অভিভাবকত্ব ও প্রজন্মের একাল-সেকাল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

একটি শিশুর জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত মা-বাবা অনেক কষ্ট করে থাকেন। এমনকি সন্তানেরা বড় হয়ে গেলেও মা-বাবার কাছে আজীবন ছোটই থাকে। যত দিন বেঁচে থাকেন সন্তানের ভালোর জন্য নিরন্তর চেষ্টা করেন। এই কষ্টের প্রতিদান কখনো দেওয়া সম্ভব নয়। প্রতিদানযোগ্য কি না, এ রকম ভাবাও সম্পূর্ণ অমূলক।

মা-বাবা তাঁদের সর্বস্ব দিয়ে সন্তানদের লালনপালন করার চেষ্টা করেন। তাঁদের ওপর ভর করেই গড়ে ওঠে আমাদের প্রজন্ম। এভাবেই ভালোবাসা, মায়া-মমতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। সন্তানকে লালনপালন করার পদ্ধতি কিংবা রীতিনীতি পরিবারভেদে কিংবা দেশ–সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে।

কোনটি ভালো কিংবা কোনটি বেশি কার্যকর, এটা বলা বেশ মুশকিল। তবে এটা মূলত নির্ভর করে সন্তানেরা এই পদ্ধতি বা রীতিনীতির সঙ্গে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, তারা এই বেড়ে ওঠার পারিবারিক পরিবেশে কতটা সুখী। নিজেদের বা পরিবারের সিদ্ধান্তের কতটুকু তারা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মেনে নেয় বা মেনে নিতে হয়। সবগুলো সিদ্ধান্ত কি বাবা-মা ভালো নিতে পারেন বা অধিকার রাখেন নাকি সন্তানেরাও কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সক্ষম বা অধিকার রাখে।

আজ থেকে ১০ বছর আগেও প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক পড়ার সময় বাবা-মায়ের বকা কিংবা বেতের আঘাত পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। এখন অবশ্য সময় অনেক বদলে গেছে। পাল্টে গেছে শাসন করার ধরনও। তবে এখনো কিছু ব্যাপার আছে যা অনেক পরিবারে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। যার কিছুটা অংশ আত্মীয়স্বজন কিংবা সমাজের মানুষগুলোর মাধ্যমে এখনো নিয়ন্ত্রিত হয়। জটিলতা তৈরি হয় তখনই, যখন এই অপরিবর্তনের সংস্কৃতি মাত্রা ছাড়িয়ে সন্তানের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। নিজের ইচ্ছেগুলো–স্বপ্নগুলোকে হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রাখতে হয় মা-বাবার বেঁধে দেওয়া শর্তগুলো পূরণ করতে গিয়ে।

অনেক মা-বাবা এখনো নিজেদের অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলো তাঁদের ছেলেমেয়েদের দিয়ে পূরণ করতে চান। অনেক সময় দেখা যায়, এই স্বপ্ন প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন কিংবা সহকর্মীদের থেকে অনুপ্রাণিত বা ধার করা স্বপ্ন। আমাদের দেশে মা-বাবা খুব প্রচলিত একটা স্বপ্ন দেখেন—তাঁদের ছেলেমেয়ে ডাক্তার নয়তো প্রকৌশলী হবে। এটা বর্তমান সমাজের একটা প্রচলিত ধারণাও বলতে পারেন।

এই স্বপ্নপূরণ করার জন্য কেউ কেউ তাঁদের সন্তানদের উৎসাহিত করেন, কেউ কেউ হয়তো জোর করে চাপিয়ে দেন। উৎসাহ পেয়ে হয়তো অনেক ছেলেমেয়েই মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। যাঁরা উৎসাহিত করতে জানেন না বা পারেন না, তাঁরা নিজেদের স্বপ্ন পূরণের মিছিলে ভুলে যান তাঁদের সন্তানদের স্বপ্নগুলোকে। নিজেদের ইচ্ছেগুলোকে জোর করে চাপিয়ে দেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের ওপর। যে ছেলেটা স্বপ্ন দেখে ব্যাংকার হওয়ার, সে হয়ে যায় প্রকৌশলী। যে মেয়েটা স্বপ্ন দেখে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে কাজ করার, সে হয়ে যায় ডাক্তার। চারুকলায় পড়তে চাওয়া ছেলেমেয়ে হয়ে যায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট।

