অমর্ত্য দর্শন ও মানব মুক্তির আন্দোলন

অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে—এই নিয়ে ২০০৪ সালে শ্রোতা জরিপের আয়োজন করেছিল বিবিসি বাংলা। ৩০ দিন চালানো এই জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০ জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। সেই জরিপে শ্রোতাদের ভোটে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ১৪তম স্থান অধিকার করেন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। একজন অর্থনীতিবিদের ১৪তম স্থান অর্জন বিস্ময়কর। অর্থনীতিবিদদের জীবন ও কর্ম অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের চোখের আড়ালে থাকে। এ রকম আড়ালে থাকা একজন অর্থনীতিবিদ প্রথম ২০ জনের মধ্যে যখন অবস্থান করেন, তখন তাঁর কর্ম, ব্যক্তিত্ব ও জনসম্পৃক্ততা নিয়ে বিশেষ ভাবে ভাবতে হয়।

বিবিসির জরিপে সব শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। জনপ্রিয় হওয়ার জন্য মানুষের কাছে এক ধরনের ভালোবাসা পেতে হয়। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা তৈরির যে রসায়ন, সে রসায়নের প্রচলিত উপাদানের অনেক কিছুই সাধারণত অনুপস্থিত থাকে অর্থনীতিবিদদের কর্মে। আর তাঁদের ক্ষেত্রে জনসম্পৃক্ততার সুযোগও খুব সীমিত। অমর্ত্য সেন তাহলে কেন সর্বস্তরের বাঙালির কাছে এত প্রিয়, শ্রদ্ধেয় ও কাছের মানুষ? লেখার শুরুতেই একটি কথা সাধারণীকরণ করে বলে দেওয়া যায়, অমর্ত্য সেন অর্থনীতির প্রচলিত পথ ভেঙে দিয়ে নতুন একটি পথের উন্মোচন করেন। সে পথে হেঁটে তিনি যে ভাষায় কথা বলেন, যে বিষয় সামনে নিয়ে আসেন তা হলো প্রচলিত ধারার অনেক বাইরের একটি পথ ও বিষয়। যে কারণে মানুষ তাঁর সঙ্গে হাঁটতে উদ্‌গ্রীব হয়ে পড়ে, কথা শোনার জন্যও কান পেতে থাকে, লেখা পড়ার জন্য আরও মনোযোগী হয়ে ওঠে।

অমর্ত্য সেন যখন বলেন, প্রচলিত উন্নয়ন পরিমাপের পথ ভিন্ন হওয়া দরকার। গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট কিংবা পার ক্যাপিটা ইনকাম একটি জাতির উন্নয়নকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে সমর্থ নয়। সারা বিশ্বের মানুষ এবং অর্থনীতি নিয়ে যারা দীর্ঘদিন কাজ করে আসছেন, তাঁদের আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকাতে হয়। কোনো অর্থনীতিবিদ এ রকম সহজভাবে প্রয়োজনীয় কথা এর আগে কখনো বলেননি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সব পক্ষের মত এবং মতাদর্শের বিকাশ ও মতাদর্শগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি বলে তিনি মনে করেন। অমর্ত্য সেন অর্থনীতিকে সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি ও দর্শনের সঙ্গে যুক্ত করে মানব মুক্তির জন্য একটি সমন্বিত পথের সন্ধান দেন।

অর্থনীতির সঙ্গে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, নারী অধিকারকে জুড়ে দিয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেন অমর্ত্য সেন। মানুষের দারিদ্র্য হলো স্বাধীনতাহীনতার একটি ফল তা তিনি প্রমাণ করে দেন। অমর্ত্য সেনের মতে, দরিদ্র দেশে মানুষের স্বাধীনতা নেই, তাই তারা দরিদ্র। অতীতে এই দেশগুলোকে অনেক অর্থনৈতিক সাহায্য ও অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়েও তাদের উন্নতি সম্ভব হয়নি। একটি দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসার সব অবকাঠামো এবং প্রশিক্ষিত মানুষের উপস্থিতি কেবল সেবা পাওয়ার স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে পারে না। মানুষের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন এসব সেবা খাতে মানুষের নানা ভাবে প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে অংশগ্রহণ। আর এ কাজটি করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন অবাধ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি। সেবা ক্ষেত্রে মানুষের সেবা পাওয়া একটি অধিকার। সেই সেবা পাওয়ার স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা না গেলে, প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না।

