আমাদের বিমানবন্দর

বিমানটি তখন ভূমি থেকে ৩৮ হাজার ফুট ওপরে। ভারত মহাসাগরের পাশ ঘেঁষে ঘণ্টায় ৯০০ কিমি গতিতে ছুটে চলছে। স্থানীয় সময় রাত নয়টা। যাত্রীদের অনেকেই ঘুমাচ্ছেন। কেউ কেউ ছবি দেখছেন বা গান শুনছেন। সামনের দিকে এক মা তাঁর সন্তান সামলানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। শিশুটিও পণ করেছে, সে কোনো কথাই শুনবে না। কান্নার গতি যেন বিমানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে।
আমি কোনো কিছুতেই স্থির হয়ে মনোযোগ দিতে পারছি না। মনের মধ্যে কোনো চিন্তাই কাজ করছে না। এক ভাবনা থেকে নিমিষেই অন্য ভাবনায় চলে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ আগে সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি বিমানবন্দরে বসেছিলাম। কী সুন্দর সবকিছু। পুরো মেঝে নরম পরিষ্কার কার্পেটে মোড়া। এমনকি এই কার্পেটের যে কোথাও জোড়া লাগানো আছে, সেটাও চোখে পড়ে না। মাঝেমধ্যেই শোভা পাচ্ছে প্রাকৃতিক ফুলের গাছে ফুলের গুচ্ছ। বিমানবন্দরের মাঝখানে দোতলায় চমৎকার একটি পার্ক। সেখানে অনেকেই ছবি তুলছেন। আমারও ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সঙ্গে কেউ নেই। সেলফিতেও হাত পাকা নয়। আবার কাউকে অনুরোধ করব একটা ছবি তুলে দিতে তাতেও লজ্জা করছিল। বিমানবন্দরটি পরিচালিত হচ্ছে একদল দক্ষ জনবল দিয়ে। তাঁদের চেষ্টাই যেন কীভাবে দ্রুত সেবা দেওয়া যায়। তাঁরা কথাও এত দ্রুত বলেন যে মাঝেমধ্যে বুঝতে হিমশিম খেতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়াবাড়ি রকমের হলেও খারাপ লাগে না নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে।
দুপুরের আগে চেকইন করেছিলাম ম্যানিলা বিমানবন্দরে। সেখানে অধিকাংশ কর্মকর্তাই তরুণ-তরুণী। খুব সামান্য কথায় হাসিমুখে দ্রুত যাত্রীসেবায় ব্যস্ত। প্রশ্ন করে অপদস্ত করতে এঁরা পটু নন। ম্যানিলার এক নম্বর টার্মিনালটি মূলত আন্তর্জাতিক বিমান ওঠানামার জন্য ব্যবহৃত হয়। বিমানবন্দরটি বেশ পুরোনো। প্রতিদিন অসংখ্য বিমান ওঠানামা করে। অল্প পরিসরে চাপ সামলাতে হিমশিম খায়। কিন্তু কোথাও চেষ্টার ত্রুটি নেই। নেই কোনো দুর্গন্ধ। তার পরও তারা আরও ভালো সেবা নিশ্চিত করতে কিছু কাজ করতে চায়। তাই নবনির্মিত তিন নম্বর টার্মিনালে আন্তর্জাতিক সেবা চলছে। এই বিমানবন্দরটি অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলের জন্য নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে।
এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখে ভাসে নিজের জন্মভূমির বিমানবন্দরের চিত্র। একটি বিমানবন্দর সেই দেশের মুখের মতো। বিমানবন্দর দেখলেই সেই দেশ সম্পর্কে অনেকটা ধারণা পাওয়া যায়। আমাদের বিমানবন্দরে নেমে কি আসলেই কোনো ভালো ধারণা পাওয়া সম্ভব! বিমানবন্দরে পা দিতেই চোখে পড়বে একদল বিশৃঙ্খল মানুষের অপরিপক্ব ও অগোছালো কর্মযজ্ঞ। অথচ এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশই বয়সে বেশ পরিপক্ব। চোখে পড়বে অপরিচ্ছন্নতা, সেটা বাথরুম থেকে শুরু করে সেবাদানকারীদের পোশাক এবং কথাবার্তাতেও লক্ষণীয়। অনেক হ্যাপা শেষে ব্যাগের জন্য অধীর অপেক্ষায় থেকে যখন ক্লান্তি চলে আসবে হয়তো আবিষ্কার হবে ব্যাগটি আসেনি অথবা মিসিং। ব্যাগ না আসাটা যেকোনো বিমানের ক্ষেত্রেই হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ দেশে ব্যাগ সময়মতো না এলে বিমানবন্দর থেকে ক্ষমা চেয়ে যাত্রীদের বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। অথচ আমাদের ক্ষেত্রে যাত্রীকে পুনরায় নিজ গরজে গিয়ে বিমানবন্দর থেকে সংগ্রহ করতে হয়।
আমরা তো চাই আমাদের দেশটি নিয়ে সবার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। চাই আমাদের অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের অগ্রগতি হোক। কিন্তু কোনো বিদেশি আমাদের বিমানবন্দরের সেবা পেয়ে কি প্রশংসা করার মতো কিছু পাবে!
আমাদের বিমানবন্দরটি বেশ পুরোনো। অনেক কিছুর সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু আন্তরিকতার তো সীমাবদ্ধতা থাকার কথা নয়। আর আন্তরিকতা থাকলে ছোট্ট এই বিমানবন্দরকে কি ঝকঝকে তকতকে রাখা সম্ভব নয়। একটু হাসিমুখে হয়রানিবিহীন দ্রুত সেবা কি অসম্ভব!
ককপিট থেকে সিটবেল্ট বাঁধার ঘোষণা আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। জানালা দিয়ে নিচে তাকাতেই চোখে পড়ল অসংখ্য বিজলী বাতির মিটিমিটি আলো। বুকের মধ্যে এক ভালো লাগার অনুভূতি। এই আলো আমার দেশের আলো, আমার মাতৃভূমির আলো। একটু পরেই বিমানের চাকাটি স্পর্শ করবে আমার মাতৃভূমিতে। হয়তো একদিন আমাদের এই বিমানবন্দর আর সেবা নিয়েও আমাদের ভালো লাগার অনুভূতি ও অহংকার হবে।
মুরাদুল ইসলাম
ম্যানিলা, ফিলিপাইন।