আমার দেশই সেরা

তৈরি পোশাক কারখানাফাইল ছবি

বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছিল রক্তঝরা সংগ্রামের পথ বেয়ে। মুক্ত আকাশে উড়েছিল লাল-সবুজের ঝান্ডা। সেই বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্নে চোখ রাখা বাংলাদেশ আবারও জানান দিল আমরাই সেরা। বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছে পুরো জাতি।

দক্ষিণ কোরিয়া একটি উন্নত দেশ। এককথায় সবাই বলে স্বপ্নের দেশ কোরিয়া। আমি বলি কর্মের দেশ এই কোরিয়া। কর্ম করলে স্বপ্ন এমনি এসে ধরা দেয়। ধরা পড়া আনন্দের মাঝেই স্বপ্নের বীজ বোনা থাকে।

উন্নত জীবনযাপনে যা কিছুই প্রয়োজন, তার সবকিছুই এখানে হাতের মুঠোয়। এত কিছুর পরও চার বছর ধরে আমার চোখে দেখা কোরিয়াকে দেখলে মনে হয় আমার প্রিয় মাতৃভূমিই সেরা। কিন্তু কেন…? কী আছে আর কী নেই? আছে প্রচণ্ড কষাকষির মনোভাবের হিসাব–নিকাশ।

সামনে কেউ দাঁড়িয়ে যখন অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে আমার দেশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, সত্যি হৃদয়ের মণিকোঠায় চরমভাবে আঘাত লাগে। সাধারণত যাঁরা স্বদেশ ত্যাগ করে অন্য কোনো ভালো দেশে পাড়ি জমান, তখন একটু ব্যতিক্রম কিছু দেখলেই বাংলাদেশের সঙ্গে পার্থক্য খুঁজে বেড়ান। যেমন একটি দেশের উন্নত জীবনযাপন, উন্নত প্রযুক্তি, যাতায়াতব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, আইন ও সভ্যতা। আমার কাছে মনে হয়, এই কয়টি বিষয় নিয়ে একটি উন্নত দেশের সঙ্গে স্বদেশের মিল-অমিল খুঁজে বেড়াই আমরা।

একটি দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড মজবুত হলে সে দেশের উন্নত জীবনযাপন, উন্নত প্রযুক্তি, যাতায়াতব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সবকিছুই পরিবর্তন ঘটবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজকের কোরিয়ার উন্নত হওয়ার পেছনের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এ দেশের প্রতিটি স্তরে আইনের শতভাগ সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ আর কঠোর পরিশ্রম পাল্টে দিয়েছে পুরো কোরীয় জাতিকে।

আইনের প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল। আইনকে সবাই ভয় পায়, তাই মেনেও চলে। একমাত্র আইনের ভয়ে কেউ কাউকে ফুলের টোকাও দেয় না। যদিও আইন কঠোর হওয়ার আগে মালিক শ্রমিকদের ওপর গায়ে হাত তোলার নজিরও আছে এখানে। আর যদি আইনের সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ এ দেশে না হতো, তাহলে হয়তো এমন উন্নত শিখরে থাকত না কোরিয়া। আসুন মূল কথায় ফিরে যাই…। তবে স্বপ্ন দেখি আমার দেশেও একদিন প্রতিটি স্তরে আইনের সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ হবে। তখন স্বাধীনতার পরিপূর্ণ স্বাদ পাব।

কোরীয়রা অধিকতর এক স্বার্থপর জাতি। বিনা প্রয়োজনে কখনো কিছু করে না। সবকিছু করার পেছনে কোনো বা কোনো উদ্দেশ্য থাকে। সব উপকারের পেছনে একটি গোপন স্বার্থ লুকিয়ে থাকে।

নিজের মা–বাবাকেও পরিশ্রম না করলে খাবার বা পয়সা দেয় না। কোরিয়ার বাজারের রাস্তার পাশে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি বিক্রি করতেও দেখা যায় আশি থেকে এক শ বছর বয়সী বৃদ্ধাদের। ছেলের কারখানায় বাবা মাসিক বেতনের চুক্তিতে কাজ করেন। এক দিন কাজে না এলে বাবার মাসের বেতন কর্তন করেন নিজের সন্তান। বয়স্ক মা কাজ করেন অন্যের কারখানাতে।

অধিকাংশ সন্তানই মা–বাবা ছেড়ে আলাদা বসবাস করতে পছন্দ করেন কোরীয়রা। একটু চোখ বন্ধ করলে বোঝা যায় আমার দেশের সন্তানেরা তার মা–বাবার প্রতি কতটুকুই না আন্তরিক। বৃদ্ধ মা–বাবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য প্রয়োজনে দেশত্যাগ করে নিজের জীবনের সব স্বাদ–আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে দেন। তাই তো বলতে হয়ে, আমার দেশ আর দেশের সূর্যসন্তানেরাই সেরা।

কোরিয়ায় আরাম-আয়েশ, সুযোগ-সুবিধা, প্রাচুর্য কোনো কিছুরই কমতি নেই। কিন্তু প্রাচুর্যই কি জীবনের সব? এত কিছুর মধ্যে থেকেও আমি আমার জন্মভূমিকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলে থাকতে পারি না। আমি বড় বেশি ভালোবাসি আমার দেশকে, ভালোবাসি আমার দেশের মানুষকে। খুঁজে ফিরি আমার দেশের মাটির গন্ধ, ধুলাময় অলিগলি পথ, গাছপালা সবকিছু। কী অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা আমার জন্মভূমি!

