আকাশে তোমায় রাখি

—শোনো আমি সবাইকে নিয়ে কক্সবাজার আসছি।
কেন রে বাপ?—বলে ও চিৎকার করে উঠল।
—মানে কী? এমন চিৎকার করছ কেন?
—আমিও রুমাকে নিয়ে এখানে আসছি।
—তো? সমস্যা কী। তুমি তোমার মতো থাক। আমরা আমাদের মতো থাকব।
দোজা চুপ করে থাকে। একেবারেই নিশ্চুপ। ফোনের ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। রীমা ফোনের লাইন চেক করে দেখে সে ফোনের লাইন কাটেনি। তাকে লাইনে রেখেই সে কী যেন করছে। ও মাঝে মাঝেই এমন করে। রীমাকে লাইনে রেখে কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। এ কারণে রীমা তাকে এলিয়েন বলে ডাকে। আজব মানুষ সে।
—ওকে বাই। রীমা ফোনের লাইন কেটে দেয়। রীমা তার স্বামী, বাচ্চা ও ভাইবোন মিলে কক্সবাজার বেড়াতে এসেছে।
এলিয়েন আসছে ঢাকা থেকে প্লেনে। দোজাকে এলিয়েন ডাকার কারণ হলো এই মানুষটা হুট করেই তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। তার বউ রুমা কী যেন এক জটিল অসুখের কারণে হাঁটতে পারে না। হুইল চেয়ারে চলতে হয়। অনেক মিষ্টি আর ভালো একটা মেয়ে রুমা। দোজা তার সঙ্গে পাঁচ বছর টানা প্রেম করে বিয়ে করেছে। বিয়ের আগেই তার অজানা এই রোগ ধরা পরে। তখনই দোজা তাকে বিয়ে করে সারা জীবনের সঙ্গী করে দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। এই দম্পতির জন্য মায়া হয়। তাদের ভালোবাসা দেখলে খুশি লাগে। মানুষের মন ভালো হয়ে যায়। অনেকেই বলে রুমার কপাল দেখো, বরের আদরে-মায়ায় সে পরিপূর্ণ। দোজার মতে, অসুস্থতার সঙ্গে ভালোবাসা বা বিয়ের কী সম্পর্ক। রুমার পরিবারের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে সে তাকে বিয়ে করেছে। তার একটাই যুক্তি ছিল, অসুস্থ তো সে বিয়ের পরও হতে পারত। সে প্রতি বছর ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরে বউয়ের চিকিৎসা করায়। এ বিষয়ে তাকে কখনো অভিযোগ বা বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা যায় না।
দোজা কানাডায় পড়াশোনা করেছে। পেশায় আর্কিটেক্ট। তার বাবা বাঙালি, মা কানাডার। সে কানাডা থেকে রুমার জন্য একেবারেই চলে এসেছে। কারণ রুমা বিদেশ পছন্দ করে না। এখানে তার বড় বিজনেস। সবাই জানে সে স্মার্ট ও ভীষণ কাইন্ড বিজনেস ম্যান। প্রচুর ইয়ং ছেলে মেয়ে তার সঙ্গে কাজ করে। সবার সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক। সবাই এক বাক্যে বস সম্বোধন করে।
রীমা উচ্চ পদস্থ করপোরেট কর্মকর্তা। রীমারও শহরে বেশ নাম ডাক। রীমার অফিসের নতুন শাখা করা হবে। দোজা এসেছে ইন্টেরিয়রের কাজে। তখনই তাদের পরিচয়। দোজা বেশ স্মার্ট তবে সুপুরুষ না। তাকে দেখলেই প্রেমে পরে যাওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। তার মধ্যে মেয়ে ঘেঁষা অভ্যাস নেই। তাই তাদের মধ্যে সালাম-গুড মর্নিং-হ্যালো কেমন আছেন-ভালো আছি পর্যন্তই চলেছে।
সবই ঠিকঠাক ছিল। রীমা কেমন করে দোজার জীবনে যুক্ত হলো? বিষয়টা অনেকটাই হালকা। অগুরুত্বপূর্ণ। মাঝে মাঝেই মনে হয় শুধু শুধু। কোনো দরকারই ছিল না তাদের দুজনের সামান্য পরিচয় দীর্ঘায়িত করার। তারা দুজনে যার যার পরিবার নিয়ে সুখী। দোজা বা রীমার তাদের কারও জীবনে কোনো অভিযোগ নেই।
