আন্দে আন্দে লুমুত

ইন্দোনেশিয়ার জাভা যেমন প্রকৃতির স্বর্গ, ঠিক তেমনি রূপকথার রাজ্য হিসেবেও জাভার রয়েছে সুপরিচিতি। জাভার অসংখ্য রূপকথার গল্পের মধ্যে অন্যতম হলো আন্দে আন্দে লুমুত। এক সময় গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে কাহুরিপানস¤রাজ্য কেদিরি ও জাঙ্গাল নামের দুটি আলাদা রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এই রাজ্যের সম্রাট তার মৃত্যুর আগে বিভক্ত দুটি রাজ্যকে আবার একত্রিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সম্রাটের মৃত্যুর বহুকাল পর এই দুই রাজ্যের রাজারা তাদের সন্তানদের বিবাহের মাধ্যমে দুই রাজ্যকে একত্রিত করার প্রয়াস চালায়।

জাঙ্গাল রাজ্যের রাজপুত্র রাদেন পানজি আসমারা বানগুনুনের সঙ্গে কেদিরি রাজ্যের রাজকন্যা দেবী সেকারতাজীর বিবাহের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু দেবী সেকারতাজীর সৎমা এ বিয়ের বিরোধিতা করে। সে চায় তার নিজের মেয়ের সঙ্গে রাজপুত্র রাদেন পানজি আসমারা বানগুনুনের বিয়ে দিতে। তাই সে কৌশলে কেদিরি রাজ্যের রাজকন্যা দেবী সেকারতাজীকে কারাগারে বন্দী করে ফেলে। রাজপুত্র রাদেন পানজি আসমারা বানগুনু বিয়ের জন্য জাঙ্গাল রাজ্য থেকে কেদিরি রাজ্যে আসে। কিন্তু কেউ কোথাও রাজকন্যা দেবী সেকারতাজীকে খুঁজে পায় না। এ সময় রাজকন্যা দেবী সেকারতাজীর সৎমা রাজপুত্রের কাছে নিজের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু রাজপুত্র রাদেন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এক বুক হতাশা নিয়ে রাজকন্যা দেবী সেকারতাজীর সন্ধানে কেদিরি রাজ্য ত্যাগ করে।

রাজকন্যা দেবীর সন্ধানে রাজপুত্র রাদেন বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়াতে লাগল এবং নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখল আন্দে আন্দে লুমুত। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে সে দাদাপান নামের এক গ্রামে এসে পৌঁছায় এবং আশ্রয় নেয় মাবক রান্দা নামের এক বিধবার বাড়িতে। মাবক রান্দার কাছে রাজপুত্র তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলে। মাবক রান্দা সবকিছু শুনে রাজপুত্র রাদেনকে তার হারিয়ে যাওয়া সন্তান হিসেবে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। মা রান্দা এবার সন্তান আন্দে আন্দে লুমুতের বিয়ের জন্য চারদিকে কনে খুঁজতে লাগল। কিন্তু তাদের এই কৌশলও ব্যর্থ হলো। তারা কোথাও রাজকন্যা দেবী সেকারতাজীর সন্ধান পেল না।

এদিকে রাজকন্যা দেবী নানা কৌশলে কিছুদিন পর তার বন্দীজীবন থেকে পালিয়ে রাজপুত্র রাদেনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে এক বিধবার বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে আশ্রয় নেয়। বিধবার ছিল তিন মেয়ে—ক্লেটিং আবাং, ক্লেটিং ইজো ও ক্লেটিং বিরু। বিধবা রাজকন্যা দেবীর নাম পরিবর্তন করে নিজের মেয়েদের নামের সঙ্গে মিল রেখে রাখল ক্লেটিং কুনিং। ক্লেটিং কুনিং বিধবার বাড়ির সব কাজ নিজ হাতে করতে লাগল। কিন্তু সে এসব কাজে অভ্যস্ত ছিল না। প্রায় সময় সে বাড়ির সব কাজ করতে করতে কেঁদে ফেলত। তার এই কষ্ট দেখে একদল পোকা এসে তার কাজ করে দিয়ে যেত। এভাবেই সময় অতিবাহিত হতে লাগল।

এদিকে আন্দে আন্দে লুমুতের সুখ্যাতি নিজ গ্রাম দাদাপান ছাড়াও আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। পোকার দল এক দিন আন্দে আন্দে লুমুতের কথা ক্লেটিং কুনিংয়ের কাছে বলতে লাগল। সবকিছু শুনে ক্লেটিং কুনিং ঠিক করল একদিন সে আন্দে আন্দে লুমুতের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। এ জন্য আশ্রিত মাতার কাছে অনুমতি চাইল। কিন্তু আগে থেকেই বিধবা মহিলা ঠিক করে রেখেছিল আন্দে আন্দে লুমুতের সঙ্গে বিয়ের জন্য সে তার নিজ কন্যাদের পাঠাব। তাই বিভিন্ন অজুহাতে ক্লেটিং কুনিংকে দাদাপান যেতে বাধা দিল সে। নিজের মেয়েদের দ্রুত দাদাপান যাওয়ার ব্যবস্থা করল।

