অর্থ ও জীবনের সার্থকতা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আচ্ছা, তোমার যদি অনেক টাকা হয় তবে তুমি কি করবে?
কত টাকা বললেন?
বললাম, অনেক টাকা।
আরে ভাই, অনেক টাকার পরিমাণটা বলেন।
এই ধর, তোমার এখনকার যা টাকা তার চেয়ে এক শ গুন টাকা।
চিন্তায় ফেলে দিলেন ভাই। একটা একটা করে শখ পূরণ করব। কিছু টাকা ব্যাংকে জমাব। বাকিটা বিভিন্ন ব্যবসায় খাটাব। টাকায় টাকা আনবে। আর বর্তমান চাকরিটা ছেড়ে দেব। গোলামি করতে মন চায় না।
মনে করুন আপনাকেও এই ধরনের প্রশ্ন করা হয়েছে। আপনি কী উত্তর দেবেন। আমার ধারণা অনেকেই এই উত্তরের কাছাকাছি কোনো উত্তর দেবেন। আমাকে কেউ যদি ছোটবেলায় এই প্রশ্নটা করত তবে আমার উত্তর হতো লাখ লাখ গুঁড়া দুধের টিন কিনতাম। গুঁড়া দুধ আর মুড়ি গুঁড়া করে মিশিয়ে একটা সুস্বাদু খাওয়া তৈরি হতো, সেই থেকেই এই স্বপ্নের শুরু। আর গুঁড়া দুধের স্বাদ অত্যন্ত চমৎকার ছিল সেই বয়সে। একবার অবশ্য গুঁড়া দুধ মনে করে ডিটারজেন্ট খেয়ে ফেলেছিলাম, সেই থেকে গুঁড়া দুধের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি। আমার ছেলেকে যদি জিজ্ঞাসা করি তুমি অনেক টাকা পেলে কি করবে? সে বলবে খেলনা কিনব। যে মানুষ খেতে পায় না, তাকে জিজ্ঞাসা করলে বলবে, টেকা হইলে খানা খামু। যার থাকার ঠিকানা নেই, সে বলবে বাড়ি বানাব।

যার বেতন দশ টাকা, তার কাছে এক হাজার টাকা অনেক টাকা। যার বেতন এক লাখ তার কাছে এক কোটি অনেক টাকা আর যার আয় এক কোটি তার কাছে এক শ কোটি হয়তো অনেক টাকা। অনেক টাকা হচ্ছে আপেক্ষিক কথা। আপনার যখন অনেক টাকা হয়ে যাবে, তখন মনে হবে এটাই স্বাভাবিক, এই টাকাই তো আমার থাকার কথা। তখন আপনি ছুটবেন আরও অনেক টাকার পিছে। এই ‘অনেকের’ পিছে ছোটা বন্ধ করা বেশ কঠিন। কারণ চাহিদা সহজে শেষ হতে চায় না।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে আপনি এই ছোটা থামাবেন অথবা আদৌ ছুটবেন কিনা সেটা নির্ধারণের দায়িত্ব আপনার। আমি দেশে গিয়ে কিছু ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েছিলাম এবার। এক ডাক্তারের চেম্বারে রাত নয়টার সময়ও রোগী বসে আছেন। অনেক রোগী। দেখে আমার আঁতকে ওঠার মতো অবস্থা। তারা বসে আছেন ডাক্তার সাহেবের জন্য। আমার ধারণা ওই ডাক্তার রাত দুইটা পর্যন্ত রোগী দেখেন। যত রোগী তত টাকা, দেখবেন না কেন? পরদিন সকালে ওনার নিশ্চয় সাতটা আটটার সময় ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়। তার যদি সন্তান থেকে থাকে তবে বোধ হয় তাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয় না। ডাক্তার সাহেবের জীবন দেখে মনে হলো, বেচারা মনে হয় টাকা আয়ের চক্রে পড়েছেন। আগামী দশ বিশ বছরে তার কোনো মুক্তি নেই যতক্ষণ না তিনি মনে করেন অনেক হয়েছে এবার থামি। তত দিনে তার ছেলেমেয়েরা নিশ্চয় অনেক বড় হয়ে যাবে, তিনি থামবেন হয়তো কিন্তু সন্তানদের ছোটবেলার সময়টা কি ফিরে পাবেন?
