আমাদের নগরীতে হঠাৎ করকার ছোঁয়া
আমি যে অফিসে কাজ করি সেটা দ্বাদশ তলাতে। আমার ডেস্কটা জানালার পাশে। আমি সব সময়েই জানালার ব্লাইন্ড উঠিয়ে রাখি। জানালা দিয়ে গোটা অ্যাডিলেড শহরটা দেখা যায়। বেশ দূরে সারি সারি পাহাড়। পাহাড়ের ঢালে সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর। আমাদের বাড়িটাও পাহাড়ের ঢালে। এখন শীতের শেষ, বসন্তের শুরু। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জানালা দিয়ে বাইরে দেখি। আমার পাশের ডেস্কের সহকর্মী শেন ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকায়। হয়তো মনে মনে ভাবে, এই লোকটার সমস্যাটা কী?
আজ দুপুরে দেখি আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ। ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। হঠাৎ করেই বাংলাদেশের কালবৈশাখীর মতো ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমি মুগ্ধ গলায় শেনকে বললাম, শেন দেখ বাইরে কী অবস্থা!
শেন আমার উচ্ছ্বাসে খুব একটা আগ্রহ দেখাল না, বলল, বাজে আবহাওয়া। এটা দেখে এতে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কী আছে?
আমি বললাম, আমি ঝড়-বাদলার দেশের মানুষ। ঝড়বৃষ্টি দেখলে আমাদের মনে এক ধরনের আনন্দ হয়। তুমি বুঝতে পারবে না।
শেন বলল, ও আচ্ছা। আজকে তাহলে তোমার অনেক আনন্দের দিন। খুব ভালো, আনন্দের দরকার আছে। আমরা আনন্দ কিনি টাকা দিয়ে আর তুমি পাচ্ছ একেবারে বিনে পয়সায়।
খুব একটা মজার কথা বলেছে ভেবে হা–হা করে হাসতে লাগল শেন। আর আমার মনে হলো এক থাবড়া দিয়ে দাঁত ফেলে দিই।
এই সময় আমার স্ত্রীর ফোন এল। বলল, এই শোন, তুমি কি অরণ্যকে স্কুল থেকে আনতে পারবে? এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে আমি বের হতে পারব না।
আমার স্ত্রী বিদ্যুৎ চমকানোকে খুব ভয় পায়। তার জন্য এই আবহাওয়াতে এক কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে আমার ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে আসা মোটামুটি অসম্ভব একটা ব্যাপার। আমি ম্যানেজারকে সমস্যার কথা বললাম। এরা আবেগহীন জাতি হলেও পরিবারকে সবার চাইতে প্রাধান্য দেয়—ফ্যামিলি ফার্স্ট। ম্যানেজার বলল, কোনো চিন্তা করো না, এখনই বাসাতে চলে যাও।
বাসে আমার পছন্দের জায়গা হলো একেবারে পেছনের সারির সবচেয়ে বাঁ পাশের সিট। আমি আরাম করে সামনের সিটের পেছনে হাঁটু দিয়ে চেপে বসে ঘুমানোর চেষ্টা করি। অনেকবার এমনও হয়েছে যে, আমি যে স্টপেজে নামব সেটা ছেড়ে বাস শেষ স্টপেজে চলে গিয়েছে। ড্রাইভার এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। কিন্তু আজকে আমার ঘুম আসল না। বাসের জানালা দিয়ে ঝুম বৃষ্টি দেখছি। এ রকম দিনে কেন জানি কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় বাসাতে গিয়ে ডিম ভাজা দিয়ে খিচুড়ি খেয়ে বিছানাতে শুয়ে কোনো একটা বই পড়ি।
বৃষ্টি মনে হয় বেড়েছে। আশপাশে কোথাও বাজ পড়ল। বাসের ছাদে বৃষ্টি পড়ার শব্দ হচ্ছে। জানালার কাচে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে। জানালা দিয়ে বাইরেটা কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। হঠাৎ করেই বাসের ছাদে শব্দ অনেক বেড়ে গেল। আমার পাশের সহযাত্রী উত্তেজিত গলায় বলল, ওহ মাই গড, হেইল স্টর্ম! বাসের ছাদের শব্দের রহস্য বোঝা গেল, প্রচণ্ড শিলা বৃষ্টি হচ্ছে। ছোট ছোট শিলা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আশপাশের সবকিছু সাদা হয়ে গেল। আমি বাংলাদেশে শিলা বৃষ্টি দেখেছি। কিন্তু আজকেরটা সম্পূর্ণ আলাদা। মানুষজন শিলা বৃষ্টির মধ্যে মহাআনন্দে ছোটাছুটি করছে, ছবি তুলছে। আমার পাশের গোমড়া মুখের লোকটিও মুগ্ধ দৃষ্টিতে শিলা বৃষ্টি দেখছে। আমি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। হঠাৎ করেই এই শহর, শহরের মানুষগুলোকে খুব কাছের মনে হলো।