আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া–আমেরিকার বিদায়, এবার কি ভারত-চীন
ভারত-চীন কি আফগানিস্তানে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে? সাম্প্রতিক সময়ে হিমালয়ে ভারত-চীন সংঘাতের পর দুই দেশের সহযোগিতা কি সম্ভব? বলা হচ্ছে, দিল্লি হয়তো স্থায়ীভাবে আফগানিস্তানে থাকার কথা ভাবছে না, চীন কি প্রত্যক্ষভাবে জড়াবে?
মহাভারতের গান্ধার রাষ্ট্রের কথা অনেকে না জানলেও হিন্দুকুশ পর্বতমালার নাম সবাই জানেন। গান্ধার রাষ্ট্র বা হিন্দুকুশ পর্বতমালা এখন আফগানিস্তান নামে পরিচিত। বিশ্বরাজনীতিতে এ সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ধূসর মরুভূমি ও পাহাড়-অধ্যুষিত আফগানিস্তান। কী হবে, এ প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। তবে এর কারণ সবাই জানে, আমেরিকা বা ন্যাটো সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে সব সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা করে বলেছেন, ‘এখন সৈন্যদের ঘরে ফেরার সময় হয়েছে।’ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) এ সিদ্ধান্তকে ‘ভুল’ হিসেবে অভিহিত করে বিশেষত আফগান নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। খবরে প্রকাশ, তালেবান তাদের অধিকৃত অঞ্চলে ১৫ থেকে ৪৫ বছরের সব অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত বা স্বামী পরিত্যক্ত ও বিধবা নারীদের তালিকা চেয়েছে।
কেউ জানে না কী হবে! তবে ভারত-চীনের দিকে সবার নজর। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এর ফলে ভারত বিপদে পড়বে। অন্যরা বলছেন, ২০২৪ সালে ভারতে নির্বাচন, আফগানিস্তান মোদির জন্য আশীর্বাদ হতে পারে?
এরপর কী? দ্য প্রিন্ট মিডিয়া বলেছে, আফগান প্রশ্নে ভারত ও চীন কি একসঙ্গে কাজ করতে পারবে? এসসিও (সাংহাই কো-অপারেশনে অর্গানাইজেশন) ভুক্ত দেশগুলোর এক বৈঠকে তাসখন্দে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বলেছেন, ভারত শান্তির লক্ষ্যে আফগানিস্তানকে সহায়তা করবে। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিকে তিনি এ আশ্বাস দেন। ডব্লিউপিআর (ওয়ার্ল্ড পলিটিকস রিভিউ) প্রশ্ন তুলেছে, ভারত-চীন কি আফগানিস্তানে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে? সাম্প্রতিক সময়ে হিমালয়ে ভারত-চীন সংঘাতের পর দুই দেশের সহযোগিতা কি সম্ভব? বলা হচ্ছে, দিল্লি হয়তো স্থায়ীভাবে আফগানিস্তানে থাকার কথা ভাবছে না, চীন কি প্রত্যক্ষভাবে জড়াবে? আফগানিস্তানে শান্তি হয়তো দুই দেশের জন্যই দরকার, তাই সহযোগিতা কি একেবারেই অসম্ভব?
দ্য হিল মিডিয়া বলেছে, রাশিয়া ও আমেরিকার পর পরাশক্তি চীন কি আফগান বধ্যভূমিতে প্রবেশ করবে? অন্য দুই পরাশক্তির চেয়ে আফগানিস্তানে চীনের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে চীনের সীমান্ত আছে। অনেক দিন ধরে চীন আফগানিস্তানকে কবজায় নিতে চাইছে, কারণ সে দেশের রুপার খনি এবং সঙ্গে রয়েছে সোনা, ইউরেনিয়াম ও লিথিয়াম। ওআরএফ (ওভারসিজ রিসার্চ ফাউন্ডেশন) একধাপ এগিয়ে প্রশ্ন করেছে, ভারত-চীন-পাকিস্তান কি আফগান প্রশ্নে একসঙ্গে কাজ করতে পারে? আফগান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার ওই অঞ্চলে ‘শূন্যতা’ সৃষ্টি করবে, তা সত্য, সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে কে? মোল্লা ওমরের তালেবান সরকারের বর্বরতার কথা বিশ্ব জানে, আবার কি তালেবান সরকার আসছে? কাবুলে ক্ষমতাসীন আফগান সরকার গত ২০ বছর কী করেছে?
