আজাদ কাশ্মীরের ঘোরাঘুরি

ফাইল ছবি: রয়টার্স

সেই সময়, যখন ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানে আত্মগোপন করায় যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীল। পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ। প্রথম যেদিন করাচিতে নামলাম, এয়ারপোর্টে অনেকক্ষণ আটকে ছিলাম। বাইরে এত গোলাগুলি হচ্ছিল যে আমরা বের হতে পারছিলাম না। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে আমাদের এস্কর্ট করে নিয়ে গেল। এস্কর্ট করে নিয়ে যাওয়ায় নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভেবে ভয়ের থেকে আনন্দই বেশি হলো।

আমাদের নতুন বিয়ে, একসঙ্গে থাকা পাকিস্তানেই শুরু। এটা ঠিক সংসার নয়, দীর্ঘ হানিমুন। নেভি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, করাচি, পাকিস্তানে এক বছরের একটা কোর্সে আমার স্বামী গিয়েছিল।

নতুন একটা দেশে এসেছি, কত প্ল্যান, কিন্তু কঠিন নিরাপত্তার জালে পড়ে গেলাম। ঘুরতে যাওয়া হোক আর বাজার করা, সবখানেই অনুমতি আর এস্কর্ট নিয়ে যেতে হবে। দুজনেরই অল্প বয়স, তাই রক্তও গরম। লুকিয়ে লুকিয়ে কতভাবে যে ঘুরতে বের হতাম—এমনও হয়েছে, যেতে যেতে গোলাগুলির শব্দ শুনছি, তারপরও গিয়েছি। ফিরে এসে শুনেছি, যেখানে গিয়েছিলাম, সেখানেই দুজনকে মেরে ফেলেছে।

মৃত্যুর আগে অ্যাবোটাবাদে দেয়ালঘেরা এই বাড়িতে ছিলেন ওসামা বিন লাদেন
ছবি: রয়টার্স

এই অবস্থায় আমরা আবার আজাদ জাম্মু-কাশ্মীর যাওয়ারও পরিকল্পনা করছি। পাকিস্তান এসে কাশ্মীর দেখে যাব না, এটা কি সম্ভব? পৃথিবীর ভূস্বর্গ বলে কথা! সেমিস্টার ব্রেকের ছুটিতে আমরা ইসলামাবাদ যাওয়ার বিমানের টিকিট করে ফেললাম। কিন্তু যাওয়ার অনুমতি মেলে না। টিকিট ক্যানসেল করতে হলো। মনটাই ভেঙে গেল। পরিস্থিতি জানিয়ে আমার স্বামী ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কথা বলল। ওখানে ডিফেন্স অ্যাটাচি অফিশিয়ালি যেতে বলায় আমরা ইসলামাবাদ যাওয়ার অনুমতি পেলাম। দ্বিগুণ উৎসাহে আবারও টিকিট কাটা আর দিনরাত শুধু ঘোরার পরিকল্পনা।

করাচি থেকে ইসলামাবাদ বাস, ট্রেন, এয়ার—তিনভাবেই যাওয়া যায়। বাস অথবা ট্রেনে গেলে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে, এ জন্য আমরা দুই ঘণ্টার আকাশপথের যাত্রাই বেছে নিলাম। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের দিকে যাচ্ছি, ইসলামাবাদ দেখে মুগ্ধ। এত সুন্দর সাজানো শহর! পুরো শহর যেন সবুজ পাহাড়ের চাদরে মোড়ানো। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি আর মনে হচ্ছে, পাহাড়ও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে। প্রতিটা বাসা, রাস্তা, রেস্তোরাঁ এত গোছানো, এত পরিকল্পনা করে বানানো, দেশে–বিদেশে যত শহর দেখেছি, ইসলামাবাদের মতো গোছানো সুন্দর শহর আর একটাও দেখিনি। পরে জানলাম ইসলামাবাদ পৃথিবীর দ্বিতীয় সুন্দর রাজধানী।

কাশ্মীরকে বলা হয় ভূস্বর্গ। পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ। সম্প্রতি ভারী তুষারপাতে ছেয়ে গেছে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর। এর মধ্যে জীবনের তাগিদে রাস্তার পাশে ফলের পসরা সাজিয়ে বসেছেন এক ফল ব্যবসায়ী
ফাইল ছবি: এএফপি

ইসলামাবাদে এসে পাকিস্তান আর্মির সহযোগিতায় কাশ্মীর যাওয়ার অনুমতি পেলাম। ওনারাই পাশ, গাড়ি ও একজন গাইড দিয়ে দিলেন। ইসলামাবাদ থেকে রওনা দিলাম, গন্তব্য জম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফ্‌ফরাবাদ। ইসলামাবাদ থেকে দুই ঘণ্টা যাওয়ার পরই মারি নামের এক পাহাড়ি শহরে থামলাম। এই জায়গাটা ইসলামাবাদের কাছেই আর এখানে বরফ পড়ে, তাই এটা খুব বিখ্যাত পর্যটন স্থান। পুরো পাহাড়ি এই শহরে পর্যটক আকর্ষণ করার সব আয়োজন করে রেখেছে। আগের দিন তুষারপাত হওয়ায় পর্যটক অনেক বেশি ছিল, সেই সঙ্গে বরফও। জীবনে প্রথম বরফ দেখলাম, সেই অল্প বরফ দেখেই আমার সে কি আনন্দ! তখন কি আর জানতাম, সামনে আরও বিশাল সৌন্দর্য আমার জন্য অপেক্ষা করছে? সেই রাতটা মারিতে থেকে পরদিন সকালে আবার যাত্রা শুরু।