সব সময় বাংলাদেশি খাবার খুব মিস করি। এখানে খাবার মানেই সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ। বাইরে কোরিয়ান রেস্তোরাঁগুলোতে খাবার মানেই শূকরের মাংসের ছোঁয়া। বাইরে থেকে একটা চিপস খাব, তা–ও ভালো করে পড়ে দেখতে হবে কী কী উপাদানের তৈরি সেই খাবার। বিশেষ করে আমরা যারা মুসলিম, তারা অনেকটাই সাবধানতার সঙ্গে খাবার খেতে হয়। কিন্তু সুদূর প্রবাসজীবনে বেশির ভাগ সময়ে স্বাভাবিকভাবেই ভোজনটা যে রসের হয়ে ওঠে না, সেটা বোধ হয় আঁচ করাই যায়। বাইরে দেশি খাবার পাওয়া যায় না। কিছু কিছু হালাল রেস্তোরাঁ আছে, সেগুলো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতোই ঠেকে। গর্ব করে বলতে পারি, মাছে–ভাতে বাঙালি আমরাই সেরা।

প্রতিটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে মানবসম্পদ। আর মানবসম্পদকে প্রকৃত সম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য মানবের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, জ্ঞানগত এবং পেশাগত দক্ষতা, কর্মসংস্থান—এ রকম নানা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উন্নতির প্রয়োজন। এসবের অভাব দেখা দিলে মানবসম্পদ আপদে পরিণত হতে পারে।

মানবসম্পদ উন্নয়নের কেন্দ্রে থাকেন তরুণেরা। তাঁরাই শক্তি, তাঁরাই আশা-ভরসা, তাঁরাই ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের দিকে তাকালে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হারানোর বিষয়টি চোখে পড়ার মতো। কোটি কোটি মানবসম্পদ দেশের বাইরে পাঠিয়ে সেই দেশগুলো উন্নত থেকে আরও উন্নত হচ্ছে। আর মাতৃভূমি শুধু রেমিট্যান্স নিয়ে সন্তুষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। যদিও দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের ভূমিকা অক্সিজেনের মতো।

অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড মজবুত আর বেকারত্বের অবসান ঘটাতে উদ্যোক্তা হওয়ার বিকল্প নেই। একজন উদ্যোক্তার কারণে বেশ কিছু মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়। বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম দৈনিক প্রথম আলোতে আমি প্রায় দেখি বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ভিডিও তৈরি করে প্রচার করে, যার কারণে অনেকেরে মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন মনের গভীরে লালন করেন। তরুণ উদ্যোক্তা নতুন উদ্ভাবন নিয়ে কাজ শুরু করলে এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বিশ্বের বুকে হব আমরাই সেরা।

তৈরি পোশাক কারখানা
ফাইল ছবি

আমি এখানে আছি ঠিকই, কিন্তু মনটা পড়ে আছে আমার জন্মভূমি সুদূর বাংলাদেশে। যে মাটিতে আমি জন্মেছি, যে দেশের আলো–বাতাসে আমি বেড়ে উঠেছি। যে দেশে আমার সমস্ত আত্মা আর অস্তিত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে, মনটা তো সেখানেই। যেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আমার শৈশব, কৈশোর ও সারা জীবনের মধুময় সব স্মৃতি। যেই মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন আমার পরম আত্মীয়–পরিজন।

সংসারজীবন, সন্তান, মা–বাবা সবই তো দেশে। কোরিয়াতে আরাম-আয়েশ, সুযোগ-সুবিধা, কোনো কিছুরই কমতি নেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় টাকাপয়সা কি জীবনের সব? সবকিছুর মধ্যেও জন্মভূমিকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলে থাকতে পারি না। আমি বড় বেশি ভালোবাসি আমার দেশকে, ভালোবাসি আমার দেশের মানুষকে। খুঁজে ফিরি আমার দেশের মাটির গন্ধ, ধুলাময় অলিগলি পথ, গাছপালা সবকিছু। কী অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা আমার জন্মভূমি! কী নিবিড় সখ্য ছিল সবকিছুর সঙ্গে। যেখানে বসে গাওয়া যায়, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি...। বাংলাদেশ নামের একরত্তি শব্দটা হৃদয়ের গভীরে গিয়ে দোলা দেয়। বুকটা তখন খাঁ খাঁ করে কখন দেশে যাব মুক্ত বাতাতে ঘুরে বেড়াব। দেশকে স্বাধীন করতে যাঁরা অবদান রেখেছিলেন, তাঁদের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।