কিন্তু এই সম্পর্ক এখন এতটাই নির্ভরতার জায়গায় পৌঁছেছে যে এখান থেকে আর বের হয়ে আসাও কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। অন্যের কাছে এ সম্পর্কের নাম পরকীয়া মনে হলেও হতে পারে। তবে রীমা পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে তেমন একটা বিচলিত না। এই সম্পর্কের সমাজে যদি কোনো নেগেটিভ নাম দিয়ে থাকে তাতে তার কিছুই আসে যায় না। তারা দুজনেই মনে করে তারা শুধুই বন্ধু। দোজা রীমার জীবনে বড় বটগাছ। এমনই এক আজব নির্ভরতা যে এত দিন পর্যন্ত তারা দুজনে কোথাও একা বসে এক কাপ চাও খায়নি। কখনো আলাদা মিলিত হওয়ার বা দেখা করার কোনো তাগিদ অনুভব করেনি। কেউ কারও প্রতি কখনো শারীরিক আবেদন অনুভব করেনি অথচ ফোনে সাবলীল কথা চলে।
—শোন আজকে রুমার জ্বর আসছে। আমার শরীরও ম্যাজম্যাজ করছে।
রীমা উত্তর দেয়, বেশি বেশি বউয়ের গা ঘেঁষে থাকিস না। তোর কাল জরুরি মিটিং মনে আছে তো।
—ও হ্যাঁ তাই তো। ঠিক বলেছিস।
মাঝে মাঝেই হাসতে হাসতে বলে তুমি মিয়া আমার বউরে জেলাস করো। রীমা এ পাশ থেকে হাসে। এমনই এক মায়া আর সম্মানের বাঁধন তাদের।
রীমার অফিসের নতুন শাখার উদ্বোধন হওয়ার পর দোজা চলে গেল ঢাকায়। তার পর আর কোনো যোগাযোগ নেই। যোগাযোগ হওয়ার কথাও না। দুজনে ব্যস্ত। দোজা রীমার বন্ধুত্বের বয়স অনেক দিন কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে মাঝে মাঝেই ভিডিও কলে কথা বলা ছাড়া তাদের সরাসরি দেখা হয় না। আবার দেখা যায় ভিডিও কলে কথা বলার সময়ও কাজ করতে করতে কথা হয়।
কয়দিন পর দোজা বলেছে, তুমি তো দেখছি দিন দিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছ।
আচ্ছা! এত দিন পর মনে হলো? রীমা অবাক হয়েছে। দোজা কখনো রীমাকে ভালো করে খেয়াল করে দেখেছে বলে মনে হয়নি। এই দেখা করা বিষয়ে তারা কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি। মাঝে মাঝেই মজা করেই বলে সারা দিন এত ব্যস্ত থাকি যে তোমার কণ্ঠ শুনলে ভালো লাগে। তুমি চাইলে গান গাইতে পারো।
রীমা হাসে। ফাজলামি হচ্ছে? আমাকে কেন গান গাইতে হবে? আচ্ছা রাখি রে। পরে কথা হবে। এভাবেই খুনসুটির সম্পর্ক তাদের।
রীমা অফিসের কাজে ঢাকা আসা-যাওয়া করে। দোজার সঙ্গে ফোনে কথা হয় কখন কোথায় আছে না আছে সে বিষয়ে। রীমা কাজ শেষ করে চট্টগ্রামে ফিরে আসে। দুজনের ব্যস্ত নিয়মের চাপে তারা কেউই কখনো দেখা করার কথা বলে না। প্রেম ভালোবাসা থাকলে হয়তো দেখা করবার তাগিদ অনুভব করত। কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম ছাড়াই কারণে অকারণে কথা বলা বেড়ে যায়। সব সময়ই দুজনের মধ্যে মেসেজ চালাচালি চলে। কোন ফাঁকে যে তারা কথাবন্ধু থেকে দুজনের মনের বন্ধু হয়ে গেছে তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না। কথা বলতে না পারলেও টেক্সট করে। দুজন দুজনের সবকিছু শেয়ার করা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
—ক্ষুধা লাগছে রে, কি খাই বল তো?
