আঙ্গেলা মার্কেলের দেশে মেয়েরা

প্রবাস জীবন মানুষকে অনেক কিছু শেখায়। আর তা সম্ভব, মানুষ যদি তার চোখ খুলে রাখে। ইউরোপের একটি উন্নত দেশে বাস করে আমি অনেক কিছু শিখেছি। কিন্তু যেহেতু আমি নারী তাই নারীর অধিকারের দিকটি আমার আকর্ষণ করেছে। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ থেকে এসে আমি বুঝেছি একটি সমাজ, রাষ্ট্র, জাতি সরকার একজন নারীকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। এই দেশেও নারী নির্যাতন আছে কিন্তু প্রতিরোধ করারও পথ ও আইন আছে। আর নিজ দেশের নারীর সম্মান যারা রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারা এসব মেনে চলেন।
নারীশক্তি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলকে দেখলে বোঝা যায়। এমন একটা উন্নত দেশে এসে তবুও বহু বাঙালি নারী বিপদে পড়ছেন। অজানা অচেনা দেশে ভাষা না বুঝে একজন মানুষের হাত ধরে তারা বিদেশে আসছেন। কিছু নারীদের জীবন এতটাই নিয়ন্ত্রিত যে সংসারের বলয় থেকে তারা বের হতে পারেননি। তারা ধরেই নিয়েছেন গভীর দুকূল ভাসা সমুদ্রে পাতিলাম শয্যা। কিন্তু এত যে আইন তারা তা কখনোই কাজে লাগাননি, জানতেও চাননি।
পৃথিবীর একটি উন্নত দেশে এসে বুঝেছি একজন নারীকে একটি সমাজ আইন আর সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে সুখে শান্তিতে বাস করতে শেখায়। যত বিপদ আসুক না কেন নারীরা ভয় পেয়ে আবার বাঁচার চেষ্টা করে। আমার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে এমন কথা ভাবার আগে প্রায় অধিকাংশ নারীই মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়। অথচ এমন উন্নত দেশে আমাদের দেশ থেকে আসা বহু নারীই বিপদে পড়েন। তাদের জানা নাই কোন পথে কীভাবে এগোবেন।
যেহেতু আমি জার্মানিতে বাস করি তাই সেই দেশের কথাই আজ উল্লেখ করব। অজানা অচেনা দেশে বাঙালি মেয়ে যারা আসেন তাদের অধিকাংশই জার্মান ভাষা ঠিকমতো শিখে আসেননি। অল্প ভাষা শিক্ষার ফলে অনেক বাঙালি মেয়ে তার দেশের লেখাপড়া তেমন কাজে লাগাতে পারেন না। অনেক বাঙালি পুরুষ এ দেশে শুধুমাত্র পেপারের জন্য বিয়ে করেন বা কারও কারও সত্যিই এ দেশি একজন বউ থাকে। একদিন তার লাল শাড়ি পড়া বাঙালি বউয়ের সাধ জাগে। তখন নিজের ছেলের বয়সী এক মেয়েকে বাংলাদেশ থেকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন। মেয়েটির মন মানসিকতার সঙ্গে মিলাতে না পেরে তারপর শুরু হয় নির্যাতন। এ নির্যাতন শুধু শারীরিক নয় মানসিকও বটে।
জার্মান ফেরত পাত্রের হাতে মা–বাবা তার কন্যাটিকে তুলে দেন, কিন্তু কিছু মেয়ে যে অন্যায় অত্যাচার সহ্য করে তা অবর্ণনীয়। অথচ আইনের দেশে এসেও বাঙালি মেয়েটি জানে না এই দেশের আইন তার কতটা উপকারে আসতে পারে। জার্মানির বাঙালি সমাজ এমন একটি অসহায় মেয়েকে সাহায্য করতে খুব কমই এগিয়ে আসে। কেউ কেউ বরং নির্যাতিত নারীকে নানাভাবে অপদস্থ করতে শুরু করে। অনেক সমিতি তারা তৈরি করেন কিন্তু মানবিক ব্যাপারে তাদের এগিয়ে আসতে খুব কমই দেখেছি। একজন তালাকপ্রাপ্ত মেয়েকে আঙুল দিয়ে দেখানো ছাড়া বেশির ভাগ বাঙালির যেন আর কিছু করার নাই। ইউরোপ এসব বাঙালিদের কোনো দিন আলোকিত করতে পারে নাই। তাই সামাজিকভাবে বাস করা একজন বাঙালি অপূর্ব সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করে এনে খুব সহজে লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যান। মেয়েরাও আদি অন্ধকারে বাস করেন। একজন অসহায় মেয়ের দুঃখে কেউ যদি এগিয়ে আসেন কিছু পুরুষ দলবদ্ধ হয়ে তাদের বিরোধিতা করেন। কোনো পরিবার সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে না, যেখানে স্বামী স্ত্রীর ওপর দৈহিক নির্যাতন চালায়। জার্মানিতে নিচের সমস্যাগুলো নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে এবং তা হলে একজন বাঙালি মেয়ের অবশ্যই উচিত আইনের সাহায্য নেওয়া।
