আমার আম্মা

তবুও পড়ে থাকে কিছু এলোমেলো সময়, ফেলে আসা ছেলেবেলার পুতুলের বাক্সে। নিউইয়র্কের বোহিমিয়ান জীবনে বসে মনে পড়ে, আমাদের বাড়িতে তখন আব্বু এই আছেন-এই নেই। পুলিশের চাকরি। আজ ঢাকায়, তো কাল ময়মনসিংহে। আম্মা পুরো সংসার আর আমাদের তিন ভাই-বোনকে একাই সামলান। মাঝে মাঝে আব্বুকে বাসায় না দেখলে আমি প্রায় ‘আব্বু কোথায়’ এই প্রশ্ন করে করে আম্মাকে বিরক্ত করে তুলতাম। বড় ভাই তখন কারও কথা তেমন একটা শুনত না, তবে আম্মার ভয়ে ঘরের ভেতর চুপ করে থাকত। বাসা থেকে বেরোলেই ভাই আমার বাঘের বাচ্চা। আর মেজো ভাই যে আমার ইমিডিয়েট বড়, সে সারা দিন পড়তে পড়তে সব বই খাতা ছিঁড়ে ফেলত। আম্মা নতুন বই কিনে দিয়ে বলতেন, ফাইনাল পরীক্ষার আগ পর্যন্ত যেন বইগুলোর আয়ু থাকে। আম্মা প্রায়ই আব্বুকে এসটিডি কল করে বলতেন, আর পারি না তোমার সংসারের বোঝা টানতে।

আম্মার প্রতিদিন সকালের প্রথম কাজ ছিল, ঘুম থেকে জেগেই মিডিয়াম ভলিউমে গান ছেড়ে দেওয়া। প্রতিদিন সকালে ‘শিউলি ফুল শিউলি ফুল, এমনও ভুল’ শুনেই ঘুম থেকে জাগতাম। আম্মা গুনগুন করে গাইতেন আর বারান্দায় হাঁটতেন। আমি চুপ করে দেখতাম। সকালে ভাইদের স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে বসতেন অ, আ; এ, বি, সি পড়াতে। এরপর নুরুল ইসলাম নামের আমাদের কেয়ারটেকারের কাছে বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে পেপার নিয়ে বসতেন। দুপুরের রান্নার পর ভাইয়েরা স্কুল থেকে ফিরলে, খাবারের টেবিলে সবাইকে নিয়ে খেতে বসতেন। দুপুরে খাবার পর আম্মা ভাইদের হোমওয়ার্ক করতে দিয়ে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতে যেতেন। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে কখনো মাসুদ রানা, কখনো দস্যু বনহুর সিরিজ পড়তে পড়তে আম্মা নিজেও ঘুমিয়ে পড়তেন।

আম্মা তখন শাড়ি পড়তে খুব ভালোবাসতেন। একটা শাড়ি দ্বিতীয়বার আর পড়তে দেখিনি। মাড় দেওয়া টান টান ইন্ডিয়ান সুতির শাড়ি পড়ে আম্মা চুল ছেড়ে দিয়ে বিকেলে বারান্দায় বসে চা খেতেন আর বেগম পত্রিকায় ডুবে থাকতেন। মাঝে মাঝে বিকেলে আম্মা আব্বুকে ল্যান্ড ফোন থেকে অফিসে কল করে বলতেন, গাড়ি আর একজন সিপাহি পাঠিয়ে দাও, বাচ্চাদের নিয়ে এক্সিবিশন থেকে ঘুরে আসি। কখনো বাসার পাশের কনসার্টে, কখনো বড় ভাইয়ের মঞ্চ নাটক দেখতে ছুটে যাওয়া। সেই সব দিনগুলো। সময় মানুষকে কতটা পরিবর্তন করে দেয়। সময়ের চাহিদা জীবনের চাহিদার চেয়েও কেমন যেন বড় হয়ে যায়।

আমাদের আম্মা খুব বেশি লেখাপড়া না জানলেও অনেক জ্ঞানী। কথা বলেন চাঁদপুরের ভাষায়। আব্বু ঠাট্টা করে বলতেন পুরোটা জীবন ঢাকায় থেকেও শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শিখলে না? আম্মা হেসে বলতেন, তোমার শুদ্ধ কথা বইয়ের পাতায় তুইলা রাখো। আম্মা এখনো গ্রাম্য বাংলা বলেন। আমার ভালোই লাগে। ভালো লাগে আমার আম্মার সৌন্দর্য। আমার দেখা এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী আমার মা। মায়ের কাছে আমি চিরঋণী।

ক্ষুদ্র এ জীবনে যা কিছুই অর্জন আমার, তার পুরোটাই আম্মার কাছ থেকে পাওয়া। আম্মা তোমাকে কখনো বলা হয়নি—‘ইউ আর দ্য নম্বর ওয়ান ওয়ার্ল্ড বেস্ট আম্মা।’