—আমি কেমন করে বলব কি খাবে।
—রুমার কালও জ্বর আসছিল। আজকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
—জানিও ডাক্তার কী বলে। ওকে বাই।
—এই দেখ তো কোনো পেঁপেটা ভালো হবে কিংবা কিছু পেয়ারা কিনলাম।
এভাবেই কথা চলে। কখনো তুই কখনো তুমি। অল্প অল্প করে সম্পর্ক গাঢ় হয়। ইদানীং কথা বলতে একটু দেরি হলে অস্থির হয়ে যায়। রীমা ভাবে একজন আরেকজনের সঙ্গে পারস্পরিক সুসম্পর্ক সহজে গড়ে ওঠে না। আর যদি তা একবার গড়ে ওঠে তাহলে তা মনের গভীরে লালন করতে হয়। দোজা রীমা তাদের সম্পর্ক কে অতি যত্নে লালন পালন করে।
মেয়ের পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন। পরীক্ষার রেজাল্ট কেমন করছে সবই রীমার তাকে বলা লাগে। রীমার বরের ব্যবসার লস হবে দোজা কয়েক বছর আগে থেকেই বলেছিল।
—তোমার বর বলদটা বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। বিপদ ডেকে আনবে। তার ক্যালকুলেশন আমার পছন্দ না। ফোনটা দাও আমি ওনার সঙ্গে কথা বলব।
—বাদ দাও তো ওসব। ও ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করবে না। ওকে ওর মতো থাকতে দাও। প্লিজ
—দেখো, তোমার বিপদের কথা আমি ভাবতে পারি না। মেয়ে দুইটার জন্য সমস্যা হবে। ওরা বড় হচ্ছে।
রীমা চুপ করে বাধ্য মেয়ের মতো তার কথা শুনে যায়।
—কি লাভ এত ক্লাব সোসাইটি মেনটেইন করে। তুমিও কেন তার সঙ্গে তাল দিয়ে এসব পার্টিতে যাও? আবার দাঁত কেলিয়ে বুড়াদের সঙ্গে ছবি তোলে। তা আবার ফেসবুকে পোস্টও করেছ। এখন ডিলিট করো। ব্যাক্কল কোথাকার। জামাই বউ দুইটাই মরবি। মেয়ে দুটিকে আমার মেয়ে বলে লিখে দিয়ে মরিস।
রীমার ওপর তার অভিমান পরিষ্কার বোঝা যায়। সঙ্গে রীমাকে নিয়ে তার অভিযোগও তৈরি হয়। এ যেন এমন কেউ যেন কেউ একজন তাকে দুর থেকে অনেক বেশি আগলে রাখে, খেয়াল করে। মন ভালো হয়ে যায়। রীমার মাথা হালকা লাগে এই ভেবে যে, কেউ একজন গোপনে তার পরিবারের সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে।
সময় বয়ে যায়। তাদের সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হয় না। শান্ত নদীর মতো ধীর গতিতে বয়ে চলে। চাকরি ঘর সংসার এসব নিয়েই কথা বলে বছর পার করে। রীমা হোটেলে ঢোকার কয়েক ঘণ্টার পর টেক্সট মেসেজ আসে।
—তোমরা কোথায় উঠেছ?
রীমা জানায়, তারা কক্স টুডে তে উঠেছে।
—আমি প্যারাডাইসে। রুমাকে রুমে তুলতে খুব কষ্ট হয়েছে। এত বড় বড় ফাইভ স্টার হোটেলে কেন ডিজঅ্যাবল মানুষের জন্য কোনো র‌্যাম্প রাখে না বুঝি না। এ এক দেশ। তার আর উন্নতি। খালি উঁচু বিল্ডিং বানায়। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে রে।
—কেন লিফট আছে তো।
আরে গাধি রাস্তা থেকে লিফট পর্যন্ত আনতেই তো আমার জান বেরিয়ে গেছে।
—রুমাকে দেখাশোনার মেয়েটাকে নিয়ে আসনি কেন?
