অ্যান্টিবডি টেস্ট: কোভিড রোগীদের আশার আলো

প্রতীকী ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

এখন অবধি কোভিড-১৯ মহামারি সম্পর্কে বিশ্ব যে বিষয়টি সবচেয়ে ভালোভাবে শিখেছে, সেটা হলো রোগের পরীক্ষার (টেস্টিং) প্রয়োজনীয়তা। অর্থাৎ কে এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত তা জানা, যা রোগীর পৃথকীকরণের (আইসোলেশন) প্রথম ধাপ হিসেবে কাজ করে।

প্রথমেই বলে রাখি বাংলাদেশে আজ অবধি প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজারের মতো মানুষ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। সংক্রমণের এই হার এখনো ঊর্ধ্বগামী। সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর অসুস্থ রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছাতে এখনো অনেক বাকি। কাজেই ধারণা করা হচ্ছে, এই সংখ্যাটা সামনের দিনগুলোতে আরও অনেক বাড়তে থাকবে। এ অবস্থায় প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি আসলেই পর্যাপ্ত রোগ শনাক্তকরণের মাধ্যমে রোগীর পৃথকীকরণ সফলভাবে করতে সমর্থ হয়েছি বা সামনের দিনগুলোতে আদৌ সমর্থ হব? সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। আরও প্রশ্ন থেকে যায়, এই গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসাসেবা কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি?

তাহলে এ অবস্থায় আমাদের কী করণীয় হতে পারে? এ ক্ষেত্রে রোগনির্ণয়ের সঠিক পদ্ধতির ব্যবহার একটি ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস।

সম্প্রতি বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগ নির্ণয়ে পিসিআর (ভাইরাসজনিত) এবং অ্যান্টিবডি (সেরোলজিক্যাল) টেস্ট দুটির কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত কিটটি প্রচারে আসার পর অ্যান্টিবডি টেস্ট নিয়ে জনমনে একটা নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই এই দুটি টেস্টের মধ্যে প্রয়োগগত পার্থক্য নিয়ে আলোকপাত করা যাক।

করোনাভাইরাস (SARS-CoV-2) শনাক্তকরণ দুটি উপায়ে হতে পারে। রোগ সংক্রমণের একদম প্রাথমিক পর্যায়ে সরাসরি ভাইরাসের উপস্থিতি যে পদ্ধতির মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়, তা পলিমারেজ চেইন বিক্রিয়া (পিসিআর) হিসেবে পরিচিত। এই পরীক্ষায় প্রথমে করোনাভাইরাস থেকে জিনগত উপাদান (জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল) শনাক্তকরণের জন্য রোগীদের গলার পেছন বা অনুনাসিক অনুচ্ছেদ (nasal passage) থেকে কোষ সংগ্রহ করা হয়।

পিসিআরের মাধ্যমে সাধারণত ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড সংক্ষেপে ডিএনএর (এটি প্রায় সব জীবের মধ্যে বিদ্যমান, যা একটি জীবের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলির বাহক হিসেবে পরিচিত) একটি নির্দিষ্ট অংশ চিহ্নিত করে বেছে বেছে জিনগত উপাদানগুলোর খুব সামান্য পরিমাণ অংশকে সংখ্যায় বৃদ্ধি করা হয়।

করোনাভাইরাস একটি আরএনএ (রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) ভাইরাস কাজেই কোভিড-১৯–এর পরীক্ষা দুই ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথমে ভাইরাসের আরএনএটি ডিএনএতে রূপান্তর করা হয় এবং পরে ডিএনএটি পিসিআরের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়, যা রোগ সংক্রমণের যেকোনো পর্যায়েই ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করতে সক্ষম। এ জন্য পিসিআর টেস্টকে রোগ শনাক্তকরণের গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এবার আসি শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের দ্বিতীয় পদ্ধতি নিয়ে যেটিকে ক্লিনিশিয়ান এবং গবেষকেরা সেরোলজি টেস্ট বলে থাকেন। এটি বাণিজ্যিকভাবে অ্যান্টিবডি টেস্ট নামে পরিচিত।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, যখন কোনো রোগজীবাণু (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা প্রোটোজোয়া পরজীবী) মানবদেহকে (Host) সংক্রামিত করে, তখন মানবদেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা (immune system) এবং জীবাণুর মধ্যে একধরনের যুদ্ধ (battle) শুরু হয়। এই যুদ্ধের ফলাফলই নির্ধারণ করে কে শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে বেঁচে (হোস্ট নাকি জীবাণু) থাকবে এবং পুনরুদ্ধার (recover) করবে কি না। সাধারণত জীবাণুকে ঘায়েল করার জন্য লড়াইয়ের প্রক্রিয়াতে শরীরের প্রতিরোধব্যবস্থা (Immune system) একধরনের ছোট প্রোটিন–জাতীয় পদার্থ তৈরি করে, যাকে অ্যান্টিবডি বলা হয়। তাই অ্যান্টিবডি বা সেরোলজি পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তের নমুনায় সরাসরি জীবাণু শনাক্তকরণের পরিবর্তে রোগীর শরীরে ভাইরাস প্রতিরোধক দুই ধরনের অ্যান্টিবডির (IgM এবং IgG) সন্ধান করা হয়।

