আত্মহত্যা মানসিক না সামাজিক ব্যাধি?
মাসলোর থিওরি অনুযায়ী, মানুষের সারভাইভাল নিড ফুলফিল হয়ে গেছে তার ইমোশনাল নিড এবং এসটিম নিড জাগ্রত হয়। ফলে মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বীকৃতি চায়। অন্যের কাছ থেকে সে সম্মানিত হতে চায়। এ সম্মান হয়তো মানুষ বিশাল সমাজের কাছে চায় না, ব্যক্তির নিজের পরিমণ্ডলে, পরিবার-পরিজনের কাছ থেকেই মানুষ এ মনোযোগ-স্বীকৃতি আশা করে। সে মানুষ শিশু-কিশোর, তরুণ কিংবা বৃদ্ধ যে কোনো বয়সেরই হতে পারে। এটা মানুষের সহজাত স্বভাব।
সুতরাং, প্রত্যেক মানুষই ভালোবাসা চায়, চায় আশ্রয়, চায় স্বীকৃতি। ভালোবেসে বিনিময়ে ভালোবাসা প্রত্যাশা করে, নিজের গুণের প্রশংসা, সম্মান প্রাপ্তি—মোটকথা সে তার অস্তিত্বের উপস্থিতিটি জানান দিয়েই তার পরিবেশে বিচরণ করতে চায়। শুধু মানুষই বলি কেন, জীবমাত্রেই এ বৈশিষ্ট্য। একটি গাছের ডাল কেটে ফেললেই সে তার আশপাশে থেকে আরেকটি নতুন শাখা বের করে দেয়। সে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতেই এটি করে। কোনো গাছে ফল না দিলে তার শাখা-প্রশাখার ব্যাপ্তি কমিয়ে ফেললে সে ফল দেওয়া শুরু করে, অর্থাৎ সে তার কর্মক্ষমতা কিংবা বংশবিস্তারের ক্ষমতা প্রমাণ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তখনই, যখন আমরা তাকে অক্ষম বলে প্রমাণ করতে চাই।
আমাদের চারপাশের নানাবিধ সম্পর্কের জটিলতা, মায়ায় বাঁধা সংসারের নানাবিধ ছলনা, জীবনযাপনের স্টাইল, পদ্ধতি, পারিবারিক-সামাজিক সম্বন্ধ, মিথস্ক্রিয়াসহ বৃহত্তর জাতীয় জীবনের অনেক প্রভাব আমাদের মনের ওপরে পড়ে। যারা অধিক সচেতন, অতিমাত্রায় গতিশীল, কিংবা উচ্চমাত্রায় নিজেকে সামাজিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখতে পারে তাদের এ-জাতীয় বহির্ভাগের চাপ কম থাকে, কিংবা তারা তা ম্যানেজ করতে পারে সহজে। যারা অতিমাত্রায় সংবেদনশীল কিংবা যাদের সামাজিক নেটওয়ার্ক, কর্মব্যস্ততা কিংবা নিজেকে কোনো কিছুতে সম্পৃক্ত রাখার যোগ্যতা ও কৌশল জানা থাকে না, তারা পৃথিবীতে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। নিজের অস্তিত্বের ভার বইতে অক্ষম হয়ে যায়।
সংসারে একা মানুষদের নিজের জীবন দিয়েই হাঁটতে হয়। দুঃসহ-দুর্ভেদ্য সময়গুলোতে কেউই সঙ্গী হয় না। আর হয় না বলেই কেউ বোঝে না তাদের ভেতরে বয়ে যায় কত সমুদ্রঝড়। কিছু মানুষ নিজে কোনো দোষ না করেও পরিবারে, প্রিয়জনদের কাছে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যায়, কিংবা যৌবনের একটা ভুলের জন্য হাজারটা ভালো কাজের প্রশংসা, মূল্যায়ন পায় না পরিবারের কাছ থেকে। কিছু মানুষ নিজে কষ্ট পেলেও প্রতি উত্তর দিতে পারে না। কিছু মানুষ নিজের অক্ষমতাকে ঢাকতে না পেরে নিজেকেই দোষী ভাবে, নিজের ওপরই অন্যায় করে আজীবন।
বার্ধক্য নানা অক্ষমতার সমাহার আমাদের দেশে। মানুষ যখন কর্মে অক্ষম কিংবা কর্ম থেকে অবসর গ্রহণ করে তখনো তাদের ওপরে একধরনের মানসিক চাপ তৈরি হয়। যদিও আমরা দাবি করি আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে পারিবারিক জীবনযাপনের যে পদ্ধতি রয়েছে, সে ক্ষেত্রে বৃদ্ধ বয়সের জন্য অতখানি খারাপ কিছু নয়। আমাদের সমাজে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ সবার শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়, সন্তানসন্ততিদের নিয়ে আনন্দেই থাকে। এ রেওয়াজের বাইরেও হয়তো অনেক গল্প আছে, থাকে যা আমাদের অজানা। হয়তো ভেতরে-ভেতরে কিছু ঘুণপোকা ধীরে ধীরে কাটছে সম্পর্কের মায়াজাল!