—সে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। তাই ভাবলাম আমিও বউকে নিয়ে এদিকটায় ঘুরে যাই। ওকে নিয়ে তো ঘোরাঘুরি হয় না। শুধু চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া।
—একা পারবে তুমি? কয়দিন থাকবে? না হয় এখানে আপাতত কয়দিনের জন্য একজন রাখো। হোটেলে বললে তুমি কাউকে পেয়ে যাবে।
—আরে না না। আজাইরা চিন্তা করো না। আমি পারব। তুমি এখানে আইসা আমার মাথাটা গরম করে দিয়েছ।
—কি আজব রে বাবা। হাজারো মানুষ কক্সবাজার বেড়াতে আসে। আমি আসলে ক্ষতি কী? মনে করো, আমি এখানে আসিনি। তুমি রুমাকে সময় দাও।
রীমার কথা দোজা মন দিয়ে শুনেছে। এই তিন দিনে আর কোনো ফোন দেয়নি। রীমাও ফোন দেয়নি। খুব ইচ্ছা ছিল রীমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে। কিন্তু এই বিষয়টা দোজা কীভাবে নেবে বা যদি বিরক্ত হয়ে যায় তাই আর ফোন বা মেসেজ দেয়নি। তিন দিন দেখতেই পার হয়ে গেল। শেষের দিন রীমারা ফিরে আসবে তাই পরিবারের সবাই ইনানি বিচসহ আশপাশের এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। রীমা রুমে একা শুয়ে-বসে থাকে। সে সবাইকে জানিয়ে দেয় তার শরীর খারাপ তাই বাইরে বের হবে না। রীমা হোটেলে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে। ওই দিনের পর থেকে দোজা আর কল দিল না। কোনো মেসেজও দিল না। কেমন একটু দুশ্চিন্তা হলো। ওরা কি চলে গেল নাকি এখনো আছে? রীমা হোটেল রুম থেকে বের হয় না। খালি মনে হয়, এই বুঝি দোজা তাকে ডাকবে। রীমা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে তার ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। রীমার মন চেয়েছে দোজা রুমাকে নিয়ে যদি একবার সমুদ্র সৈকতে যাওয়া যেত। অদ্ভুত সব ভাবনা মনের মধ্যে উঁকি মারে।
নাহ্, এর মধ্যে আর কোনো মেসেজ আসে না। সে মনে হয় বউয়ের হুইল চেয়ার টানা ও খাওয়া দাওয়া সব নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। ঢাকা ফিরে গেলে তো জানাতো। এসব এলোমেলো ভাবনায় ডুবে থাকে রীমা। এক সময় রীমার এক কাপ চা খাওয়া দরকার মনে হলো। আপন মনেই ঠিক করল কলাতলীতে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে একা একা গরম চা খাবে। এক মনে সে কলাতলীর দিকে হাঁটতে বের হয়।
এমন সময় দোজার মেসেজ আসে।
—তুমি গেলে না বাইরে বেড়াতে। সবাইকে দেখলাম দল বেঁধে ঘুরতে বেরিয়েছে।
—আমি ওদের সঙ্গে যাইনি। শরীর ভালো লাগছে না। এ ছাড়া বছরের দুই তিন বার তো আসা হয়ই। এর সবই তো দেখা। তাই যাইনি। তোমরা কী করো, কেমন আছ?
—আমরা ভালো আছি। রুমা ঘুমায়। আমি তার পাশে বসে বই পড়ছি।
—আচ্ছা পড়ো তাহলে।
—তুমি রুমে কী করো?
