আব্বা ও তার নাতির গল্প

আব্বা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আব্বার কথা মনে পড়লে ভীষণ কষ্ট হয়। প্রথমত নিজের জন্য, দ্বিতীয় আমাদের সন্তানদের জন্য। কারণ তারা অতি অল্প বয়সে দাদাকে হারিয়েছে। আর কখনো পাবে না দাদাকে। আমার আব্বা ও তার নাতিদের কথাই বলছি আজ।
প্রযুক্তির এই যুগে স্বজনরা পৃথিবীর যেখানে থাকুক ফোনে খবরাখবর নেওয়া যায়। পৃথিবীটা তো এখন হাতের মুঠোয়। চাইলে যখন-তখন যেকোনো দেশে, যেকোনো শহরে কল দেওয়া যায়। আপন মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায়। ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখের ভাব বিনিময় করা যায়। কিন্তু ওপারে কল দেওয়ার প্রযুক্তি এই দুনিয়ায় কখনো হবে না। আদরের এক শিশু আবরার জাওয়াদ খান। দুই বছর আট মাস বয়সে সে হারিয়েছে তার দাদাকে। জাওয়াদ তার দাদাকে দাদু ভাইয়া বলে ডাকত। দাদু ভাইয়ার মৃত্যুর দুই মাস পর মায়ের মোবাইলে দাদার ছবি দেখে দাদু ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। শুরু করে কান্না। সাড়ে ছয় বছর বয়সের তার বড়বোন বলল, দাদু ভাইয়া আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। এ কথা শুনে জাওয়াদ বলল, ওখানে কল দাও না! আমি দাদু ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলব।
জাওয়াদকে কীভাবে বোঝাবে যে, ওখানে কল দেওয়া যায় না। জাওয়াদের আব্বু-আম্মুরও যে ইচ্ছে করে কল দিতে!
জাওয়াদেরা গ্রামে থাকে। দাদু অসুস্থ হয়ে বাড়ি থেকে যখন চিকিৎসার জন্য শহরে ছিলেন, তখন সে ফোনে কথা বলত দাদু ভাইয়ার সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা বলার সময় দাদু অল্প কথা বলার পর আর কথা বলতে পারতেন না, কান্নার জন্য। প্রিয় নাতিকে ছেড়ে আছেন বলে তার ভীষণ কান্না আসত। সেই দাদু কিনা আর কখনো কথা বলবেন না, বলতে পারবেন না। ছোট্ট জাওয়াদের এখনো এটা বোঝার মতো বয়স হয়নি। দাদুর মৃত্যুর দশ মাস পরেও জাওয়াদ মনে করে দাদু ভাইয়া শহরে ডাক্তারের কাছে আছে। ভালো হলে বাড়িতে ফিরে আসবে। আবারও দাদু ভাইয়ার সঙ্গে খেলবে, যত সব আবদার আছে তা মেটাবে। কত গল্প করবে। আর দাদু ভাইয়ার অনেক অনেক আদর-সোহাগ পাবে।
এখনো তার মা বা অন্য কেউ তাকে বকা দিলে, তার কোনো চাওয়া পূর্ণ না করলে, জাওয়াদ বলে, দাদু ভাইয়া আসলে আমি বলে দেব; সব বলে দেব। জাওয়াদের সঙ্গে তার দাদার ছিল স্নেহ-ভালোবাসার গভীর সম্পর্ক। জাওয়াদের যত সব আবদার পূরণ করত দাদু ভাইয়া। জাওয়াদ যেটা যেটা খেতে পছন্দ করে তা বাজার থেকে নিয়ে আসা ছিল তার দাদু ভাইয়ার পছন্দের প্রধান কাজ। আম, জাম, লিচু, কলা, আঙুর, কমলা, চকলেট, কেক, বিস্কুট, জুস কত কিছুই-না আনত দাদু। ক্রিকেটের ব্যাট-বল, ফুটবলও আনত। কোনোটা হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে আবারও আনত। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে উঠোনে দৌড়ানোর জন্য ছাতা কিনে আনত। ছাতা একটা ভাঙলে আরেকটা নিয়ে আসত।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দাদুর সঙ্গে বসে চায়ে চুবিয়ে রুটি-বিস্কুট খাওয়া। এর ঘণ্টা দুয়েক পরে আবার পান্তাভাত খেত জাওয়াদ। দুপুরে ও রাতের খাবারও দাদু ভাইয়ার পাশে বসে খেত।
জাওয়াদ ছোট বলে ঘরের অন্য কারও মোবাইল ফোন নিয়ে তেমন খেলতে পারত না। নষ্ট করে ফেলবে মনে করে সবাই। কিন্তু, তার দাদুর মোবাইল ফোন নিয়ে খেলতে তেমন বাধা ছিল না। গেম খেলা, বড় ফুফিকে কল দেওয়া, নানুকে কল দেওয়া হতো দাদু ভাইয়ের মোবাইল ফোন দিয়ে। দাদুর হাত ধরে পাড়ার মধুর দোকানে গিয়ে চিপস ও এটা-সেটা কিনে নিত।
জাওয়াদকে ঘরের অন্য কেউ সামান্য বকা দিলেও দাদু ভাই মনে কষ্ট পেতেন। তার সামনে কেউ জাওয়াদকে বকা দিতে পারত না। জাওয়াদের দাদুর পরিপূর্ণ সুখের সংসারে তার কাছে জাওয়াদই ছিল সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে আদরের।
গত দশ মাস সে কথা বলতে পারছে না দাদু ভাইয়ার সঙ্গে; পারবেও না আর কখনো। কারণ, জাওয়াদের দাদু ভাইয়া হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে আসতে পারেননি। এসেছেন অপ্রত্যাশিত-অনাকাঙ্ক্ষিত লাশ হয়ে। এই কঠিন সত্য কথাটি শিশু জাওয়াদ বুঝতে না পারলেও বোঝে তাদের ঘরের বড়রা। তাই, ঘরের বড়রা চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কি করতে পারে।
ছোট্ট জাওয়াদ বড় হলেই বুঝতে পারবে তার দাদু ভাইয়া দুনিয়াতে নেই আর। সে তখন দাদুর জন্য শুধু দোয়া করবে। দাদু ভাইয়া যেখানে গেছে সেখানে যেন ভালো থাকেন। আর জাওয়াদ ভালো ছেলে হবে, যেন দাদু ভাইয়া ওখান থেকে ওকে দেখে খুশি হন।