মারি থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা যাওয়ার পরই এলাম নাথিয়া গালি, অ্যাবোটাবাদ। এটা সেই জায়গা, যেখানে লুকিয়ে ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। মার্কিন সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে প্রাণ যায় ২০১১ সালের মে মাসে। আমরা গেলাম ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কঠিন নিরাপত্তা, এ জন্য মারি থেকে অ্যাবোটাবাদ যাওয়ার পথে ৩০ মিনিট পরপর সেনাদের তল্লাশি চৌকি। পাকিস্তান নেভির আইডি কার্ড আর পাশ দেখিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছি।
অ্যাবোটাবাদ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ১২০ ফুট উঁচুতে। পুরো রাস্তা বরফে ঢাকা, মধ্যে একটু পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে চালক অতি দক্ষতায় পাহাড় ঘেঁষে চালিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি গাড়ি বরফে স্লিপ করবে, আর আমরা পাহাড় থেকে পড়ে যাব। এখানে পড়ে গেলে লাশও কেউ খুঁজে পাবে না। যদিও ভয়ের থেকে ভালো লাগাই বেশি কাজ করছিল, এত সুন্দর সবুজ আর বরফ পাহাড়ের ভ্যালি। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে মনে হবে পৃথিবীর স্বর্গ নামটার সার্থকতা। এত উঁচু উঁচু পাহাড় আর তার বৈচিত্র্য। কিছু পাহাড় পুরো সবুজ, কিছু পুরো সাদা, কিছু সাদা আর সবুজের মিশ্রণ, আর কিছু কেমন মেটে রঙের। নাথিয়া গালির যে জায়গায় আমরা নামলাম, সেখানে শুধু বরফ আর বরফ। হাঁটতে গেলে হাঁটু পর্যন্ত বরফে দেবে যাচ্ছে। আমরা দুজন বরফে গড়াগড়ি খেলাম। কেব্‌ল কারে পাহাড়ের ওপর দিয়ে বরফের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। সবুজের মাঝে এত এত সাদা দেখে অসম্ভব ভালো লাগায় মনটা ভরে যাচ্ছিল। এই রাস্তায় রাতে জার্নি অসম্ভব, তাই রাতটা এখানেই কাটালাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে বরফ ছাড়া আর কিছু দেখি না। আমাদের রুমের কার্নিশ, বারান্দা—সব সাদা। কী এক ভালো লাগা কাজ করছিল, তা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না।

সকালে রওনা দিলাম, উদ্দেশ্য জম্মু-কাশ্মীরের মুজাফ্‌ফরাবাদ। যত যাচ্ছি বরফ কমছে আর কিছুদূর পরপরই বরফ গলা পাহাড়ি নদী, ঝরনা দেখামাত্রই গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ছি। মুজাফ্‌ফরাবাদে দুই দিন থাকলাম। ওখানে থাকা অবস্থাতেই বৃষ্টি শুরু হলো। পাহাড়ে বৃষ্টি এমনিতেই ভয়ংকর, তার মধ্যে বরফে ঢাকা রাস্তায় বৃষ্টি হওয়াতে রাস্তা হলো পিচ্ছিল। আমরা যেদিন ফিরছি, পিচ্ছিল রাস্তার সঙ্গে শুরু হলো ভূমিধস। পাহাড় ভেঙে ভেঙে রাস্তা প্রায় বন্ধ। আমরা চোখের সামনে দেখলাম পাহাড় ধসে পড়ছে। আল্লাহ আয়ু রেখেছিলেন, তাই আমাদের গাড়ির ওপর পাহাড় ধসে পড়েনি। এমনো হয়েছে, আমরা মাত্র পার হয়ে এসেছি, আর পেছনেই পাহাড়ের ধস শুরু। এভাবে এক লোমহর্ষক ভ্রমণের পর পৌঁছালাম ইসলামাবাদ।

ইচ্ছা ছিল ইসলামাবাদ থেকে লাহোর যাব। কাশ্মীর থেকে ঘুরে আসতে আসতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা আরও উত্তপ্ত হয়ে গেল। লাহোরে জরুরি অবস্থা জারি হলো, আমাদের আর লাহোর যাওয়া হলো না। ওই সময় আমাদের ভালো মুঠোফোন, ক্যামেরা কিছুই ছিল না। সাধারণ ক্যামেরাতে অনভিজ্ঞ হাতের ছবিতে সৌন্দর্যের একাংশও বোঝা যাবে না।