আমরা আসলে কেমন বাঙালি
আমি একজন সাধারণ বাঙালি প্রবাসী। বসবাস করছি ইতালির মিলান শহরে। অন্য সব প্রবাসীর মতো আমারও মনটা পড়ে থাকে বাংলাদেশে আর দেহটা ইতালিতে।
ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় কখন যাব মাতৃভূমিতে। আতিথেয়তায় ভরপুর আমার দেশের মানুষগুলোর কথা ভাবি। প্রবাসজীবনে কেউ পরিচয় জানতে চাইলে বুক ফুলিয়ে নিজের দেশের নাম বলি বাংলাদেশ; সঙ্গে যোগ করি দেশের দুটো ভালো ভালো কথা।
দেশকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার সামান্য সুযোগও হাতছাড়া করতে চায় না কোনো বাঙালি।
এটাই বাঙালির বৈশিষ্ট্য, এই বৈশিষ্ট্য বাঙালি জাতিকে বেঁধে রেখেছে আত্মার বন্ধনে। যেকোনো জায়গায়, যেকোনো দেশে, যেকোনো পরিস্থিতিতে এক বাঙালি আরেক বাঙালির জন্য অনুভব করে তীব্র আবেগ, অদৃশ্য ভালোবাসার শক্তি। এটুকু অবলম্বন করে হাজার কিলোমিটার দূরে পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের অনুপস্থিতিতে জীবিকা নির্বাহ করে চলছি।
সবকিছুই ঠিক চলছিল, হঠাৎ গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে কোভিড-১৯ ভাইরাসের ভয়াবহ তাণ্ডব শুরু হয় ইতালিতে। কোনোরকম পূর্বপরিকল্পনা কিংবা পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করার সুযোগ পায়নি দেশটি।
ভূমিকম্পের মতোই বলা নেই কওয়া নেই ভাইরাস আক্রমণে হু হু করে বেড়ে চলছিল আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যুহার।
বিশ্ববাসীর চোখ তখন ইতালিয়ান গণমাধ্যমে।
অসম্ভব ভদ্র, আনন্দপ্রিয় এবং হাসিখুশি ইতালিয়ান জাতি থতমত খেয়ে গেল। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বন্ধ করে দিল প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরের সপ্তাহেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল প্রতিটি রেস্তোরাঁ এবং পর্যটনকেন্দ্র।
প্রচুর মানুষ সাময়িকভাবে চাকরি হারাল। যদিও সরকারিভাবে বারবার জানানো হচ্ছিল কোভিড-১৯–এর কারণে কোনো মানুষকেই চাকরিচ্যুত করা হবে না। কিন্তু সাময়িক এই দুর্যোগে স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে পড়েছিল অসংখ্য চাকরি হারানো মানুষ।
সরকারিভাবে আরও বলা হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট ভাতা প্রদান করা হবে প্রতিটি চাকরি হারানো মানুষকে, সবাই যেন এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগে ইতালিকে সাহায্য করে।
কী সেই সাহায্য?