স্বাধীনতার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক তিনি জ্যামিতির উপপাদ্যের মতো করে প্রমাণ করে দেন। উদাহরণ হিসেবে অমর্ত্য সেন কেরালাবাসী, আমেরিকান আর আফ্রিকান-আমেরিকানদের তুলনা করে দেখান। এই তিন গোষ্ঠীর মধ্যে কেরালাবাসীদের আয় সবার নিচে, তারপর আফ্রিকান-আমেরিকানদের আর তারপর আমেরিকানদের। অথচ এঁদের মধ্যে আফ্রিকান-আমেরিকানরা সবচেয়ে কম দিন বাঁচেন। আর কেরালাবাসীদের গড় আয়ু ৭০-এর কাছাকাছি। তাঁর মতে আয় বাড়লেই যদি মানুষ সুখী হয়, তাহলে কেরালাবাসীদের আয় কম হয়েও তাদের আয়ু এত বেশি কেন? কারণ তারা প্রয়োজনীয় স্বাধীনতাগুলো ভোগ করে থাকে, যা আফ্রিকান-আমেরিকানরা পায় না। আফ্রিকান-আমেরিকানদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সবক্ষেত্রে কমতি রয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বিমা নেই, যদিও আমেরিকানদের এই বিমা থেকে থাকে। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে তাদের মধ্যে অপরাধমূলক কাজে জড়ানোর প্রবণতাও বেশি।

অমর্ত্য সেন স্বাধীনতার একটি নতুন ভাবনা তুলে ধরেন। তাঁর মতে, স্বাধীনতা হচ্ছে উন্নয়নের মাধ্যম ও লক্ষ্য। স্বাধীনতাকে উন্নয়নের মাধ্যম বলা হচ্ছে এই অর্থে যে, স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। যেমন, যেসব দেশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এগিয়ে তারা জিডিপিতেও এগিয়ে। আর স্বাধীনতাকে উন্নয়নের লক্ষ্য বলা হচ্ছে এই অর্থে, জিডিপি বৃদ্ধির জন্য নয়, স্বাধীনতাকে জনগণের মৌলিক অধিকার বিবেচনা করেই নিশ্চিত করতে হবে, কেননা মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা-ব্যতীত উন্নয়নের আলাপ মাত্রই অপলাপ। তাহলে উন্নয়নের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য কী? উন্নয়নের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যকে তিনি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সহজ ভাষায় তুলে ধরেন। তাঁর মতে, পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুরই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। একটি গ্লাসের উদ্দেশ্য পানি ধরে রাখা, জ্ঞানের উদ্দেশ্য মানুষকে সত্যের সন্ধান দেওয়া, মানুষকে আরও সভ্য করে তোলা। তাহলে প্রশ্ন চলে আসে, উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য কী? কেন উন্নয়ন চাই? কখন একটি দেশ বলতে পারে যে আমরা উন্নত? এসবের উত্তরে অমর্ত্য সেন বলেন, উন্নয়নের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। মানুষ যেন খেতে চাইলে খেতে পায়, একই ভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য বিষয়ে মানুষের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সুচিন্তা ও সমদৃষ্টি।

প্রতিষ্ঠিত ধারণা ও তত্ত্বে মোটাদাগে উন্নয়নের পথ দুটি। একটি হচ্ছে বহুল পরিচিত সময় ও খরচসাপেক্ষ পথ, যেখানে উন্নয়নের মাপকাঠি হলো মোট জাতীয় আয়। কলকারখানা বাড়িয়ে প্রযুক্তির সহায়তায় বাড়াতে হবে উৎপাদন, তার দ্বারা নিজেদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাড়বে রাষ্ট্রীয় আয়, বাড়বে জিডিপি-মোটামুটি এ রকম ধারার উন্নয়নের প্রাথমিক পথরেখা এটাই। এই ধারার উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বৈষম্যকে চিহ্নিত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। বৈষম্য নিরসন না হলে উন্নয়নের সার্বিক উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। অমর্ত্য সেন তাঁর জীবনের শুরুতে বাম ঘেঁষা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি জানেন মানুষে মানুষে বৈষম্য হ্রাস না হলে কোনো ভাবেই সুষম উন্নতি নিশ্চিত হতে পারে না। উত্তর আধুনিক অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন উন্নয়নের জন্য একটি পথ অনুসরণ করার পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, উন্নয়ন মানে শুধু দেশের আয় ও ধন সম্পদ বৃদ্ধি নয়, বরং উন্নয়ন প্রকৃত অর্থবহ হয় স্বাধীনতায়, উন্নয়ন মানেই হচ্ছে স্বাধীনতা। ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়ার কৃতিত্বও এই ভাবনাটির।

