আফগানিস্তানের মসনদে তালেবান, সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে

আফগানিস্তান ছাড়তে মরিয়া মানুষজনের বিমানবন্দরে অপেক্ষা
এএফপির ফাইল ছবি

দুই যুগ পর তালেবান আবার আফগানিস্তানের মসনদে ফিরে এসেছে। পশ্চিমা বিশ্বসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এতে বিস্ময় প্রকাশ করলেও এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যখন আফগানিস্তানের বৈধ সরকারকে পাশ কাটিয়ে (যারা তাদেরই পছন্দের লোকজন) দোহাতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তালেবানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে, তখনই এ রকম একটি ঘটনার কথা দেয়ালে লেখা হয়ে গিয়েছিল।

২০০১ সালের ৯/১১–তে নিউইয়র্কে ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আল–কায়েদা সন্ত্রাসী হামলা চালায় বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। এরপরই আমেরিকা ওসামা বিন লাদেনের আল–কায়েদা আর তাদের আশ্রয়দানকারী আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৭ অক্টোবরের মধ্যে তারা আফগানিস্তানে বোমা ফেলা শুরু করে এবং দুই মাসের মাথায় দেশটি দখল করে নেয়। তালেবান আর আল–কায়েদার যোদ্ধারা পাকিস্তান সীমান্তে পালিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র তখন তালেবান আর আল–কায়েদার যোদ্ধাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন না করে অন্য এক খেলায় মেতে ওঠে। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, ডিক চেনি আর ডোনাল্ড রামেসফেল্ডসহ ওয়াশিংটনের নিও-রক্ষণশীল (neo-conservative) গ্রুপ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের দীর্ঘস্থায়ী দখলদারত্ব ও অর্থনৈতিক সুবিধা (বিশেষ করে তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করা) বজায় রাখার জন্য ইরাক দখলের পরিকল্পনা আঁটতে  থাকে এবং পরে ২০০৩ সালে মিথ্যা গোয়েন্দা সংবাদের বাহানা দিয়ে মাত্র এক মাসের যুদ্ধে ইরাক দখল করে নেয়। এটা করতে গিয়ে তাদের শক্তি-সামর্থ্য ইরাকেই নিয়োগ করতে হয়, ফলে তাদের কাছে আফগানিস্তানের গুরুত্ব ক্ষীণ হয়ে যায় এবং আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকায় তালেবান ও আল–কায়েদার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পুনরুদ্যমে সংগঠিত হতে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার লয়ই ইনস্টিটিউট (Lowy Institute) ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ লিডিয়া খালিলের মতে, এই ২০ বছরে তালেবান ও আল–কায়েদার শক্তি–সামর্থ্য বহুগুণ বেড়েছে (ABC Q&A, 19 August 2021)।  

বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের ফলে সারা পৃথিবীতে সন্ত্রাস অনেক বেড়ে যাবে। তাঁদের মতে, প্রধানত দুইভাবে এই সন্ত্রাস বাড়তে পারে।

ছবি: এএফপি

প্রথমত, আল–কায়েদার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো আবার আফগানিস্তানে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানাতে এবং সদস্যদের আফগানিস্তানে এনে প্রশিক্ষণ দিতে পারে। ফলে তারা বিভিন্ন অস্ত্র চালনা ও যুদ্ধ প্রকৌশল শিখে তাদের নিজেদের ও অন্য দেশে অনেক দক্ষতার সঙ্গে সন্ত্রাসী আক্রমণ করে ব্যাপক জানমালের ক্ষতি করতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একত্র হয়ে ক্ষমতা দখলের প্রয়াস চালাতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার ডিকিন ইউনিভার্সিটির বিশ্ব ইসলামিক রাজনীতির প্রফেসর গ্রেগ বারটনের মতে, তালেবান আগের মতোই আছে, তাদের চিন্তাচেতনার কোনো পরিবর্তন হয়নি; বরং গত ২০ বছরে আল–কায়েদার সঙ্গে সমঝোতা ও একত্র হওয়ার ফলে উগ্র ধর্মীয় চেতনা আরও বেড়েছে (ABC news online, 19 Aug 2021)।