তা হলো নিরাপদভাবে যার যার বাসায় বসে থাকা। এইটুকু সাহায্য কেবল ইতালি চেয়েছিল তার বুকে বসবাস করা প্রতিটি দেশি বিদেশি জনগণের কাছে।
আমরা সাধারণ বাঙালি এই কঠিন সময়ে বিচলিত হলেও ইতালির ওপর ভরসা হারাতে পারিনি। তখন আমাদের বাংলাদেশ একেবারেই করোনামুক্ত ছিল, যার কারণে পরিবারের লোকজন ও পরিচিতজনেরা আহ্বান জানিয়েছিল দেশে গিয়ে নিরাপদে থাকার।
জানি না কেন একবারের জন্যও মনে হয়নি যে ইতালিতে নিরাপদে নেই আমরা। বরং পরিবারের লোকদের বুঝিয়েছিলাম, ইতালির ওপর ভরসা আছে। ইউরোপের সেরা চিকিৎসাব্যবস্থার দেশগুলোর একটি ইতালি। ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও হয়তো পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাব। আর তা যদি না–ও পাই, মৃত্যু যেখানে লেখা আছে সেখানেই হবে।
তার থেকেও বড় কথা বাংলাদেশ তখন করোনামুক্ত। ভাইরাসে আক্রান্ত দেশ থেকে গিয়ে যদি নিজের দেশটাকেই অনিচ্ছাবশত ভাইরাস দিয়ে আসি? এই চিন্তাটা মনের ভেতর কুরে কুরে খাচ্ছিল।
বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্রতর স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। দেশকে বাঁচানোর জন্যই দেশ থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কিন্তু আমরা সব বাঙালি একই রকম ভাবনা ভাবতে পারিনি। আমাদের মধ্যেই কিছু বাঙালি ছুটে গিয়েছিল বাংলাদেশে। নিজের দেশে যেতে কোনো বাধা নেই, বাংলাদেশ বুকে আগলে ধরেছিল এই ইতালিফেরত প্রবাসীদের।
শুধু অধিক সচেতনতা অবলম্বনে অনুরোধ করেছিল ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার। কিন্তু আমরা আসলে কী চেয়েছিলাম তা হয়তো আমরাই জানি না। তাই ১৪ দিনের সেই কোয়ারেন্টিন নিয়ম মানতে আমরা নারাজ ছিলাম।
একটা জাতির বিশেষ একজন যখন কোনো ভালো কাজ করে, সে আনন্দ যেমন সমগ্র জাতির, বিশেষ একজন যখন একটা খারাপ কাজ করে, সেই লজ্জা ও অপমানও সমগ্র জাতির।
ইতালির প্রবাসীর বাংলাদেশি পুলিশের সঙ্গে তুলকালাম আচরণ এবং কোয়ারেন্টিন মানতে না চাওয়ার দোষে শুধু হাতে গোনা কজন বাঙালিই দুষ্ট হয়নি। তুমুল করোনাভাইরাস ভয়াবহতায় দুরু দুরু বুকে বাসার দরজা–জানালা বন্ধ করে ইতালিতে বসে থাকা আমরা সব বাঙালি এই অপমান চুপ করে সহ্য করেছি।
কাটার ওপর নুনের ছিটার মতো খুব দ্রুতই ইতালি প্রবাসীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ছড়িয়ে গেল করোনাভাইরাস।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতালিয়ান বাঙালিদের নিয়ে কটুকথা, লজ্জার কথাও মুখ বুজে সহ্য করেছি।
ব্যাপারটা যেন এমন যে ইতালিতে থাকা সব বাঙালিই দায়ী বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য! দোষ না করেও অল্প কিছু মানুষের দোষের দায় কাঁধে তুলে নিলাম, আর শুধু প্রার্থনা করতে থাকলাম সুস্থ হোক ইতালি, সুস্থ
হোক বাংলাদেশ, নিপাত যাক করোনাভাইরাস!
তারপর মাস তিনেক নিজের চোখে দেখেছি ইতালির কর্মকাণ্ড। কীভাবে স্রোতের মতো মৃত্যুহারকে নিয়ন্ত্রণ করল ইতালি। কীভাবে কঠোর নিয়মের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া বাইরে বের হওয়া জনগণকে সামলাল। কীভাবে ইতালিবাসী মেনে নিল সরকার প্রদত্ত সব কঠোরতা। প্রতিটা ইতালিয়ান তাঁদের ব্যালকনিতে জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করে প্রকাশ করেছে ঐক্য। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে, গান গেয়ে একজন আরেকজনকে উদ্বুদ্ধ করেছে ঘরের বাইরে না যেতে। আর ইতালির সরকার এবং চিকিৎসাব্যবস্থা ২৪ ঘণ্টাকে বানিয়েছে ৪৮ ঘণ্টা! বিদ্যুৎবেগে পালন করেছে নিজেদের দায়িত্ব।
ফলাফল, গত জুন মাসের ৩ তারিখ থেকে ইতালিতে খুলে দেওয়া হয়েছে বেশির ভাগ অফিস, রেস্তোরাঁ, পর্যটনকেন্দ্র, শপিংমল।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া এই মুহূর্তে ইতালির সব ক্ষেত্র আগের মতো চলমান, ব্যস্ততায় ভরপুর।
কোভিড-১৯ কে বাগে এনে একপ্রকার খাঁচায় ভরেই ফেলেছিল ইতালি। কিন্তু বিধি বাম!
