও। সরকারি সফরে এসেছেন। এক ফাঁকে নানাকে দেখে যাচ্ছেন। আমি তখন এক শ হাত দূরে এক বেলগাছের নিচে বসে বাঁশের বাঁশি বাজাচ্ছিলাম।
কয়েক বছর আগে নিউইয়র্কে এক পারিবারিক আসরে আফরোজ বক্ত সেদিনের স্মৃতিচারণ করে আমাকে বলছিলেন, জানেন মামা, সেদিন নানা আপনাকে দেখিয়ে কী বলেছিলেন? বললাম, না, আমার জানার কোনো সুযোগ ছিল না।
—হ্যাঁ, ছিল না। নানা বলছিলেন, মাখন (আফরোজ বক্তের ডাকনাম) আমার এই ছেলেটি খুব প্রতিভাবান, ভবিষ্যতে নাম করবে।
আমি তন্ময় হয়ে কিছুক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
১৯৬৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আব্বা খান সাহেব বজলুর রহমান ইন্তেকাল করেন। ৫৭তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।