মানুষের এ একা হয়ে যাওয়া, নিজেকে চারপাশের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবার অবস্থা একদিনে কিংবা সামান্য একটা ঘটনার কারণে তৈরি হয় না। ভয়াবহ মানসিক বিষণ্নতা এর একটা কারণ হতে পারে। এই বিষণ্নতা একটা মানসিক রোগ এতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও আমাদের সমাজে মানসিক রোগ বিষয়টিকে খুব নিচু স্বরে বলার, লুকোছাপা করে রাখার রীতি। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে আমাদের অজ্ঞতা, অসচেতনতা কিংবা সামাজিক সংস্কারের কারণে মানসিক স্বাস্থ্য, তথা রোগের প্রতি আমাদের অমনোযোগিতার ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে।
এ কথা বলাই বাহুল্য, দুই বছরের বেশি সময় ধরে কোভিডের কোপানলে আমরা অন্যান্য মৃত্যু বিষয়ে ভাবনা প্রায় ভুলতেই বসেছি। স্মরণ রাখা দরকার, আত্মহত্যায় বিশ্বে প্রতিবছর যে পরিমাণ মানুষ মারা যায়, তার সংখ্যা মরণঘাতী কোভিডের থেকেও ভয়াবহ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে বলা যায়, বিশ্বে প্রতিবছর ৭ লাখ লোক মারা যায় আত্মহত্যা করে। ১৫-১৯ বছর বয়সীদের জন্য গ্লোবাল মৃত্যুর কারণের মধ্যে এটি চতুর্থতম কারণ হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে। বিশ্বের ৭৭ শতাংশ আত্মহত্যা সংঘটিত হয় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। হু-এর ব্যাখ্যানুযায়ী বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যে মিল আছে বৈকি! এমনকি বাংলাদেশের একটি জেলাও আছে, যেখানে গড়ে প্রতিবছর নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৪০০-এর বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। জেলাটির নাম ঝিনাইদহ। ২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে ৩ হাজার ১৫২ জন মানুষ। যদিও জেলার বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আত্মহত্যা প্রতিরোধে নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করার ফলে আগের তুলনায় সচেতনতা বৃদ্ধি হয়েছে। (বিবিসি বাংলা, সেপ্টেম্বর ১০ ২০২০)
সম্প্রতি একটি আত্মহত্যার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমের নিউজ ফিডে ঘোরাফেরা করলেও নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় সেই নিউজ আমার দেখা হয়ে ওঠেনি। সবার স্ট্যাটাস এবং লেখা থেকে যেটুকু জেনেছি, তাতে আমার উপলব্ধি হলো, বাইরে থেকে দেখেই আত্মহত্যার মতো একটি বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না, উচিতও নয়। বিষয়টির এত সরল সমীকরণ সম্ভব নয়।