—আমিও রেস্ট নিতেছি। দোজাকে রীমা বলে না সে কলাতলীর দিকে হাঁটতে বেরিয়েছে।
—কি? মনে তো হচ্ছে তুমি হাঁটতে বের হয়েছ সমুদ্রের শব্দ শুনতে পেলাম।
—না রুমে ফ্যান চলে। আর কথা বলো না রুমা ঘুমায়। তুমি কথা বললে ও উঠে যাবে। বই পড়ছো পড়ো।
ওপাশ থেকে আবারও চুপচাপ নীরবতা। শুধু নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। রীমা ফোন কেটে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। যাক ওরা ভালো আছে শুনে মনটা ভালো হয়ে যায়।
রীমা ধীর গতিতে সমুদ্রের কাছাকাছি যেতে থাকে। অনেক মানুষের ভিড়। রীমা একটু নিরিবিলি পরিবেশ খুঁজতে যে দিকে মানুষের ঢল কম সে পথে হাঁটা শুরু করে। এখন ফেব্রুয়ারি মাস। হালকা শীতের বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যাটা মানুষ এখানে এনজয় করে। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সবার হানিমুনের জায়গা এই কলাতলীর স্পট। কোনো জুটি একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো জুটি একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে আছে। কেউবা হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সাগরের পানিতে পা ভিজিয়ে নিতেছে। সবকিছুই ভালো লাগার।
আজ রুমা জিন্স-ফতুয়া, পায়ে স্যান্ডেল আর গায়ে পাতলা চাদর জড়িয়েছে। বিচের পাশ থেকেই এক মগ চা নিয়েছে। দোকানিকে বলেছে, ফেরার পথে মগ দিয়ে যাবে তাই সে ঢাকনাঅলা বড় মগে চা দিয়েছে। স্যান্ডেলে বিচের বালি ঢুকে যাওয়ায় রীমার হাঁটার গতি ধীর হলো।
একদম হঠাৎ করেই কেউ হাত ধরে টান দিল। চিৎকার করতে যাবে তখনই এক ঝটকায় কেউ একজন তাকে বুকে জড়িয়ে নিল। রীমার পুরো শরীর অবশ হয়ে গেল। রীমা ওর মুখ দেখতে পায়নি। তবে শক্ত কবজির জোরেই ও বুঝতে পারে কে হতে পারে। এক ঝটকায় সরিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিজেকে রক্ত শূন্য মনে হলো। রীমা তার বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলো না। সে বুকে টেনে নেওয়া মানুষটার বুকের মধ্যে নিজেকে সঁপে দিলো। বুকে সাগরের গর্জন শুনতে পেল। অবশ হয়ে যাওয়া শরীরকে তার কাছে ছেড়ে দিয়ে বুকের খাঁজে মাথা ঢুকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। পাশ দিয়ে এক দুজন মানুষ হেঁটে গেলেও যেতে পারে, তারা কাউকে দেখছে না। সূর্য অস্ত যাওয়ায় পুরো এলাকা জুড়ে কমলা রঙের আলো-আঁধারের খেলা চলছে।
কোথায় যেন প্রিতমের গান বাজছে—
‘আকাশে তোমায় রাখি
মাটিতে তোমায়।
ভেতর-বাহির, কাছে-দুরে
যতনে রাখি তোমায়।
তুমি আমার ভীষণ খরায়
মরা নদীর ঢেউ।
তুমি ছাড়া পৃথিবীতে
নেই আমার আর কেউ রে।’
রীমার মুখ শুধু বুকের পাঁজরের শব্দ শুনছে। কিন্তু রীমা টের পেয়ে যায় সে কাঁদছে। রীমার মাথায় তার চোখের পানি পড়ছে। তার গলা বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে রীমার চোখ মুখ ভিজে যায়। রীমা তাকিয়ে দেখে না। সে সাগরের দিকে তাকিয়ে রীমাকে তার পাঁজরের কুঠিরে আটকে রেখে শব্দহীন বোবা কান্নায় মেতে উঠেছে। ও যদি শব্দ করে কাঁদতে পারতো তাহলে নির্ঘাত তার আওয়াজ সাগরের ঢেউকে ছাড়িয়ে যাবে। রীমা ভুলে যায় সময়। রীমা তার গলা পর্যন্ত নেমে আসা চোখের পানি চুমু দিয়ে টেনে নেয়। সারা চোখে মুখে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। শুধু পারে না বুকের পাঁজরের কুঠিরে আটকে রাখা কান্না চুষে নিতে। কান্না তোমাকে মানায় না। তুমি তো নজরুলের সেই বিখ্যাত বীর। রীমা পাগলের মতো মুখে ঠোঁটে চুমু দিয়ে যায়। সে নির্বিকার হয়ে শুধু শক্ত করে জড়িয়ে থাকে। সে কোনো চুমু ফেরত দেয় না। আজ যেন তার শুধুই নেওয়ার দিন। চুমুর বদলে চুমু দিতে হয় সেই সময়ে হয়তো সে ভুলে গেছে। তার বুকের মধ্যে চেপে থেকেই একটা সময় রীমা কথা বলল:
—কী হয়েছে তোমার? এমন করে কাঁদছ কেন? বলো কী হয়েছে।
এবারও কোনো উত্তর দেয় না। শুধু সাগরের বুকে চেয়ে থাকে। রীমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এই বাঁধন খুলে রীমাও বের হতে চাইছে না। রীমা তার বুকে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার হয়ে গেছে সমুদ্র পাড়ে মানুষ কমতে থাকে। ওদের দুজনের বাঁধন তখনও খোলে না।
দোজার কান্না এক সময় থামে। রীমাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলে চলো রাত হয়েছে। তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দিই।
রীমা বলে, আরেকটু থাকি?
