অসম বিয়ে

ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর প্রেম ও বিয়ে বেশ মজার। ১৫ বছরের কিশোর তার স্কুলের ড্রামা শিক্ষিকার প্রেমে পড়ে। হাইস্কুলে অনেক ছাত্র-ছাত্রীরই সুদর্শন বা সুদর্শনা শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। কিন্তু তা প্রেম বা বিয়েতে গড়ায় না। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত দেখা যায় দু-একটা ঘটনা। ২৪ বছরের বয়সের ব্যবধান কোনো বাধা হয়ে ওঠেনি ব্রিজিত ও ইমানুয়েল ম্যাখোঁর জীবনে। ব্রিজিত এখন আলোচিত ফার্স্ট লেডি।

অসম বিয়ের একটা ঘটনা ব্রিটেনের ট্যাবলয়েডে পড়েছিলাম পাঁচ বছর আগে, যা হঠাৎ করে মনে পড়ল। ৭৫ বছর বয়সী এক নারীর সঙ্গে অনলাইনে পরিচয় হয় ২৩ বছর বয়সী মরক্কোর এক তরুণের সঙ্গে। এই বয়সী নাতি আছে ভদ্রমহিলার। এই পরিচয় পরিণয়ে পরিণত হয়। সবাই বলেন, মহিলার ব্রেন ওয়াশ করা হয়েছে। এই তরুণ ব্রিটেনে থাকার জন্য বিয়ে করেছে। ভদ্রমহিলা বলেন, নাদাল আমাকে ভালোবাসে। আমাকে বোঝে। প্রায় তিন বছর পর মহিলার মৃত্যু হয় মরক্কোর মারাকাশে। নাদালের বাহুতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ভারতের পাঞ্জাবি কবি ৬০ বছরের অমৃতা প্রিতম সিং বিয়ে করেছিলেন তার অর্ধেক বয়সী এক চিত্রকরকে। তার নামটা ভুলে গেছি। সেই বিয়ে টেকেনি। অমৃতার সাক্ষাৎকারে দেখেছিলাম, তিনি বলছেন, ‘শারীরিক নয় মানসিক মেধা আর শিল্প আমাদের কাছে এনেছে।’
আমার এক বান্ধবী খুব দুঃখ প্রকাশ করত তার একমাত্র বড় ভাইকে নিয়ে। আমেরিকায় পিএইচডি করার সময় তার ভাই তার চেয়ে দশ বছরের বড় তার শিক্ষকের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করে তিন এতিম শিশুসহ। এই বিয়ে পরিবারের কেউ মেনে নিতে পারেনি।
বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন মানতে পারছ না?
তার উত্তর ছিল, কি বল! আমার স্বর্ণের টুকরা ভাই, কত খানদানি ফ্যামিলির, কমবয়সী সুন্দরী মেয়ে সে বিয়ে করতে পারত। একটা মাত্র ভাই আমাদের। কত স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে।
তোমার ভাই সুখে আছে। তিনটি এতিম বাচ্চার মাথায় হাত রাখছে। তাকে নিয়ে তোমাদের গর্ব করা উচিত। বলেছিলাম আমি।
রাখো গর্ব। সমাজ আছে না! বান্ধবীর উত্তর।
আমি বলি, আমার ভাইকে সুখী দেখলেই আমি খুশি, আমার স্বপ্ন পূরণ তার জীবনের সুখের বিনিময়ে হবে কেন?
বান্ধবী রেগে যায়। উফ্‌ তোমাকে বোঝাতে পারছি না। পারছ তুমি।
আমি বলি, যে ভাই তোমাদের লেখাপড়া, বিয়ের খরচ, আপ্যায়নের খরচ বহন করে, তার ব্যক্তিগত জীবন সম্মান কর।
আমার আরেক হিজাবি বান্ধবী ওই বান্ধবীকে বলেন, আমাদের নবীজি (সা.) তাঁর চেয়ে বয়সে বড় বিধবা খাদিজাকে (রা.) বিয়ে করছিলেন। সেই হিসেবে তোমার ভাই সুন্নত পালন করছেন।
তখন পাশে বসা এক মুক্তমনা বান্ধবী বলল, সব কথায় নবীর উদাহরণ দেবে না। তাহলে ছয় বছরের শিশু বিয়ে করতে গেলেও নবীর উদাহরণ আনবে লোকজন। আমাদের কথা অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।
আমার বান্ধবীর সেই ভাই ব্রিটেনে যখন তার স্ত্রীকে নিয়ে আসে, এক দাওয়াতে দেখা হয়। মুগ্ধ হই তাদের দুজন দেখে। খিলখিল হাসি, চোখ দেখলেই বোঝা যায় অনেক সুখে আছে দুজন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃতি করে তারা দুজন।
একবার দেখি এক জাপানিজ ভদ্রলোক হুইল চেয়ার ঠেলছেন। হুইল চেয়ারে বসে আছেন তার স্ত্রী। তিনি বয়সে তার চেয়ে সাত বছরের বড় ও যিনি কিনা টারমিনাল ইল। জাপানি ওই ভদ্রলোকের কি গভীর মমতা স্ত্রীর প্রতি।
আমার এক বিপত্নীক প্রতিবেশীর ২৬ বছরের ছেলে তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী নারীকে বিয়ে করে। সম্ভবত মায়ের মমতা তাকে তাড়া করে বেড়ায়। সুখেই জীবন কাটছে তাদের। এখন দুই ছেলেমেয়ে তাদের।
আমাদের দেশে দশ বছরের ছোট কনেকে বিয়ে করা স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো নারী তার চেয়ে দশ বছরের ছোট কোনো পুরুষকে বিয়ে করলে সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বন্ধুরা বলে, দোস্ত তোর বউতো বুড়া।
কার বউ দেখতে কেমন, এটা একটা সামাজিক বিষয়। সবার মন যুগিয়ে পাত্রী নির্বাচন করতে হয়। সবাই বয়সের সঙ্গে বিবাহিত জীবন গুলিয়ে ফেলেন। মুরব্বিদের উপদেশ, বেশি বয়সী মেয়েদের যৌবন যায় দ্রুত। কম বয়সী খোঁজো। বয়সী মেয়েকে দেখতে ভালো লাগে না।
কে বুঝবে এই সামাজিক প্রেশার কত চাপানো। পশ্চিমে ঘরে ঘরে অসম বিয়ে হয়। এক সময় সবকিছুই পুরাতন হয়। দৈহিক জৌলুশ ম্লান হয়। কিন্তু মানসিক তারুণ্য ও ঐক্যে এই বিয়েগুলো সুখ খুঁজে পায়। পৃথিবীর সব সম-অসম বিয়ের যুগল সুখী হোক। দুই দিনের দুনিয়ায় সুখ দিয়ে কথা। একটাই জীবন। যে যেভাবে ভাবে, সেভাবে কাটায়।