আখলুছ মিয়ার শেষ দিন

আইজ কিলা আছইন মিস্টার মিয়া।

আখলুছ মিয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কথা বলতে আজ কষ্ট হচ্ছে, উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করছেন না। অনেক দিন হাসপাতালে থাকতে থাকতে বুঝে গেছেন এগুলো শুধুই জিজ্ঞেস করার জন্যই করা। এ নার্স যেমন জিজ্ঞেস করেছে, ডাক্তারও তেমনি করবে, লৌকিকতার জন্য, ভদ্রতার জন্যই জিজ্ঞেস করা। তারাই ভালো জানেন তিনি কেমন আছেন। সময় যে ফুরিয়ে আসছে বা ফুরিয়ে গেছে, তা তিনি যেমন জানেন, তারাও লুকাচ্ছেন না।

আখলুছ মিয়া আর দিন গোনেন না, শুধু অপেক্ষা করেন, অপেক্ষা করেন শেষ দিনের। কিছুদিন আগেও আখলুছ মিয়া দিন গুনতেন—দিন–তারিখ জানতেন। পুরোপুরি ভালো হবেন না জেনেও মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন কিছুটা ভালো হলে, হাসপাতাল থেকে কদিনের জন্য ছাড়া পেলে একবার বেড়িয়ে আসবেন, দেখা করে আসবেন পুরোনো কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। না, তেমন ঘনিষ্ঠ কেউ নেইও আখলুছ মিয়ার। তবু এই তবুরও কোনো ব্যাখ্যা পান না তিনি। মন চায় হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একটু বেড়াতে। কেন মন চায়, তা–ও বোঝেন না, এখন আখলুছ মিয়া বোঝেন না অনেক কিছুই। তার সব আশা, সব স্বপ্ন যেন থেমে গেছে, ভোঁতা-বন্ধ্যা এক ভাবনায় ডুবে আছেন তিনি।

কিতা চিন্তা খরইন? হাসিমাখা মায়াবী মুখের নার্সের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় ছেদ পড়ে আখলুছ মিয়ার। বিশ–একুশ বছরের এ মেয়েটি তাকে মিস্টার মিয়া বলে ডাকেন, এ ডাকটিও পছন্দ হয়নি আখলুছ মিয়ার। প্রথম দিনই, মাস দেড়েক আগে, যখন এ নার্সের সঙ্গে, মেয়েটির সঙ্গে কথা হয়, নেম ট্যাগে লুবনা আলী নামটি দেখেন। জানতে পারেন মেয়েটি বাংলাদেশি। পরিচয় হয়, সেদিনই তিনি নিঃসংকোচে, নির্দ্বিধায় বলেছিলেন, ‘মিস্টার মিয়া কিতা বেটি, আমারে চাচা ডারবায়...।’

ডোরাকাটা নার্সের ফ্রক পরা স্বদেশি মেয়েটিকে নার্সের আসন থেকে নামিয়ে দেন তিনি। কন্যাস্নেহে মেয়েটিকে তার তৃষ্ণার্ত শুষ্ক হৃদয়ে বসিয়ে দেন নিমেষেই। হেসেছিল মেয়েটি সেদিন। যে হাসিতে ছিল না হ্যাঁ কিংবা না। নার্সটি পেশাগত দূরত্বে থেকেও কিছুটা নৈকট্য দিয়েছিল বৈকি। সিলেটি ভাষায় কথা চালিয়ে ছিল নার্স। যদিও সে ভাষায় সে নিজেও তেমন স্বাচ্ছন্দ্য না। সে চেষ্টা করেছিল আধো আধো বাংলা বলে কিছুটা আন্তরিক, সামান্য ঘনিষ্ঠ হতে। চাচা কিংবা মামা সম্বোধনে যায়নি যদিও। আখলুছ মিয়া তুমিতে নেমেছেন নিমেষে, নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে।

মিস্টার মিয়া উত্তরের অপেক্ষা করে না। নার্স লুবনা আলী আখলুছ মিয়ার ফাইল নেয়। ফাইল নেড়েচেড়ে দেখে রোজকার মতো, মনিটরের দিকে তাকায়, কলম চালায় মাঝেমধ্যে, কলম চালাতে চালাতে আবারও কথা বলে, ‘তারা লুইশাম খোঁজ খরছিলা, আফনার কোনো আত্মীয়স্বজনের সন্ধান ফাইছইন না।’