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা জানায়, ১৫ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, আগামী ৩১ আগস্ট সম্পূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্যে দিয়ে তিনি ২০ বছরের আফগান যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানতে চান। বিবিসি নিউজ বলেছে, ইতিমধ্যে ইউএস ও ন্যাটো জেনারেলরা ক্ষমতা হস্তান্তর বা পদত্যাগ করেছেন। ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশ, এমনকি ইংল্যান্ড ইতিমধ্যে তাদের সব সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। এনপিআর বলছে, মার্কিন ইনটিজেন্স ধারণা করছে, ছয় মাসের মধ্যে কাবুলের পতন ঘটবে। আফগান সৈন্যরা নিজেদের পরিত্যক্ত ও নিঃসঙ্গ ভাবছেন।
আফগান যুদ্ধের কারিগর ডিফেন্স সেক্রেটারি ডোনাল্ড রামেসফেল্ড গত মাসে মারা গেছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন নাইন-ইলেভেনের ২০ বছর পূর্তির আগেই দুই দশকের যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘস্থায়ী আফগান যুদ্ধে শেষ করতে এক চুক্তিতে পৌঁছায়। এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দুই ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় এবং ২ হাজার ৪০০ মার্কিন সৈন্যর প্রাণ গেছে। ওই চুক্তির আলোকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। গত ১৬ মে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং জি এত দ্রুত সৈন্য প্রত্যাহারের সমালোচনা করে বলেন, এতে এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হবে।
মাস দুই আগে সৈন্য প্রত্যাহার শুরুর পর তালেবানদের অগ্রগতি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের বিস্মিত করেছে। পাকিস্তান অবাক হয়ে দেখছে, অল্প সময়ে তালেবান বেশ কটি শহর তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞ বলছেন, সম্পূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহারের পর এক মাসের মধ্যে তালেবানের কাছে রাজধানী কাবুলের পতন ঘটবে। তালেবানের কাছে কটি তারিখ বেশ গুরুত্বপূর্ণ, ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১, যেদিন ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’ ধ্বংস হয়েছিল; ৭ অক্টোবর ২০০১, যেদিন মার্কিন নেতৃত্বে আফগানিস্তানে আক্রমণ শুরু হয়েছিল অথবা ১৩ নভেম্বর ২০০১, যেদিন কাবুলের পতন ঘটেছিল। অর্থাৎ এ তিনটি দিবসে যেকোনো একটিতে তালেবানেরা কাবুল পুনর্দখল করতে চাইবে?