তিন বোন ক্লেটিং আবাং, ক্লেটিং ইজো ও ক্লেটিং বিরু দাদাপানের পথে রওনা দিয়ে বিশাল এক নদীর সামনে এসে দাঁড়াল। এই নদী পারাপারের জন্য কোনো নৌকার ব্যবস্থা ছিল না। কারণ, এখানে ইয়ো ইয়ো কাংকান নামে বিশাল এক কাঁকড়ার বসবাস। তার কথাতেই এই নদীতে সবকিছু হয়। আর এই নদী পার হওয়ার জন্য ইয়ো ইয়ো কাংকানই একমাত্র ভরসা। তিন বোন ইয়ো ইয়ো কাংকানকে অনুরোধ করল তাদের নদী পার করে দেওয়ার জন্য। তারা বলল, ‘কাংকান তুমি আমাদের নদী পার করে দাও না, বিনিময়ে আমরা তোমাকে টাকা দেব।’ কিন্তু ইয়ো ইয়ো কাংকান সুন্দরী তিন বোনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলল, ‘আমার টাকা চাই না। আমি তোমাদের নদী পার করে দিতে পারি, যদি তোমরা আমাকে চুমু দাও।’ উপায়ন্ত না দেখে তিন বোন এ শর্তে রাজি হলো। নদী পার হয়ে দাদাপান গ্রামে এসে আন্দে আন্দে লুমুতের বাড়িতে এসে হাজির হলো। এরপর তারা আন্দে আন্দে লুমুতের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিল। কিন্তু তাদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দে আন্দে লুমুত বলল, ‘আমি ইয়ো ইয়ো কাংকানের চুমু খাওয়া প্রেমিকাদের আমার বউ বানাতে পারি না।’ এমন উত্তর শুনে তিন বোন অবাক! কারণ, সেখানে তারা এবং ইয়ো ইয়ো কাংকান ছাড়া আর কেউ ছিল না। এরপর তারা দ্রুত দাদাপান ত্যাগ করে।

এদিকে ক্লেটিং কুনিং তার বাড়ির সব কাজ শেষ করে দাদাপানের উদ্দেশে রওনা দিয়ে ইয়ো ইয়ো কাংকানের নদীর কাছে এসে হাজির। নদী পার হওয়ার জন্য ইয়ো ইয়ো কাংকান তাকেও একই প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ক্লেটিং কুনিং তার এ প্রস্তাবে রাজি না হয়ে ইয়ো ইয়ো কাংকানের গালে সজোরে চড় মারে। অতঃপর সে ইয়ো ইয়ো কাংকানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে ইয়ো ইয়ো কাংকান পরাজিত হয়ে ক্লেটিং কুনিংকে নদী পার করে দেয়। ক্লেটিং কুনিং ছিল অপরূপ সুন্দরী, কিন্তু বিধবার বাড়িতে কাজের মেয়ে থাকার কারণে তার পরনের পোশাক জরাজীর্ণ হয়ে যায়। সে এ জরাজীর্ণ পোশাকেই আন্দে আন্দে লুমুতের বাড়িতে আসে এবং আন্দে আন্দে লুমুতের মায়ের কাছে লুমুতের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করে। মা রান্দা ক্লেটিং কুনিংয়ের পোশাকের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে লুমুতের কাছে যায় এবং ক্লেটিং কুনিং সম্পর্কে তার কাছে বর্ণনা করে।

আন্দে আন্দে লুমুত তাঁর মাকে বলেন, ‘এই একমাত্র মেয়ে যে ইয়ো ইয়ো কাংকানের সহজ শর্তে রাজি না হয়ে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করে নদী পার হয়েছে।’ এরপর সে ঘর থেকে বের হয়ে ক্লেটিং কুনিংয়ের দিকে অবাক দৃষ্টি তাকিয়ে থাকে। কারণ, সে তার রাজকন্যা দেবীর দেখা পেয়েছে। এদিকে ক্লেটিং কুনিং ও আন্দে আন্দে লুমুতের দিকে তাকিয়ে তাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি রাজপুত্র রাদেন?’ লুমুত উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ আমি রাজপুত্র রাদেন। আর তুমি তো রাজকন্যা দেবী। তাই না?’ সময় থমকে রইল অনেকক্ষণ। এরপর তারা মা রান্দাকে নিয়ে ফিরে এল তাদের রাজ্যে। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দুই বিভক্ত রাজ্যকে একত্রিত করে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের স্বপ্ন পূরণ করল।