আফগানিস্তান ও বিশ্ব রাজনীতির চাল
৩০ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমান অধ্যুষিত আফগানিস্তানকে নিয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো বিনা অপরাধে একের পর এক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে কয়েক লাখ নিরপরাধ মানুষকে হতাহত এবং তাদের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক আক্রমণের আগে আফগানিস্তান কখনো মৌলবাদী বা তালেবানি রাষ্ট্র ছিল না। পরাশক্তিদ্বয়ের স্নায়ুযুদ্ধের বদৌলতে কখনো পুঁজিবাদের বা কখনো কমিউনিস্ট বলয়ে ছিল। কিন্তু ধর্মের কোনো প্রভাব ছিল না।
আর সোভিয়েত আগ্রাসন প্রতিহত করতে পুঁজিবাদীদের ফর্মুলায় এবং পাকিস্তানের সহায়তায় প্রথম ধর্মীয় সুরসুরি টেনে আনা হয়, যাতে বহুসংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করে আর গড়ে তোলা হয় ‘মুজাহিদীন’ এবং ‘তালেবান’। আর ওই সময় পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো আফগান যোদ্ধাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকত। কিন্তু যখনই স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটল, তখনই আফগানদের কয়েকটি ধর্মীয় গোঁড়ামির ঘটনাকে তিলকে তাল বানিয়ে তাদের বর্বর বানিয়ে দিল। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে এর চেয়ে বেশি ধর্মীয় অনুশাসন মানা হয়। এত প্রচার সত্ত্বেও আফগান যোদ্ধারা তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনা ও মনোবল নিয়ে বিশ্বের দুই পরাশক্তি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ১৯৮৯ সালে এবং আমেরিকাকে ২০২১ সালে লজ্জাজনকভাবে পরাজয় নিয়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করেছে। তারা এ মুহূর্তে রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে আর পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ,দীর্ঘ ৩০ বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আফগানিস্তানে শান্তি আসবে কি? সম্ভবত না, কারণ সেখানে নতুন খেলোয়াড় চায় না, ভারত ও সাবেক খেলোয়াড় পাকিস্তান ইতিমধ্যেই দাঁড়িয়ে গেছে।
১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে প্রথম সামরিক আগ্রাসন শুরু করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, যার এক খণ্ডাংশ বর্তমান রাশিয়া। তারা দাবি করে যে আফগানিস্তান থেকে সন্ত্রাসীরা তাদের দেশে ঢোকার কারণেই তারা এ অভিযানে নেমেছে। কিন্তু প্রকৃত কারণ হচ্ছে স্নায়ুযুদ্ধ। ওই সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ ছিল প্রবল। তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট হাফিজুল্লাহ আমিন, যিনি কিছুদিন আগে এক সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী প্রেসিডেন্ট নুর মোহাম্মদ তারাকিকে হত্যা করে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তাতে ক্রেমলিনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়।
এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট হাফিজুল্লাহ আমিন ১৯৭৯ সালের ২৭ অক্টোবর কাবুলে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্চার ব্লাডকে তাঁর দপ্তরে ডেকে আফগান-আমেরিকা সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেন। দ্রুত প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। কেজিবিপ্রধান ইউরি আন্দ্রোপভ প্রেসিডেন্ট লিওনার্দব্রেজনেভের কাছে হাতে লেখা নোট পাঠালেন যে আফগান প্রেসিডেন্ট পশ্চিমাদের এ অঞ্চলে পুনর্বাসন করতে চাচ্ছেন, সুতরাং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী পলিটব্যুরোতে বলেন, আমেরিকা আফগানিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র বসাতে চাচ্ছে। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে সোভিয়েট পলিটব্যুরো কোনো বিতর্ক ছাড়াই আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান অনুমোদন করে এবং ১২ দিন পর অভিযান শুরু হয়। শুরুতেই তাজরা ২৮০টি ফ্লাইটে ৮ হাজার ৫০০ সৈন্য অবতরণ করিয়ে দ্রুত কাবুলকে নিরাপদ করে নেয় এবং প্রেসিডেন্ট হাফিজুল্লাহকে সরিয়ে বারবাক কারমাল নামক এক আফগান কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকে প্রেসিডেন্ট পদে বসায়।
