আমার ঈদ

বিমানবন্দরে লেখক ও আকরাম
বিমানবন্দরে লেখক ও আকরাম

সারা রাত ডিউটি করে উবারে বুকিং দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ট্যাক্সির জন্য। পাঁচ মিনিটেই ট্যাক্সি এসে পৌঁছানোর কথা। উদ্দেশ্য তাড়াহুড়া করে মসজিদে গিয়ে ঈদের জামাতে শরিক হওয়া। এই সময় মোবাইল রিংটোন বেজে উঠতেই দেখি সহকর্মী আকরামের কল। রিসিভ করতেই আকরাম কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, হ্যালো ভাই। তার কণ্ঠ শুনে আমি আঁতকে উঠলাম। ব্যাপার কী, ঈদের দিন ওর কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন!
বললাম, আকরাম ভাই কি হয়েছে, আপনি কাঁদছেন কেন?
কিছুক্ষণ কেঁদে তিনি জবাব দিলেন ভাই আমার বাবা মারা গেছে।
এই কথাটা শোনার পর আমার গলায় দলা পাকিয়ে এল কি জবাব দেব বা কি বলে সান্ত্বনা দেব, তা বুঝতে পারলাম না। মাথার ভেতর বর্ণমালা ভেসে বেড়াচ্ছে। বর্ণমালাগুলো যে জোড়া লাগিয়ে যে শব্দ তৈরি করে মনের ভাব প্রকাশ করব, তা পেরে উঠলাম না। শুধু বললাম, আচ্ছা ভাই আপনি থাকেন, আমি আর আমিনুল আসছি।
কল কেটে দেওয়ার পর নিজের অজান্তে চোখের কোণে জমে থাকা পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। যার পরিচয়ে আকরাম সমাজে পরিচিত হয়েছিল, যিনি আকরামকে বটবৃক্ষের মতো এত দিন আগলে রেখেছিলেন, তাকে ভরসা দিয়েছিলেন তুমি একা নও, তোমার সঙ্গে তোমার বাবা আছে। সেই আপন মানুষ বাবাকে আকরাম আজ হারিয়েছে। তাই সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষায় খুঁজে পেলাম না।
সঙ্গে সঙ্গে এমদাদকে ফোন দিয়ে বললাম ভাই আপনি কোথায় আছেন? বললেন তিনি এখন মসজিদে আছেন। তাকে বললাম, ভাই আকরাম ভাইয়ের বাবা মারা গেছে। আপনি কি কষ্ট করে বাসায় গিয়ে ওর পাশে দাঁড়াবেন।
মসজিদ থেকে বাসা ১৫ মিনিটের রাস্তা। তিনি না করলেন না। আমার কথা শুনে শোকার্ত আকরামের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলেন। একজন শোকার্ত মানুষের পাশে যদি একজন চরম শত্রুও দাঁড়ায়, তখন শোকার্ত মানুষটার তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন মনে হয়। শোকার্ত মানুষটা চরম শত্রুর গলা জড়িয়ে সব শোক প্রকাশ করে নিজেকে হালকা অনুভব করেন।

ট্যাক্সি থেকে নেমেই আমি আর আমিনুল আকরামের কাছে গেলাম। আকরাম ভাই আমাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এতক্ষণ কেঁদে কেঁদে তিনি ক্লান্ত ছিলেন। আমাকে দেখে যেন তার শোকটা প্রকাশের নতুন অবলম্বন খুঁজে পেল। তার কান্না দেখে রুমে উপস্থিত সবার চোখেই পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। এমদাদ, আমিনুল আর আমি আকরামকে সান্ত্বনা দিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে মসজিদে নিয়ে গেলাম। নামাজে দাঁড়িয়ে আকরাম আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল। আমি বাধা দিলাম না। কাঁদুক না সে, আজ তো তার কাঁদারই দিন। কেঁদে কেঁদে নিজেকে যতটা পারুক হালকা করুক।
নামাজ শেষে সুব্রত ভাই (আমাদের অফিসার) কল দিয়ে বললেন, ওমর ভাই নামাজ শেষ হলে আকরামকে নিয়ে অফিসে আসেন ১১টার দিকে। ওই সময় এইচআর তার পাসপোর্ট দেবে। আর শোনেন টিকিট কেনার দরকার নেই। আমি অনলাইনে টিকিট কিনে ফেলেছি। সকালে আকরামের বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি আমাদের বস ওসমান ভাইকে বলেছিলাম, ভাই আকরামের বাবা মারা গেছে, ও আজ ইমার্জেন্সি ছুটিতে বাড়ি যেতে চায়। প্লিজ এ ব্যাপারে আপনি সাহায্য করুন। বস বলেছিলেন, ঠিক আছে আপনি সুব্রত ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। উনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। ওসমান ভাই আর সুব্রত ভাই যে এত দ্রুত সব ব্যবস্থা করে দেবেন তা ভাবতেই পারিনি। ওসমান ভাই ও সুব্রত ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয়ে এল।
নামাজ শেষে অফিসে গিয়ে পাসপোর্ট আর টিকিট আনতে গেলাম। সুব্রত ভাই টিকিট হাতে দিয়ে আকরাম ভাইকে বললেন, টিকিটের টাকা এখন লাগবে না। বাড়ি থেকে ফিরে দিলেই হবে। লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আবারও মনটা ভরে উঠল। পাসপোর্ট আর টিকিট নিয়ে বাসায় ফিরে খুব ক্লান্ত বোধ করলাম। সারা রাত না ঘুমানোই এর কারণ। তারপরও ক্লান্তকে পাত্তা দিলাম না। হালকা কিছু খেয়ে আকরামকে নিয়ে এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশে রওনা দিলাম। বাইরে পরিবেশটা আগের মতোই আছে। সবাই যার যার মতো আনন্দ করছে। আকরামের বুকের ভেতর কান্নার স্রোত বয়ে যাচ্ছে তা কেউ টের পাচ্ছে না। মৃত্যু একটি চিরাচরিত নিয়ম হলেও কিছু কিছু মৃত্যু মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। আগের রাতেও নাকি আকরাম তার বাবার সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু মৃত্যু নামক ভয়ংকর বস্তুটি রাতের অন্ধকারে সবার অজান্তে তার গৃহে হামলা দিল। যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক আকরামের বাবা।

*এম ওমর ফারুকী (শিপন): সিঙ্গাপুরপ্রবাসী।