দ্বিতীয়ত, তালেবানের এ বিজয়ের ফলে সারা বিশ্বের তালেবানপন্থীদের মধ্যে একধরনের উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে, যা তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে উৎসাহিত করবে। তারা হয়তো ভাবছে, তারাও জিততে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকেও হারাতে পারে। ফলে বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশে এ উগ্র মতবাদের লোকজন একত্র হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করতে পারে।
আর এ কারণেই বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে। ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলা বহুল আলোচিত। বাংলাদেশে সন্ত্রাসী সংগঠন জেএমবি ও আনসার আল ইসলামও বহুল আলোচিত এবং তাদের সঙ্গে আফগানিস্তান, তথা তালেবানের সম্পৃক্ততার কথাও সবারই জানা। তাদের অনেক নেতা আশির দশকে সোভিয়েত সৈন্যদের বিপক্ষে তালেবানের সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করেছে। এখনো তাদের সঙ্গে তালেবানের যোগাযোগ বহাল তবিয়তেই আছে। তার প্রমাণ মেলে সম্প্রতি ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলামের মন্তব্য থেকে। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, এবারও বাংলাদেশ থেকে কেউ কেউ তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আফগানিস্তানে গেছে (প্রথম আলো, ১৪ আগস্ট ২০২১)। এই তালেবানপন্থীরা যে শুধু বাংলাদেশ থেকে গেছে তা নয়, আফগান বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান ও বিবিসি সাংবাদিক ইয়েলডা হাকিম জানিয়েছেন, তিনি আফগানিস্তানের ভেতর থেকে জেনেছেন যে পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ থেকেও তালেবানপন্থীরা গেছে আফগান তালেবানের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য (ABC Q&A, 19 August 2021)।

আর এই সমীকরণে আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী দেশ পাকিস্তানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তালেবান যখন পরাজিত হয়ে পাকিস্তান সীমান্তে পালিয়ে যায়, তখন তারা তালেবানকে সব ধরনের সাহায্য–সহযোগিতা দিতে থাকে এবং দীর্ঘ ২০ বছর তালেবানকে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিয়ে টিকিয়ে রাখে। আর তালেবান সৃষ্টির ব্যাপারেও পাকিস্তানের ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত।

ছবি: রয়টার্স

যদিও তৎকালীন পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে সন্ত্রাস দমনের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ ছিল এবং প্রচুর পরিমাণে অর্থনৈতিক সুবিধাও নেয়। পরবর্তী সময়ে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে প্রকাশ হয় যে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং সামরিক বাহিনী কখনোই তালেবানকে দমন করতে চায়নি। প্রথমত, ভূরাজনীতি, তারা চায়নি তাদের সীমান্তবর্তী দেশে অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণে থাকুক। এ ক্ষেত্রে তারা তাদের প্রধান শত্রু ভারতের কথাও বিবেচনায় এনেছে। এটাও বলা হয়ে থাকে যে সে সময় তারা পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সন্ত্রাস দমনের জন্য যেসব অর্থনৈতিক সাহায্য পেয়েছে, তা তারা ভারতকে মোকাবিলার কৌশলের ব্যাপারে ব্যয় করেছে।

এটা তো মোটামুটি সবারই জানা যে বাংলাদেশের উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে পাকিস্তানের উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভালো সম্পর্ক আছে। আর ভারতের কথা চিন্তা করে পাকিস্তানের আইএসআই দুই দেশের উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর সম্পর্ককে কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা চাইবে বাংলাদেশে উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠী বা তাদের সমর্থিত গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসুক, যাতে পূর্ব সীমান্তে ভারতের একজন শত্রু সৃষ্টি করা যায়। এটা করতে গিয়ে তারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চেষ্টা করবে। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে সবার অগোচরে এদের প্রশিক্ষণ দেওয়াও সুবিধা হবে। সুতরাং, বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকারকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে।

*লেখক: ড. মোয়াজ্জেম খান, কৃষি বিজ্ঞানী, এক্সিকিউটিভ লেভেল, অস্ট্রেলিয়ান সরকার।