ক. উঠতে বসতে অপমান করা।
খ. ভাষা শেখার বা পড়াশোনা করার সুযোগ না দেওয়া।
গ. নিজের বাবা–মাকে দেখতে দেশে যেতে না দেওয়া।
ঘ. অর্থনৈতিক, সামাজিক ও চিকিৎসার সুবিধা নিয়ন্ত্রণ করা।
ঙ. পদে পদে সন্দেহ করা।
চ. অ্যালকোহল বা ড্রাগ নিয়ে মারধর করা বা চিৎকার করা।
ছ. ধারালো অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখানো।
জ. পর নারীতে আসক্ত বা অন্য কিছুতে আসক্ত হয়ে স্ত্রীর জীবন দুর্বিষহ করে তোলা।
অনেক বাঙালি মেয়ে আমাকে বলেছেন সন্তানের জন্য আমি এই সংসারে আছি। কিন্তু একটি ভাঙা সংসারে একটি বাচ্চা সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে না। আর এ ধরনের নির্যাতন হলে প্রতিটি মেয়ের জানা উচিত জার্মান আইন সম্বন্ধে। পুলিশের সাহায্য অন্যতম ভূমিকা রাখে। জার্মান পুলিশেরা পারিবারিক নির্যাতনের বিষয়গুলোতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত থাকে। নির্য়াতিতদের বলছি, আপনার ওপর যেকোনো শারীরিক নির্যাতন হওয়া মাত্রই ১১০তে কল করুন। যদি আপনি ক্রমাগত নির্যাতনের শিকার হতে থাকেন, তা পুলিশকে অবহিত করুন এই বলে যে, আপনি কীভাবে আহত হয়েছেন। যদি ভীষণ বিপদে পড়েন তবে বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্য কোথায় আশ্রয় নিন এবং পুলিশকে সে বিষয়ে অবহিত করুন। পুলিশ আসামাত্র আপনাকে আলাদা করে ইন্টারভিউ নেবে। তারপর আপনাকে ওই ক্রাইম এলাকা থেকে সরিয়ে নেবে যদি আপনার সন্তান থাকে তাকেসহ।
আপনি ভুলেও ডকুমেন্ট হারাবেন না বা হাতছাড়া করবেন না। আপনার স্বামী যদি অতীতে এসব কাজ করে থাকে পুলিশকে তা বলতে ভুলবেন না। শরীরে কখনো বিশেষ আঘাত করলে পুলিশ আপনাকে চিকিৎসা করতে পাঠাবে। এই সময় পুলিশ অপরাধীকে বাড়ি ছেড়ে যেতে বলবে, তার চাবি কেড়ে নেবে এবং তাকে বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দেবে না। এই নিষেধাজ্ঞা প্রায় ১৪ দিন পর্যন্ত থাকবে। পুলিশ তাকে একটি রেস্ট্রেইন অর্ডার দেবে যে আপনার বা আপনার সন্তানের কাছে আসতেই পারবে না। এই আদেশ আপনার কাজের জায়গা, বাচ্চাদের স্কুল সব জায়গার জন্য বলবৎ থাকবে। আপনি পরবর্তীতে একজন উকিল নিতে পারেন, যিনি আপনাকে সার্বক্ষণিকভাবে সাহায্য করতে পারেন।
এরপরও যদি আপনাকে বিভিন্নভাবে বিরক্ত করা হয় আপনি সব সময়ই পুলিশ বা উকিলকে জানাতে পারবেন। আর আপনি যদি আপনার অপরাধী সঙ্গীর বাসস্থানে না থাকতে চান তবে নির্যাতিত নারীদের জন্য তৈরি নিরাপদ আশ্রয়ে আশ্রয় নিতে পারেন। বাড়ি ছাড়ার সময় নিচে লিখিত জিনিসগুলো সঙ্গে নিতে ভুলবেন না।
আপনার আর আপনার সন্তানের পাসপোর্ট। বার্থ অথবা ম্যারেজ সার্টিফিকেট। হেলথ ইনস্যুরেন্স ডকুমেন্ট। এ ছাড়া রেসিডেন্স পারমিট, রেন্টাল ও ওয়ার্ক কন্ট্রাক্ট, টাকা, ওষুধ, কিছু কাপড়চোপড়, খেলনা, ফটো সঙ্গে নিতে ভুলবেন না। আপনার নতুন ঠিকানা রেজিস্ট্রি করার পর এই ঠিকানা সম্পূর্ণরূপে ব্লক করে রাখার ক্ষমতা আপনি রাখতে পারবেন। নারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে আপনি অ্যাপার্টমেন্ট পাবেন। আপনি ইচ্ছা করলে এক শহর থেকে আরেক শহরে চলে যাবেন। ওই শহরের যেকোনো স্কুল আপনার সন্তানদের ভর্তি করতে বাধ্য।
