আজকের পুতুল নাচ

পুতুল নাচের সঙ্গে আমরা সবাই মোটামুটি পরিচিত। ভারতীয় উপমহাদেশে বিপন পাল প্রথম পুতুল নাচের প্রচলন করেন। একটা সময় পুতুল নাচের গল্পে তুলে ধরা হতো সে সময়ের মানুষের ধর্মকথা, নীতিকথা, সুখ-দুঃখ ও নিত্যদিনের জীবনাচরণ। আজকের দিনে পুতুল নাচে সেই সব উপকরণ ঠেসে দেওয়া হয় না। আজকের দিনে পুতুল নাচের মডেল হয়েছি ‘আমরা’ এবং আমরা আজ মানুষের ধর্মকথা, নীতিকথা, সুখ-দুঃখ নিয়ে নাচ করি না। আমরা আজ কেবল হাত-পা নাড়ি, নাড়তে হয় বলে নাড়ি; একেবারেই প্রতিবন্ধী হয়ে। আমাদের নাচে কোনো বার্তা থাকে না।
গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৯ আসন, জাতীয় পার্টি ২০, বিএনপি ৬, গণফোরাম ২, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩, জাসদ ২ ও বিকল্পধারা ২ আসন। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেন, জনগণ যেভাবে ভোট দিয়েছে, সেভাবেই ভোট হয়েছে। এত ভোট তো আর আমরা দিইনি, তথাপি আমরা সবাই জানি এই অবিশ্বাস্য রকমের ফলাফলের অন্তরালে কী রয়েছে।
সমস্যা আমাদের জানা বা অজানায় নয়। সমস্যা আমাদের বাকস্বাধীনতায়। ওই যে বললাম, আমরা নাচের পুতুল। মূক বধির হয়ে নাচের পুতুলের মতো আমরা হাত-পা নেড়েই যাচ্ছি, আমাদের শব্দেরা লুকিয়ে পড়ছে ঘুমিয়ে পড়ার আতঙ্কে।
আমরা জানি, মৌলিক অধিকার ও মৌলিক চাহিদা এক নয়। মৌলিক চাহিদা যেমন- অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা ইত্যাদি হচ্ছে একান্তই আপনার নিজের প্রয়োজন। আপনার এই চাহিদা পূরণ না হলে অন্য কেউ এর জন্য দায়ী থাকবে না। কিন্তু যখনই অধিকারের প্রশ্ন আসে, তখনই বুঝতে হবে, সংবিধানে এই অধিকারে উল্লিখিত সব সুযোগ-সুবিধা আপনি উপভোগ করতে না পারলে অন্য কেউ এর জন্য দায়ী হবে অর্থাৎ এর জন্য সরাসরি সরকার দায়ী হবে। সংবিধানের ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে এই বিধান সম্পর্কে বলা আছে, ‘এই ভাগের (মৌলিক অধিকার) বিধানাবলির সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ সব প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে। এবং রাষ্ট্র এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’
অর্থাৎ সরকার দ্বারা পাসকৃত যেকোনো প্রচলিত আইন যদি সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলো ভঙ্গ করে, তবে তাৎক্ষণিক ওই আইনকে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করা হবে।
বাকস্বাধীনতা হচ্ছে আমাদের প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে অর্থাৎ ২৬ থেকে ৪৭ক অনুচ্ছেদ পর্যন্ত আমাদের মৌলিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে-
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং
খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার, নিশ্চয়তা দান করা হইল।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আমাদের নরসিংদী সদরের অগণিত ভোটকেন্দ্রের মধ্যে আমাদের এলাকার ভোটকেন্দ্রটি ছিল বরাবরের মতোই বৌয়াকুড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয় আর আমাদের বাড়ির মধ্যে দূরত্ব ছয় কদম। বিদ্যালয়টির জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটুকু আমার বাবা দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় আমিও এই বিদ্যালয়ে পড়েছি দুই বছর। যাই হোক, বাড়ির পাশে ভোটকেন্দ্র হওয়ায় আমাদের বাড়ির মানুষ সব সময় ঘুম থেকে উঠে একটু আরাম–আয়েশ করেই ভোটকেন্দ্রে যান। এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তারা বেলা ১১টার দিকে ভোটকেন্দ্রে গেলেন। ভোটকেন্দ্রের সামনে তখন মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। তারা ভেতরে যেতে পারছিলেন না। তাদের চোখে-মুখে কোনো রকম বিরক্তিও ছিল না। এমন একটা ভাব সবার যেন ‘এ আর নতুন কী’!
আমার ভাইয়েরা সম্ভবত ভেতরে যেতে পেরেছিলেন আমার বাবার নামের কারণে। কিন্তু বাবার নাম বেশি দূর তাদের যেতে দিল না। ভেতরে ঢুকে জানতে পারলেন, তাদের ভোট নেই। তারা ভোট না দিয়ে ফিরে এল। কারণ অজ্ঞাত কোনো ভূত-প্রেত ইতিমধ্যেই তাদের ভোট দিয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আমার মৃত তিনটি ভাইও ভোট দিয়েছিলেন সেদিন।
ঢাকা মিরপুর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা আমার বান্ধবী সেলিনা। ছোট দুটি ছেলেমেয়ে রেখে তার স্বামী মারা যায় ১০ বছর আগে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অজ্ঞাত ভূত-প্রেতেরা তার ভোটও দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তার ১০ বছর আগে গত হওয়া স্বামীর ভোটও সেদিন গ্রহণ করা হয়েছে। কবরের নিচে চাপা পড়া বহু হতভাগাদের কপাল খুলে গিয়েছিল সেদিন।
নরসিংদীর একটা আঞ্চলিক প্রবাদ আছে ‘পাগলে কী না কয়, ছাগলে কী না খায়’। এই কথাগুলো আমি বলতে চাই না। আমি কিন্তু বলছিও না। যা বলছি, তা ভেবে নিন পাগলের প্রলাপ। চামড়ার মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে। আমি আপনাদের মতোই নাচের পুতুল। আমাকে দুই হাত, ঘাড়ে সুতা বেঁধে টানা হবে, আমি নড়ব। আমি কথা বলব না। এটাই আমার বর্তমান অবস্থান।
বাংলাদেশ সংবিধান আমাদের পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে। লক্ষ্য করে দেখুন, বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে অর্থাৎ ২৬ থেকে ৪৭ক অনুচ্ছেদ পর্যন্ত আমাদের মৌলিক অধিকার নিয়ে কত কিছু আলোচনা করা হয়েছে। ‘আই মাস্ট স্যালিউট বাংলাদেশ কনস্টিটিউশন’।