চার্টার্ড ফ্লাইটের ব্যবস্থা থাকায় এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া রেস্তোরাঁ এবং অন্যান্য কর্মক্ষেত্র চালু হওয়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষে ইতালিতে পুনরায় প্রবেশ করছে। ইতালি সরকার সর্বদা জনগণকে সাধুবাদ জানিয়েই বরণ করেছে। করোনা–পরবর্তী সতর্কতায় কেবল নির্দেশ করেছিল প্রতিটি বিমানপথে আসা মানুষকে সঙ্গে রাখতে হবে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট। অন্যথায় ইতালি প্রবেশ নয়।
আমরা বাঙালিরা সবকিছুর বিকল্প পন্থা খুঁজে বের করতে পছন্দ করি। আর সে জন্যই ভুল সার্টিফিকেট দেখিয়ে খুব বীরের বেশেই ইতালি প্রবেশ করে আনন্দে নিজেদের কাজ এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছিলাম।
কেউ কখনো নিজের শরীরের ব্যাপারে ভুল তথ্য দিতে পারে, এই আশঙ্কা ইতালির পুলিশের কল্পনায়ও ছিল না।
কিন্তু হঠাৎ ইতালি সরকার খেয়াল করল এত কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করা ভাইরাসটি খাঁচা ছেড়ে বের হলো বলে! আবার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেড়ে যাচ্ছিল ভাইরাসের ভয়াবহতা। একটু খতিয়ে দেখতেই বেরিয়ে এল সর্বোচ্চ লজ্জাজনক সংবাদ। কয়েকটি কারণের একটি বাংলাদেশ থেকে মিথ্যা রিপোর্ট নিয়ে প্রবেশ করছে বাঙালিরা!
প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকার প্রধান শিরোনাম বাংলাদেশিদের নিয়ে। অপমানজনক শিরোনাম, এ লজ্জা লুকানোর জায়গা নেই!
আমরা যারা এখানে জীবিকা নির্বাহ করছি, কিছু ইতালিয়ান মানুষের সঙ্গে জানা–পরিচয় আছে, রয়েছে কিছু বন্ধুবান্ধব। তারা আমাদের জিজ্ঞেস করছে আমাদের দেশ এ রকম ভুল সার্টিফিকেট কীভাবে দিচ্ছে? আমরা উত্তর দিতে পারছি না। কারণ উত্তর জানা নেই।
আমাদের নিয়ে রাগারাগি, হাসাহাসি হচ্ছে, দায়ী করা হচ্ছে পুনরায় করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য। আমরা মাথা নিচু করে আছি।
যেকোনো কাগজপত্র–সংক্রান্ত কাজে নিজের নামের পরেই দেশের নাম লিখতে হয়। আমরা আমাদের দেশের নামটি লেখার পর রেসিজমের শিকার হচ্ছি!
এ দায় কার? এ দায় পুরো বাঙালি জাতির। তিন মাসের জন্য বাংলাদেশ থেকে আবার সব ফ্লাইট বন্ধ। সেটাও ইতালিয়ান জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ পেয়েছে। কেন? ভুল সার্টিফিকেটের জন্য বাঙালি আজ অবিশ্বাসী।
নিজের ব্যাপারে ভুল তথ্য দেওয়া শুধু অন্যায় নয়, অপরাধ। এ অপরাধে দোষী আমরা সব বাঙালি। আমাদের মধ্যেই কেউ বাংলাদেশে গিয়ে ভাইরাস ছড়াচ্ছে, আমাদের মধ্যেই কেউ ভুল টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে ইতালি সরকারকে বিভ্রান্ত করছে!
কী পেয়েছি আমরা এসব কাজ করে? কী লাভ হলো আমাদের? অনেক কষ্ট করে অর্জন করা মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলাম!
আমরা আসলে কেমন বাঙালি? আমরা আসলে কী চাই? কোথায় এই প্রশ্নের উত্তর পাব?
*kazisabrinadu@gmail. com