জার্মানিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অনেকেই এ দেশে থেকে এ দেশের অনেক কিছুই তাদের আকর্ষণ করে না। আর সেই কারণেই এ দেশে থেকেও বহু নারী পরাধীন জীবনযাপন করেন। একটা অসহায়ত্ব তাদের ভেতরে সব সময়ই কাজ করে। এ দেশের ভাষা শেখার সুযোগ পেলেও গ্রহণ করেন না। অন্যদিকে কিছু নারী অধিকারের লড়াই করে বাঁচতে চাইলে গোটা বাঙালি কমিউনিটির কাছে আঙুল দিয়ে চিহ্নিত হন। মিথ্যা চারিত্রিক অপবাদ দিয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করা হয়। অথচ কাগজের লোভে বহু পুরুষ বয়স্ক নারী বা জাঙ্কি বিয়ে করেছে প্রথম জীবনে। বাঙালি মেয়েদের বোঝা উচিত এটা একটা উন্নত দেশ যেখানে মানুষের জীবন ব্যবস্থা সুনিয়ন্ত্রিত।
জার্মান নারীরা অধিকার সচেতন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তারা নিজের অধিকার অর্জন করে নিয়েছেন প্রতিবাদ আর চেষ্টার মাধ্যমে। ১৯৪৯ সালে নারী-পুরুষ সমান এই আইন চালু হয়। ১৯৭৭ সালে বিবাহে নারী-পুরুষের সমতা আইন তৈরি হয়। একটা দম্পতি যদি তালাকে সিদ্ধান্ত নেয় তবে তাকে এক থেকে তিন বছর আলাদা থাকতে হয়। কিন্তু সম্পর্কে ভায়োলেন্স থাকলে দ্রুত তালাক পাওয়া যায়। সেপারেশনের পর দম্পতিদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকে যা অনেক সময় দুজন মানুষকে একসঙ্গে করে দেয়।
আধুনিক জার্মান নারীরা কিন্তু খুব অধিকার সচেতন। তারা আমাদের দেশের নারীবাদীদের মতো নেটওয়ার্কে ফেমিনিজম ছড়িয়ে দিচ্ছেন। টুইটারে হ্যাশ ট্যাগের মাধ্যমে আউট ক্রাই বা চিৎকার ছড়িয়ে অনেক ইস্যুকে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যান। নতুন আইন অনুসারে প্রতিটি কোম্পানিতে supervisory পদে রাখতে হয়। প্যারাগ্রাফ ১৭৭ অনুসারে যৌন নির্যাতনের শাস্তি এক থেকে ১০ বছরের জেল হতে পারে। অপরাধের ধরন অনুসারে এই শাস্তি দেওয়া হয়। আঘাত বা মৃত্যু ঘটালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
বিবাহিত জীবনে ধর্ষণকেও অপরাধ হিসেবে ধরা হয়। যদিও অনেক বাঙালি এটাকে ধর্ষণ বলে হয়তো মনেই করেন না। বয়সে বিরাট পার্থক্য এবং যৌন জীবনে মারাত্মক অসুখী কিছু বাঙালি নারী দিনের পর দিন ভুগে ধ্বংস হয়ে যান। কিন্তু খুব সাহসী দুই একজন মেয়ে মুখ খুলে মাথা ভর্তি অপবাদ নিয়ে লড়াই করেন। অবশ্য কিছু অভিযুক্ত বাঙালি যে আইন দেখেছে তা তাদের সারা জীবনের শিক্ষা হয়ে থাকবে। জার্মানিতে এক সময় মেয়েদের তিনটা K দিয়ে বোঝান হতো Kirche, Küche, Kinder (church, kitchen, children)। আজ বিংশ শতাব্দীতে জার্মান মেয়েরা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এখানে সিঙ্গেল মায়ের সুবিধা বিবাহিত মায়ের চেয়ে কম নয়। তবুও জার্মান আইনে বহু ফাঁক ফোকর আছে এবং অনেক নারী সমতাতে সন্তুষ্ট নন। দিন দিন সরকার আইনের নানা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন।
এখানে সন্ধ্যার পর একা একা হাঁটি। কেউ ইভ টিজিং করে না। ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারীদের পদচারণা। এ দেশে এসে আমি শিখেছি সমতা, নিজের অধিকার। এমন দেশকে তো না ভালোবেসে পারা যায় না।
রুখসানা কাঁকন: এক্সিকিউটিভ, টেলিকমিউনিকেশন।