শরীরে একটি নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডির (IgM অথবা IgG) উপস্থিতি পরামর্শ দেয় যে কেউ পূর্বে করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছিলেন কি না। এই অ্যান্টিবডিগুলো ক্ষেত্রবিশেষে তৈরি হতে ১-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত লাগতে পারে। তাই এই পরীক্ষা শরীরে ভাইরাস উদাহরণস্বরূপ করোনাভাইরাসের উপস্থিতি দেখাতে সক্ষম না–ও হতে পারে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তকরণের জন্য অ্যান্টিবডি টেস্টটি ব্যবহার করা হয় না।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে অ্যান্টিবডি টেস্টটি এই মুহূর্তে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

বেশ কয়েকটি কারণে অ্যান্টিবডি টেস্ট দেশের ক্রমবর্ধমান মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলায় ফলপ্রসূ ভূমিকা বয়ে আনতে পারে।

প্রথমত, পূর্বে সংক্রামিত হয়েছিল, কিন্তু রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়নি তাদের অবস্থা জানার জন্য।

গবেষণায় দেখা গেছে করোনাভাইরাসে সংক্রামিত হলেও অনেকের শরীরে অসুস্থতার কোনো হালকা লক্ষণ না–ও দেখা যেতে পারে। ফলে তারা নিজের অজান্তেই রোগ ছড়াতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি টেস্ট এসব রোগীকে (যাদের রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি) শনাক্ত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া এই পরীক্ষার ফলাফল ডাক্তারকে রোগীর পরবর্তী চিকিৎসা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, বর্তমানে বহুল আলোচিত কনভ্যালসেন্টস প্লাজমা থেরাপির জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট অত্যন্ত জরুরি।

কনভ্যালসেন্টস প্লাজমা থেরাপি (Convalescent plasma therapy) হলো একজন রোগ নিরাময় হওয়া কোভিড-১৯ রোগীর অ্যান্টিবডি–সমৃদ্ধ রক্তরস (প্লাজমা), যা অন্য একজন কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা। অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির রক্তে কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির মাত্রা নির্ধারণ করা যেতে পারে। সম্প্রতি চীনে সম্পাদিত দুটি গবেষণায় ফলাফলে দেখা গেছে কনভ্যালসেন্টস প্লাজমা থেরাপি কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে। এ ছাড়া গত ১৪ এপ্রিল তেহরান টাইমসে প্রকাশিত এক খবরে দাবি করা হয়েছে প্লাজমা থেরাপি কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যুহার ৪০ শতাংশ হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে। এদিকে আমেরিকাতেও এই মুহূর্তে কনভ্যালসেন্টস প্লাজমার ওপর এফডিএ অনুমোদিত বেশ কিছু ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগসংক্রান্ত নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় এই থেরাপিটি বাংলাদেশেও প্রয়োগের খবর প্রকাশিত হয়েছে। বাজারে ভ্যাকসিন বা অন্য কোনো কার্যকারী ওষুধ না আসা পর্যন্ত এখন পর্যন্ত এটিকেই সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল থেরাপি মনে করা হচ্ছে।

তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবডি–সমৃদ্ধ প্লাজমার ঘাটতির খবর প্রকাশিত হয়েছে। অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও প্লাজমার খোঁজ করছেন বলেও জানা গেছে।

এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে কনভ্যালসেন্টস প্লাজমা থেরাপিকে বড় পরিসরে প্রয়োগ করতে দরকার একটি সমন্বিত ব্যবস্থার। এর জন্য প্রয়োজন অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে কোভিড-১৯ রোগে বেঁচে যাওয়া যেসব রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে, তাদের আলাদা করা এবং যারা প্লাজমা দান করতে ইচ্ছুক, তাদের প্লাজমা সঠিকভাবে সংগ্রহ করে এর যথাযথ ব্যবহার করা। উদাহরণস্বরূপ এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত র‍্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের সঠিক প্রয়োগ হতে পারে, যেহেতু এটি অ্যান্টিবডি টেস্টে ৭০ শতাংশ কার্যকর ফল দিয়েছে।

এ ছাড়া ভ্যাকসিন তৈরি করতে বা এর বিকাশে সহায়তা করার জন্যও অ্যান্টিবডি টেস্ট জরুরি ভূমিকা পালন করে থাকে। যখন কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে শরীরে নির্দিষ্ট কোনো ভ্যাকসিন ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়, তখন এটি মানুষের শরীরে ওই নির্দিষ্ট জীবাণুর সংক্রমণ অনুকরণ করে। ফলে এটি সংক্রমণের বিরুদ্ধে শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা তৈরিতে সহায়তা করে, যাকে অ্যান্টিবডি বলা হয়ে থাকে। কোনো সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের প্রতি শরীরের প্রতিক্রিয়া তথা তৈরি করা অ্যান্টিবডির যাচাই করার জন্য অ্যান্টিবডি টেস্টের প্রয়োজন।

এ আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে ভাইরাসজনিত (পিসিআর) টেস্ট এবং অ্যান্টিবডি টেস্টের মধ্যে প্রয়োগগত একটা বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এই দুটি পদ্ধতি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারলে আশা করা যায়, সামনের দিনগুলোতে রোগীর পৃথকীকরণ এবং গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দুটিই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আশা করি, কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে দ্রুত উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

*পিএইচডি গবেষক, বায়োমেডিকেল সায়েন্স, পার্ডু ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]

তথ্যসূত্র:
https://www.pnas.org/content/117/17/9490
https://www.jci.org/articles/view/138745
https://www.tehrantimes.com/news/446754/Plasma-therapy-reduces-coronavirus-deaths-in-Iran-by-40
https://www.uscovidplasma.org/safety-report
http://worldometers.info/coronavirus