—না চলো চলো। বুক থেকে সরিয়ে হাত ধরে হাঁটতে থাকে। রীমার পা ভারী হয়ে গেছে। ও হাঁটতে পারে না। রক্ত শূন্য অবশ শরীর নিয়ে রীমা হাঁটতে পারে না।
কী হলো হাঁটছ না কেন। দেখছ না মানুষ নাই, খালি হয়ে গেছে। জায়গাটা ভালো না। চলো চলো বলে তাগাদা দেয়।
—কী হয়েছে তোমার বলোনি তো।
আবার এক ঝটকায় জড়িয়ে ধরে। আবার কপালে চুমু দেয়। —বলে কিছু হয়নি। আমার শুধু একটি দিন সবার মতো বাঁচতে ইচ্ছে করে।
—আমি কী করতে পারি।
—তোমার কিছুই করতে হবে না।
—শুধু এভাবেই আমার পাশে আজীবন থাকবে কথা দাও।
রীমা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। আমি আছি। দুজনে হাত ধরাধরি করে সাগরের কুল ঘেঁষে হাঁটতে শুরু করে। পথ শেষে গন্তব্য যার যার আলাদা হবে সেটা দুজনেই জানা আছে। কিন্তু কতটা আলাদা। আজ সাগরের ঢেউ যে সুনামির জন্ম দিলো তার কী কোনো নতুন পথ তৈরি হবে? এ ভাবনা থেকেই যায়।
মধ্য বয়সে কী পলাশের রক্তিম রং মনে লাগাতে নেই? হয়তো নেই। এই নেই সেটা কাদের জন্য? কে তৈরি করেছে এই না মানা বাঁধন। কিন্তু অন্যদিকে যে আজ জাগ্রত বসন্ত। সেই তো প্রথম চোখে চোখ। হাতে হাত। হাজারো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের নকশা বোনা বেগুনি সন্ধ্যা। চুমুর চরৈবেতি। শিরা উপশিরায় বেপরোয়া স্রোত। ঠোঁটে ঠোঁট আর ম্যাজিকের মতো যৌবনের ঝিলিক খেলেছিল। এরই নাম তো যৌবন। এরই নাম তো ভালোবাসা। রীমার নিজেকে মনে হলো প্রথম দিনের কলেজে পড়ুয়া কেউ। বয়স ভুলে তারা দুজনেই। এই তো অল্প আগেই সে টের পেয়েছে প্রথম যৌবন। সে তো যৌবনের রক্তই ফিনকি দিয়ে উঠেছে। হেলাল হাফিজের কথায়—‘কোনো দিন, আচমকা একদিন
ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,
চলো, যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাই, যাবে?’
আবারও দূরে বেজে ওঠে—
আকাশে তোমায় রাখি
মাটিতে তোমায়।
ভেতর-বাহির, কাছে-দুরে
যতনে রাখি তোমায়।
তুমি আমার ভীষণ খরায়
মরা নদীর ঢেউ।
তুমি ছাড়া পৃথিবীতে
নেই আমার আর কেউ রে।