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কার কয়জনের নাম আমরা বলতে পারব। অথবা গত এক শ বছরে যারা যারা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন কতজনের নাম আমরা মনে রেখেছি। যে কয়জনের নাম বলতে পারব এরা আর্থিকভাবে অসাধারণ কেউ ছিলেন না। অসাধারণ কীর্তির কারণে আমরা এদের মনে রেখেছি। আপনি যখন পৃথিবী থেকে চলে যাবেন আপনার সন্তান ও আত্মীয়স্বজন কিছুদিন মনে রাখবেন আপনাকে আর কেউ মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করবেন না। যত অর্থ আয় করেন না কেন আপনি যদি মানুষের জন্য স্মরণীয় কিছু না করে যান আপনাকে মনে রাখার কোনো কারণ নেই। সবাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেখ মুজিবুর রহমান, হ‌ুমায়ূন আহমেদ, ড. ইউনুস হবেন না। অল্প কিছু মানুষ হয়তো হবেন, তাহলে বাকিদের ব্যবস্থা কি? একটা চেষ্টা করা যেতে পারে, এমন কিছু করা যায় যেটার কারণে পাঁচ দশ বছর আপনার পরিবারের বাইরেও অল্প কিছু মানুষ যেন মনে রাখতে পারে। সেটাও খুব বেশি মানুষ পারবে না। বাকিদের ব্যবস্থা কি? বাকি আমাদের মতো যে সব সাধারণ মানুষ তাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে কিনা কে জানে। জীবন চলার জন্য চলা আর দিন শেষে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া এটাই বেশির ভাগ মানুষের নিয়তি। কিছু কিছু অভাগার এমন অবস্থা হয় যে তার চলে যাওয়ার শোক করার মতো মানুষও থাকে না, আত্মীয়স্বজন, পরিবার পরিজনও না।
আপনার জীবনের সার্থকতা যদি হয় শুধু নিজের আর নিজের পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করা তাহলে আপনাকে মনে রাখার কারও দরকার থাকার কথা না। যদি উপার্জনই করতে হয়, এমন কিছু করেন যাতে অন্য দশজন মানুষের উপকার হয়। আপনার মৃত্যুর পরে ওই দশজন হয়তো আপনাকে মনে রাখবেন। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। অর্থ থাকলে মানুষের উপকার করার ইচ্ছে আর বাস্তবায়ন দুটোই সহজ হয়। অনেক বিত্তবান লোক কিন্তু দানশীল হয়ে স্কুল, কলেজ, এতিমখানা এবং বিবিধ রকম মানুষের উপকারী কাজ করেন। কেউ নামের জন্য করেন, কেউ হয়তো পরকালের ভয়ে করেন। এর মাঝে আবার ভেজাল আছে, অসৎ অর্থে বড়লোক হওয়া অনেকে আবার দান খয়রাত করে হালাল থাকার চেষ্টা করেন। আপনার যদি অর্থ, জ্ঞান কিংবা শারীরিক সামর্থ্যও না থাকে তবে আপনার সক্রিয় সমর্থন দিয়ে পুষিয়ে দিতে পারেন। আপনার হয়তো মনে হতে পারে, আমি একজন পৃথিবীতে মানুষের জন্য কিছু না করলে কি যায় আসে, আমার ক্ষমতা খুব সীমিত। ব্যাপারটা ঠিক না, আপনার মতো লাখো মানুষের ক্ষমতা অসীম। ধরুন, আপনি ঠিক করলেন, একজন গরিব ছাত্রকে ছোটবেলা থেকে ভরণপোষণ করে তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবেন। আপনার মতো লাখ লাখ মানুষ যদি এই কাজটা করেন তবে কতজন গরিব মানুষের উপকার হয় চিন্তা করা যায়।
সবার জন্য একটা ব্যাপার প্রযোজ্য আর সেটা হচ্ছে মানুষের জন্য কিছু না করে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না। একেবারে যদি কিছুই না পারা যায়, নিদেনপক্ষে সন্তানদের এমনভাবে বড় করা যায় যাতে তারা মানুষের জন্য ভবিষ্যতে কিছু করে। বেশি কঠিন কঠিন কথা বলে ফেলেছি, কিছু মানুষের গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করি। আমার এক আত্মীয় মোজাইকের ব্যবসা করতেন, একেবারে পেশাদার ব্যবসায়ী। সেই আত্মীয় আমাদের গ্রামের অনেক মানুষকে চাকরি দিয়েছেন, ব্যবসা শিখিয়েছেন, আর্থিক নিশ্চয়তা দিয়েছেন ওই মোজাইক ব্যবসার মাধ্যমে। আমি গ্রামের ও আমাদের অনেক আত্মীয়কে ভালো অবস্থানে যেতে দেখেছি ওনার কারণে। আমার কাছে অর্থ উপার্জন আর মানুষের উপকারের এ এক অনন্য রোল মডেল। চলার পথে কিছু মানুষকে দেখেছি সারাক্ষণ মানুষের উপকারের জন্য কিছু করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যখনই কারও বিপদ হচ্ছে, নিজের সামর্থ্য দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। এরা কেউ নাম কামানোর জন্য কাজ করেন না, করেন মানুষের জন্য। মানুষ এমনিতেই এদের মনে রাখবে।