কেউ কেউ বলেছেন, আত্মহত্যা মহাপাপ! যে মানুষটি আত্মহননের মতো কঠিন পথ বেছে নেয়, তার আদতে পাপ-পুণ্যের বিচার করার মতো মানসিক অবস্থা থাকে বলে আমার মনে হয় না। কেউবা বলেছে, পারিবারিক সমস্যা সবারই থাকে, মিটে যেত হয়তো কিছুদিন পরে। তাই বলে নিজেকেই শেষ করে দিতে হবে! এ-জাতীয় আলোচনা সমালোচনা আমাদের তাৎক্ষণিক ভাবনার প্রতিফলন। আদতে এ সমস্যার শিকড় আরও গভীরে এবং এর সমাধানের জন্য সমাজ মনস্তত্ত্ববোধ, মনোচিকিৎসাবিদ, তথা নীতিনির্ধারকদের সমন্বিত গবেষণা, পর্যালোচনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতি জরুরি।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ-জাতীয় হত্যা আমাদের আহত করে, আমাদের গভীরভাবে ভাবায়। তবে আমাদের ভাবনাগুলো যদি অনুসন্ধানমূলক হয়, যদি কাউকে অসম্মান না করে, কিংবা আমরা যদি ব্যক্তি মনস্তত্ত্ব একটু হলেও বোঝার চেষ্টা করি এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাস করতে পারি, তবে এ সমানুভূতি ব্যক্তির জন্য কিংবা পরবর্তী সময়ে এমন ঘটনা হ্রাসে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। না হলে এ-জাতীয় ঘটনা আমাদের সমাজে নিছক ডাল-ভাত।
উল্লেখ্য, আঁচল ফাউন্ডেশনের এক গবেষণা অনুযায়ী, গত এক বছরে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, যে সংখ্যা ২০২০-এ ছিল ৭৯। তাঁরা সবাই পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে স্বপ্ন পূরণ না হওয়া, আর্থিক টানাপোড়েন, পারিবারিক কলহ, লেখাপড়া ও পরীক্ষা নিয়ে হতাশা (প্রথম আলো: ২৮ জানুয়ারি ২০২২)।
করোনা আমাদের জীবনের ওপর মৃত্যুর ছোবল যে মাত্রায় হেনেছে, জীবন্মৃতও কিছু কম করেনি। করোনাকালে সারা বিশ্বেই মানসিক স্বাস্থ্যের বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সর্বত্রই মানসিক চাপ, উৎকণ্ঠা, উদ্বেগের প্রকোপ বেড়েছে। উন্নত বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো স্বীকৃত। সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাও রয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিষেবা রয়েছে। বিশেষ করে সুইসাইড প্রিভেনশনের জন্য হটলাইন সেবা রয়েছে, যা ২৪ ঘণ্টার জন্য সেবা প্রদান করে থাকে। কারও মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা আছে, এটা জানলে অফিস, সহকর্মী কিংবা প্রতিবেশী, তাদের প্রতি সমানুভূতি প্রদর্শন করে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। অপরপক্ষে, বাংলাদেশে? বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা কতটা সমৃদ্ধ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতিকে সমানুভূতির সঙ্গে দেখতে! এ প্রশ্নের জবাব আমরা সবাই জানি। এই করোনাকালেই বাংলাদেশে এক বছরে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ। (প্রথম আলো: ১৩ মার্চ ২০২১)
পরিশেষে বলব, সুন্দর এই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার জন্য অযাচিত কোনো মৃত্যুই আমাদের কাম্য নয়। আত্মহত্যার মতো একটি নীরব ঘাতককে আমরা চাইলেই আর বাড়তে না দিতে পারি। ব্যক্তির সীমাহীন অভিমানের কারণ নিয়ে কথা বলতে পারি। এর জন্য দরকার সমন্বিত উদ্যোগ, সামাজিক সচেতনতা আর ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তি, সমাজ, তথা রাষ্ট্রের সমানুভূতিশীল আচরণ। সর্বোপরি নাগরিকের জীবন তো রাষ্ট্রেরই সম্পদ। তাই দিন শেষে এ দায় থেকে রাষ্ট্র এড়াতে পারে কি!
*লেখক: সঙ্গীতা ইয়াসমিন, প্রবাসী লেখক, টরন্টো।