রাশিয়া ও আমেরিকার পর পরাশক্তি চীন কি আফগান বধ্যভূমিতে প্রবেশ করবে? অন্য দুই পরাশক্তির চেয়ে আফগানিস্তানে চীনের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে।
আল-জাজিরা জানাচ্ছে, কাতারের রাজধানী দোহায় আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে, যদিও তালেবানের অগ্রগতিতে আলোচনা থমকে পড়ছে। এর মধ্যে দিল্লিভিত্তিক রয়টার্সের পুলিৎজার বিজয়ী ফটোসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকি গত শুক্রবার আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে নিহত হন। তালেবানের দাবি, তাদের গুলিতে নিহত হন দানিশ। রয়টার্স প্রেসিডেন্ট মাইকেল ফ্রেডিনবার্গ এবং প্রধান সম্পাদক আলেসান্দ্রো গ্যালোনি বলেছেন, আমরা বিস্তারিত সংবাদ নিতে খোঁজ নিচ্ছি, তবে দানিশ সিদ্দিকি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী সাংবাদিক, একজন ভালো স্বামী ও বাবা, যাঁকে সবাই ভালোবাসত। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ছবি, ভারতে করোনায় হিন্দু মৃতদেহ দাহের ছবি প্রকাশসহ অনেকে জনপ্রিয় ছবি তুলেছেন এই দানিশ।
রয়টার্স জানাচ্ছে, পাকিস্তানে আফগান রাষ্ট্রদূতের মেয়ে সিলসিলা আলিখিল শুক্রবার বাড়ি ফেরার পথে ইসলামাবাদে অজ্ঞাত আততায়ীদের হাতে অপহৃত হন। দূতাবাস জানায়, সিলসিলার সঙ্গে নিতান্ত খারাপ আচরণ করা হয়েছে, তাঁকে অত্যাচার করা হয়েছে, তবে কয়েক ঘণ্টা পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে খবর বেরোয় যে আফগান নারীরা অস্ত্র হাতে তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে গেছেন, যদিও এর সত্যতা কতটুকু, তা বলা মুশকিল। তবে ইয়াজদি নারীদের কথা ভুলে গেলে চলবে না, আফগান নারীরা কি পারবেন ইয়াজদি নারীদের মতো সাহসী ভূমিকা নিতে? অসমর্থিত সূত্র জানায়, তালেবান চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে রাজি। ইরানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্ত রয়েছে, তবে শিয়া-সুন্নি বিভক্তির কারণে এদের মধ্যে সুসম্পর্কের সম্ভাবনা কম!
আফগানিস্তানের সঙ্গে পূর্ব ও দক্ষিণে পাকিস্তান; পশ্চিমে ইরান, তুর্কমিনিস্তান, উজবেকিস্তান; উত্তরে তাজিকিস্তান এবং উত্তর-পূর্বে চীনের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র এ দেশের জনসংখ্যা ৩৯ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৯০ লাখ। ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ মুসলমান, শূন্য দশমিক ৩ দশমিক অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। ২৫২ হাজার বর্গমাইলের এ দেশ মূলত পশতু, তাজিক, হাজারা ও উজবেকদের নিয়ে গঠিত। জর্জ বুশ জার্মান মিডিয়া ডয়চে ভেলকে এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের কারণে আফগানিস্তানের অবস্থা বিপর্যয়কর হবে বলে মন্তব্য করেছেন। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট বুশ নাইন-ইলেভেনের পর ক্ষমতাসীন তালেবান মোল্লা ওমরকে আফগানিস্তানের সব সামরিক স্থাপনা ভেঙে ফেলা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী বিন লাদেনকে হস্তান্তর করার আল্টিমেটাম দেন, মোল্লা ওমর তা মানতে অস্বীকার করেন, ফলে অক্টোবরে ন্যাটো আফগানিস্তান আক্রমণ করে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা বলেছে, তালেবানের অগ্রগতি ও নিরাপত্তা বাহিনীর পশ্চাৎপদতায় কাবুল সরকার বিস্মিত। এর মধ্যে এক হাজারের বেশি সৈন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে, আরও কয়েক শ সৈন্য তালেবানের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছে।
কী হবে?
কেউ জানে না কী হবে! তবে ভারত-চীনের দিকে সবার নজর। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এর ফলে ভারত বিপদে পড়বে। অন্যরা বলছেন, ২০২৪ সালে ভারতে নির্বাচন, আফগানিস্তান মোদির জন্য আশীর্বাদ হতে পারে? রাশিয়া ও মার্কিনদের বিদায়ের পর ‘বল’ এখন ভারত-চীনের মাঠে। দেখা যাক, খেলার মোড় কোনো দিকে ঘোরে। তবে যা–ই হোক, আফগান জনগণ আরও দীর্ঘদিন রাজনীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হবে, তা বলা বাহুল্য।