এদিকে ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে শস্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ও ’৮০ মস্কো অলিম্পিকের বয়কটের ঘোষণা দেয়। ’৮০ শুরুতেই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান মিত্র পাকিস্তানের সঙ্গে পরামর্শ করে আফগানদের দ্বারাই সোভিয়েতদের প্রতিরোধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে নির্দেশ দেন। তখনই তালেবান গঠন করা হয় এবং তাদের অর্থ, ট্রেনিং ও সব রকমের অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করা হয়। ওই সব অস্ত্রের মধ্য স্ট্রিংগার ক্ষেপণাস্ত্র, যা কাঁধের ওপর রেখেই বিমান ও হেলিকপ্টার ভূপাতিত করা যায়, সোভিয়েতদের পরাভূত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ১৫ হাজার সৈন্য নিহত হওয়ার পর নুতন প্রসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচভ ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।
দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয় ২০০১ সালে আমেরিকার অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী ৯/১১ হামলার পর। ওই হামলার পর ওসামা বিন লাদেন, যাঁকে ৯/১১ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী মনে করা হয়, আফগানিস্তানে বসবাস করতেন। আমেরিকার ৪৩তম প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ অতি উৎসাহী হয়ে একই সঙ্গে ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করেন। দীর্ঘ যুদ্ধের পর আমেরিকার ৪৪ ও ৪৫তম প্রেসিডেন্টরা অনুধাবন করতে শুরু করেন যে ভৌগোলিক অবস্থান, তালেবান যোদ্ধার সংখ্যা ও তাদের মনোবলের কারণে আফগানিস্তানে জয়লাভ করা অসম্ভব, যদিও সুপারপাওয়ারের হারের লজ্জায় তা বলতে পারছিলেন না। তবে সাহসী ৪৫তম ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েই দিলেন তিনি আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করবেন এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট তা বাস্তবায়ন করলেন।
নুতন খেলোয়াড়দের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য পরাশক্তিদ্বয়ের চেয়ে একটু ভিন্ন। ভারতের অবস্থান শুধু তাদের জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট। শুরু থেকেই তারা আমেরিকার সঙ্গে সহমত পোষণ করে তালেবানবিরোধী জনমত ও প্রশাসন গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তারা মনে করে তালেবানরা তাদের চিরশত্রু পাকিস্তানের আজ্ঞাবহ।
ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সঙ্গে যদি কোনো যুদ্ধ বা কাশ্মীর ইস্যুতে কোনো দ্বন্দ্ব হয়, তাহলে তালেবানরা মহা সমস্যার কারণ হবে। আজকে হঠাৎ করে যে আফগান ক্রিকেট দলের সাফল্য, তা সম্পূর্ণ ভারতেরই অবদান। তালেবানবিরোধী জনমত গঠন প্রকল্পে তারা আফগান খেলোয়াড়দের ভারতের মাটিতে স্টেডিয়াম, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে ওই সফলতা এনে দিয়েছে। এখন ভারত কীভাবে খেলবে, তা দেখার বিষয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর ইতিমধ্যে কাতারে তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে খবর বেরিয়েছে। যদিও ভারত তা অস্বীকার করেছে।
চীনের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত ২৮ জুলাই চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মো. বারাদারের নেতৃত্বে একটি তালেবান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করে দুটি বিষয়ে প্রতিশ্রুতি নেন। ১. চীনের উইঘুর অঞ্চলে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিষয়ে তালেবানরা কোনো মাথা ঘামাবে না। ২. চীনের ‘রোড ও বেল্ট’ প্রকল্পে তালেবান সরকার সহায়তা করবে। বৈঠক শেষে তালেবান নেতা চীনাদের ‘বিশ্বাসযোগ্য’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইরানও তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তালেবানরা কোনো হস্তক্ষেপ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিয়েছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানদের সম্পর্ক সেই ১৯৭৯ থেকেই যখন সোভিয়েতরা আক্রমণ করে। তখন থেকেই পাকিস্তান তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে। এখন পাকিস্তান চাইবেই ভারতবিরোধী যেকোনো অবস্থানে যেন তালেবানরা সহায়তা করে।
আমেরিকার যুদ্ধোত্তর ভূমিকা এবং আফগান প্রতিবেশীদের অবস্থানের ওপর নির্ভর করছে পরবর্তী আফগানিস্তানের শান্তিপ্রক্রিয়া। পৃথিবীর সব শান্তিকামী মানুষ আশা করে তালেবানরা সব মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে দেশ পরিচালনা করবে।
*লেখক: মফিজুল হুসেন নিজাম, নিউইর্য়ক।