আখলুছ মিয়ার অবিন্যস্ত ভাবনা কিছুটা গতি পায়, মনে পড়ে মাস ছয়েক আগে যখন তিনি জিপির কাছে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন, তখনই শুনছিলেন রেস্টুরেন্টটি বিক্রি হয়ে যাবে, কথাবার্তা চলছে। অনেক দিন ধরে এ রেস্টুরেন্টে কাজ করার সুবাদে মালিকসহ সবাই ঘনিষ্ঠ, সবাই বন্ধু, সবার সঙ্গেই তার সদ্ভাব। কিন্তু নিজের শারীরিক গুরুতর সমস্যার কারণে তিনি এসবে কৌতূহল বা মনোযোগ দিতে পারেননি। ওই সময় বেশ কিছুদিন ধরে জ্বর আর সর্দিতে ভুগে যখন সার্জারিতে যান, আখলুছ মিয়ার জিপি ডা. পন্ডিয়া, কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করান—রক্ত, আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট দেখে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তোমার মনে হয় এবারের সামার হলিডেটা হাসপাতালেই কাটাতে হবে মি. মিয়া।

বছর তিনেকের পরিচিত ডা. নীরেশ পান্ডিয়া সব সময় কৌতুক করেন, হেসে, অন্যকে হাসিয়ে কথা বলেন। ওই দিনও হেসে হেসেই তার শরীরে প্রাণঘাতী রোগের বাসা বাঁধার খবরটি জানান—আশ্বস্ত করেন, আজকাল ক্যানসার কোনো রোগই না মি. মিয়া। যদিও বুঝতে পারছি না কীভাবে এত তাড়াতাড়ি স্টেজ চারে চলে গেল। চিন্তা কোরো না, সেন্ট মেরি হসপিটালে খুব ভালো চিকিৎসা হয়।

এ কথাগুলো ধরা গলায় বললেও আবারও হাসেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ডাক্তার পান্ডিয়া, ভালো হয়ে আসো মি. মিয়া, তোমাদের রেস্টুরেন্টে একদিন যাব, তোমার রান্না খেয়ে আসব। হা হা হা।

প্রতিবারই ডা. পান্ডিয়া এ কথা বলেন। মিয়াও স্বাগত জানিয়েছিলেন, কোনো দিন যাননি। ওই দিন মিয়া কী উত্তর দিয়েছিলেন মনে নেই, শুধু মনে আছে রিসেপশনের মেয়েটি অতি আন্তরিকতায়, অতি ব্যস্ততায় সেন্ট মেরি হাসপাতালের রেফারেন্স লেটারসহ সব কাগজ বুঝিয়ে দিয়েছিল তাকে। আজ প্রায় ছয় মাস আখলুছ মিয়া সেন্ট মেরি হাসপাতালের নাভানা ওয়ার্ডে আছেন। দিন গোনা শেষ হয়েছে, এবার যাওয়ার পালা মনে হচ্ছে। না! যাওয়া নিশ্চিত আখলুছ মিয়ার।

আমার তো খেউ নাই গো মাই, তোমরারে আগেই খইছি। অসংখ্যবার বলা মিথ্যাটি আবারও বলেন মি. মিয়া। সারা জীবন মিথ্যা না বলা মানুষ আখলুছ মিয়া। জীবনসায়াহ্নে একটি মিথ্যা বলছেন, বলছেন সচেতনভাবে, বলছেন অপারগ হয়ে, অনন্যোপায় হয়ে। না! মিথ্যাটি এখানে এ হাসপাতালেই যে বলছেন তা নয়, এ মিথ্যাটি আখলুছ মিয়া বলছে প্রায় ছয়-সাত বছর ধরে।

ঠিকানাহীন আখলুছ মিয়া দীর্ঘ সময় ধরে। যেখানে থাকেন সেখানেই ঠিকানা। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহর শেষে গত তিন বছর ছিলেন সাউথ ইস্ট লন্ডনের লুইশামে। লুইশামের এ রেস্টুরেন্টের ঠিকানাই আছে সেন্ট মেরিতে। তার জিপি থেকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ই সেন্ট মেরি হাসপাতালের ঠিকানা পেয়েছে। লুইশাম যোগাযোগ করছিল চ্যারিটি সংস্থাটি, বাঙালি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টটিই আর সেখানে নেই। মালিকানা বদল হয়ে সেখানে আজ একটি টার্কিশ রেস্টুরেন্ট। টার্কিশ মালিক বা ওখানকার কেউ আখলুছ মিয়ার কোনো আত্মীয়স্বজনের সন্ধান দিতে পারেনি।

চ্যারিটির মানুষ আফনার সঙ্গে মাতবা। আখলুছ মিয়ার বুঝতে অসুবিধা হয় না, মেয়েটি স্পষ্ট করে, সরাসরি বলতে পারছে না, তার সৎকারের ব্যবস্থা একটি চ্যারিটি সংগঠন করবে। এ নির্মম সত্য সংবাদটি জানাতে তার এত সংকোচ, এত অস্বস্তি। লুবনা আলীর জন্য আখলুছ মিয়ার মন আবারও আর্দ্র হয়, প্রতিদিনের মতো আবারও ইচ্ছে হয় মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুবন্যায় ভাসতে, মনের কোণে জমে থাকা এত দিনের অব্যক্ত শোকস্মৃতি উজাড় করতে।

