আমার বাতিঘর

দিনের আলো নিভে যাওয়ার পর আমি বেডরুমে খুব একটা ঢুকি না। বসার ঘর আর রান্না ঘরে হাতের কাজ সারতেই রাত ১০টার বেশি বেজে যায়। তার আগ পর্যন্ত আমার ঘরে লো-পাওয়ারের বেড সাইড ল্যাম্প জ্বলতে থাকে। জানালা ঘেঁষে আঙুর গাছের ঘন ঝুপড়ি কালো হয়ে আছে, বাতাসের মিষ্টি গন্ধে বোঝা যায় আঙুরগুলোয় হলুদ রং লাগতে শুরু করেছে। সাদা ‘হানি সাকল’ ফুটে আছে বেড়ার গা আলো করে, অনেকটা আমাদের দেশের কামিনীর মতো মাতাল গন্ধ। নীল জমিনের ওপর সাদা লেসের পর্দা সরিয়ে জানালা দিয়ে আরও দূরে তাকাই, দেখি পেছনের বাড়িটার চিলেকোঠার ঘরে বাতি জ্বলছে। বাতিটা প্রতি রাতেই জ্বলে, অনেক রাত পর্যন্ত জ্বলে। মাঝরাতে যখনই ঘুম ভাঙে, বিছানায় শুয়ে দেখতে পাই দূরে ওই বাড়িটির চিলেকোঠায় আলো জ্বলা জানালা। কে জেগে থাকে এত রাত পর্যন্ত! খুব একটা লোক সমাগম দেখিনি, বাড়িটাও বড্ড অদ্ভুত! এই পাড়ার সবচেয়ে পুরোনো, জীর্ণ, বিবর্ণ বাড়ি। সামনে কোনো বেড়া নেই, বাহারি ফুলের গাছ নেই, চিঠির বাক্সটাও ভেঙে হেলে পড়া। বহুদিন রং পড়েনি দেয়ালে, সবুজ জানালা থেকে পেইন্টিংয়ের ছাল জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। ছাদের বাঁকানো কার্নিশে আগাছা জন্মে ঝুলে পড়েছে, সামনের ফুটপাথে ডালগুলো অহেতুক বেড়ে পথচারীকে খোঁচা দেওয়ার মতো অবস্থা।

বাড়িটার পেছনে দুহাত সমান উঁচু ঘাসের মধ্যে মান্ধাতা আমলের একটি জং ধরা গাড়ি পড়ে আছে বহুকাল ধরে। সমস্ত কাঠামোতে কেমন যেন একটা ভেঙে পড়া ভাব। ব্যাকইয়ার্ডে কোনো সামারেই বারবিকিউ করেনি কেউ, কাপড় শুকাতে দেখিনি, এমনকি কোনো বাচ্চাও খেলেনি। অথচ বাড়ির পেছনের উঠোনটা বেশ বড়, আমার জানালা দিয়ে দিব্যি দেখা যায় শুধু শুকনো পাতার রাশ সঙ্গে গাদা করে রাখা কিছু ফেলনা মালপত্তর।

খুব সকালে বাচ্চা স্কুলে পাঠানোর পথে প্রায় দেখি পুরুষালি গড়নের এক বিশালদেহী সাদা নারী বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। সঙ্গে দুই বেণি করা ফড়িংয়ের মতো ছোট্ট একটা মেয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে ওই নারীর পেছনে। প্রসাধনহীন সাদা ফ্যাকাশে মুখটায় একরাশ নিরুদ্বেগ মেখে কোনোরকম কমনীয়তা ছাড়াই হেলেদুলে চলে যেত। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কোনো দিন চোখে চোখ রেখে বলেনি, ‘গুড মর্নিং’। পাথরের মতো কোদানো মুখে থাকত বিরক্তিকর এক অভিব্যক্তি, যেন সাফল্যহীন জীবনের প্রতি তার ব্যাপক অভিযোগ।

রাতে খাবারের পর হাঁটতে বের হলে কোনো কোনো দিন দেখা যায় ওই নারী তার বাড়ির সামনে বসে আইপ্যাডে ঝুঁকে আছে। অস্পষ্ট আলোতে মাথার ওপরে তুলে দেওয়া হুডির পাশ থেকে তীব্র খাঁড়া নাক উঁকি দেয়। অস্থির আঙুলে সিগারেট চেপে রেখে বিড়বিড় করছে। অনেক রাতে তার স্বামী বাড়ি ফেরে, ছোটখাটো একজন চকচকে স্প্যানিশ। তারা দুজনে পাথর কঠিন মুখ নিয়ে সাবধানী দূরত্বে পাশাপাশি হেঁটে যায়, নারীর কাঁধের অনেক নিচে তার স্বামীর কাঁধের উচ্চতা। দুজনের জুটি দেখে খুব একটা বাহবা দেওয়া যায় না, ভালোবাসাবাসির নিঃশর্ত হাসি হাসেনি কোনো দিন তারা। তারপরেও ওই বাড়ির বাসিন্দা দুজনে, শব্দহীন বসবাস, চাকচিক্যহীন জীবনযাপন। ধোঁয়াটে রহস্য থাকা সত্ত্বেও ওই বাড়ির চিলেকোঠার আলোটা আমাকে বড্ড টানে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে আমি চিলেকোঠার দিকে চুম্বকের মতো তাকাই, খুব ভালোবাসি ওই আলো দেখতে, ঠিক যেন বাতিঘর। সমুদ্রে দিক হারানো নাবিকের মতো আমিও যখন জীবনের হিসেব-নিকাশের যন্ত্রণায় হাঁপিয়ে উঠি, তখন চিলেকোঠার বাতিটাই আমাকে পথ দেখায়। অদ্ভুত জুটির মতো ওই দম্পতির জ্বালানো আলো দেখি আর ভাবি, ‘এইতো বেশ আছি, ভালোই আছি। আমার যা কিছু দুঃখ-কষ্ট-অপমান-অনুশোচনা, একান্তই আমার আপন, বুক পাঁজরের সিন্দুকে ভরা থাকুক সব। এরই ফাঁকে ফাঁকে কালো চাদরে বুটিদার জরির মতো আলো ছড়ানো কিছু প্রাপ্তি আর ভালোবাসা, এ-ও কি কম?’