অমর্ত্য সেন বলেন, উন্নয়নের পথ খুবই সহজ সরল, মানুষের আয় বৃদ্ধির বদলে সে পথ মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, কল্যাণ ইত্যাদি নিশ্চিত করে।

বৈষম্য নিরসনে সবার মতামত জানা আবশ্যক। তিনি তাই মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সংগঠিত ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস আন্দোলন অমর্ত্য সেনকে যে অনেক উজ্জীবিত করেছে তা ভারতীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খোলামেলা ভাবে তিনি তা ব্যক্ত করেন। তিনি সুস্পষ্ট ভাবে বলেন, ‘আমেরিকায় যে নতুন জিনিসটা আজ দেখছি, তার পেছনেও একটা বড় রকমের পরিবর্তন আছে, যাকে বলা যেতে পারে র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট। যাঁরা পিছিয়ে রয়েছেন, কৃষ্ণবর্ণের লোকেরা, ল্যাটিন আমেরিকান লোকেরা, তাঁদের কী করে সুযোগ দেওয়া হবে, এই নিয়ে বড় রকমের চিন্তা, আলোচনা, আন্দোলন—ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার ইত্যাদি।’

ভারতবর্ষে গণমানুষের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মসূচি তুলে ধরে বামপন্থী দলগুলো। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী দলগুলোর বিপর্যয় নিয়ে তাঁকে দুঃখ এবং হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যায়। একই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ভারতবর্ষে তো উল্টো হয়েছে। বামপন্থী রাজনীতি প্রায় উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা। পশ্চিমবঙ্গে তো বামপন্থী দলগুলো একটাও সিট পেল না। এটা তো শুধু বামপন্থার দুঃখের কথা না, এর মধ্যে যে সামাজিক ঘাটতি ধরা পড়ল, সেটা তো নানা ভাবে আমাদের কষ্ট দেবে। সেটা শুধু বামপন্থীদের ঘাটতি না, সব মানুষেরই ঘাটতি। কারণ এক ধরনের চিন্তাধারা বামপন্থা দিয়ে আসে, যেটা অন্য দিক থেকে পাওয়াটা কঠিন।’ এ মতামতটি কিন্তু তাঁর অতি সাম্প্রতিক। সাক্ষাৎকারটি আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয় চলতি বছরের ৮ জুন।

সারা বিশ্বে যখন দেখতে পাই প্রান্তিক মানুষের স্বাধীনতা ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে, ক্ষমতাশালীদের অর্থ, বিত্ত ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুবিধা দ্রুত প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে, এ রকম সময়ে অমর্ত্য সেন আমাদের কাছে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। অমর্ত্য সেনের প্রাসঙ্গিকতা অগণন দিন হয়তো পৃথিবীতে থেকে যাবে। প্রথাগত উন্নয়নে যত বেশি বৈষম্য সৃষ্টি হবে অমর্ত্য সেন তত বেশি মানুষের সামর্থ্য বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে থেকে যাবেন। গণতন্ত্র ও মানব মুক্তি খুব কাছাকাছি দুটি বিষয়। একটি অনুশীলন আর একটি ফলাফল। গণতন্ত্রের বিকাশে মানব মুক্তি নিশ্চিত হয়। যত দিন মানব মুক্তি নিশ্চিত না হবে তত দিন গণতান্ত্রিক আন্দোলন পৃথিবীতে বহমান থাকবে। মনে রাখতে হবে, এখনো গণতন্ত্রের বিকল্প কোনো মতাদর্শের সন্ধান পায়নি বিশ্ব রাজনীতি। আধুনিক বিশ্বে বহু মত ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে মানব মুক্তির দেওয়ার উন্মোচনের জন্য তাই অমর্ত্য দর্শনের কাছে বারবার ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই—এ কথাটি আপাতত জোর দিয়ে বলা যায়।