কোনো অসুবিধা নাই গো মা, আল্লাহ তার বান্দারে...। কথা শেষ করেন না বা করতে পারেন না আখলুছ মিয়া। তিনি চোখ বন্ধ করেন বা চোখ বন্ধ হয়ে যায়। আখলুছ মিয়া ভাবনার অতলে ডুব দেন নাকি কোনো স্বপ্নলোকে, কল্পলোকে প্রবেশ করেন। তার সাত–আট বছর বয়ে বেড়ানো অস্বস্তি, গ্লানি, যন্ত্রণা কিছুই মনে নেই। তিনি প্রফুল্লচিত্তে, প্রশান্ত হৃদয়ে কোথায় যেন দিনাতিপাত করছেন। এমনি সুখানুভূতির মধ্যেই তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। তৎক্ষণাৎ তিনি তার স্ত্রী সুরাইয়ার মা মনোয়ারা বেগমকে দেখতে পান, তার মনে হয় এখনই মনোয়ারা দেরিতে ঘরে ফেরার জন্য অনুযোগ করবেন। আখলুছ মিয়াও একটি বানানো কৈফিয়ত দিয়ে স্ত্রীর মান ভাঙাবেন। না, স্ত্রী কোনো অনুযোগ করেন না। যেন তিনি দেখেন মনোয়ারা করুণ চোখে তাকিয়ে আছেন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনোয়ারা বলেন, ‘কী লা ফারলায় তুমি আমরারে ছাইড়া অত দিন থাকতে...’। কোনো কৈফিয়ত, কোনো উত্তর দিতে পারেন না তিনি বা দেন না। একি সুরাইয়ার মা মনোয়ারা বেগম নন, সাত বছর বয়সে হারানো মা, যার সঙ্গে তার তেমন কোনো স্মৃতিই নেই, যেন সেই মমতাময়ী মা নসিমন বিবি। মা শাসনের সুরে বলেন, ‘কিতা বেটা আখলুছ, কি লা ফারলে তুই আমার নাতিনিটারে তইয়া অত দিন থাকতে, তর মন কি ফাত্তরেরনি বেটা।’ তার মেয়ে সুরাইয়া আখলুছ মিয়ার কথা মনে পড়ে। বোধে আবারও সেই পুরোনো গ্লানি, যন্ত্রণা শুরু হয়, তিনি যেন ফিরে যান আট বছর আগের ওল্ড হামের চার্চ রোডের তার তিন কামরার ঘরটিতে।

নসিমন বিবি বলতে থাকেন, ‘সুরাইয়া তার পছন্দের ফুলাটারে বিয়া করছে, তুই ঘর-বাড়ি ছাইড়া দিয়া নিরুদ্দেশ অই গেলে। বাফরে, ফুলাটা খারাপ না, নামাজ–রোজা করে, বাঙালি অইছে না ত কিতা অইছে...মন থাইক্যা সব বাদ দে রে বাপ, আমার নাতনিটারে মাফ কর, বড় কষ্ট ফাররে বেটা আমার বাইনে...’। আখলুছ মিয়ার কোনো উত্তর, কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা নেই। আবারও দৃশ্যপট বদলায়, আখলুছ মিয়া দেখেন তার মা তো নন, এ যে তার কলিজার টুকরা, একমাত্র সন্তান কিশোরী কন্যা সুরাইয়া, ঘন কোঁকড়ানো চুলের এক শিশুকন্যা, সুরাইয়া কাদতে কাঁদতে বলে, ‘বাবা দেখো, কোলে নেও, তোমার নাতনি...’। আখলুছ মিয়ার ঘোর কাটে না, তিনি হারাতে থাকেন কিংবা বিলীন হতে থাকেন অসীমের কোলে।

সুরাইয়া, সুরাইয়া...জড়িত স্বরে ক্ষীণ কণ্ঠে এ নামটি কানে আসতেই, নার্স লুবনা আলীর চোখ যায় মনিটরের দিকে, মনিটরে তাকিয়ে লুবনা স্তব্ধ, নিশ্চল হয়ে যায়। ক্ষণকালমাত্র, পরক্ষণে সে আখলুছ মিয়ার কাছে এসে পরম মমতায় মাথায় হাত রাখে, আখলুছ মিয়া এখন সব বোধ, সব অনুভূতি থেকে যোজন যোজন দূরে। তিনি বুঝতে পারেন না কয় ফোঁটা তপ্ত লোনা জল লুবনার গাল বেয়ে তার মুখে গিয়ে পড়ছে।