এ রকম হাজারো ঘটনা আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে। সত্যতা যাচাই করতে চাইলে, বিশ্ববিদ্যালয়–মেডিকেল পাড়ায় গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। কোনো কোনো ছেলেমেয়ে হয়তো কোনো কিছু বলতে না পেরে মেনে নেয় আর একটুকরো কাগজের সনদপত্রের জন্য তাদের স্বপ্ন বা ইচ্ছেগুলোকে গলা টিপে হত্যা করে। যারা মেনে নিতে পারে না, তারা হয়তো প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার কারণ খোঁজে।

জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার এই অসুস্থ সংস্কৃতি শুধু এই ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বিয়ের মতো জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের সময়ও ঠিক একই রকম প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বাবা-মা মনে করেন বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছেলেমেয়েরা নেওয়ার সামর্থ্য বা অধিকার কোনোটাই রাখে না। সব পরিবারেই এ রকম ঘটে ব্যাপারটা এমন না। বর্তমানে অনেক মা-বাবা বিয়ের ক্ষেত্রে সন্তানদের পছন্দকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

তবে বেশির ভাগ পরিবারে এখনো এ রকম চর্চা দেখা যায় না। সমস্যা আরও তীব্র হয় যখন ছেলেমেয়ের নিজস্ব কোনো পছন্দ থাকে। মা-বাবা মনে করেন এর থেকে খারাপ বা নিচু মানের প্রোফাইল হতেই পারে না এবং কোনোভাবেই এই পছন্দ মেনে নেওয়া যাবে না। ব্যাপারটা এ রকম নয় যে, পছন্দ করা ছেলে–মেয়ের যোগ্যতা নিয়ে কোনো সমস্যা। শুধু ছেলে–মেয়ের নিজস্ব পছন্দ বলেই অভিভাবক মেনে নিতে চান না। আবেগ দিয়ে হোক বা শাসন করে, যেভাবেই হোক নিজেদের অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠা করবেই। হয়তো বলবেন, তোমার পছন্দের কাউকে বিয়ে করলে আমাদের মা-বাবা ডাকার অধিকার থাকবে না কিংবা বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে। এ রকম অজস্র শর্ত দিয়ে নিজেদের অভিভাবকত্ব ও ইচ্ছেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা অসুস্থ প্রবণতা থাকবেই।

বাবা-মায়ের কাছে এভাবে সন্তানের হেরে যাওয়া কতটা তৃপ্তির, তা মা-বাবাই ভালো বলতে পারবেন। কোনো কোনো অভিভাবক হয়তো আলোচনা করেন। অনেক ক্ষেত্রেই একবারের জন্য মা-বাবা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ইচ্ছে–স্বপ্নগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন না। বাধ্য হয়েই অনেকে হয়তো মেনে নেয় বা নিতে চেষ্টা করে। দুমড়েমুচড়ে ভেঙে ফেলে নিজেদের তিলে তিলে গড়া স্বপ্নগুলোকে। নীরবে, আড়ালে লুকিয়ে কাঁদে নিজের ভালো লাগা-ভালোবাসার মানুষকে ভুলতে গিয়ে। অসহায় হয়ে যায় তার মা-বাবার চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বোঝা নিতে গিয়ে। বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টায় বোঝা টানতে গিয়ে অনেকেই হারিয়ে ফেলে নিজের সত্তাকে। হয়ে যায় ভেঙে যাওয়া কাচের টুকরোর মতো। বোঝা বইতে গিয়ে কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে যায়। অতঃপর বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। এ রকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটে।

সব মা-বাবাই সন্তানের ভালো চিন্তা করেন। কিন্তু সব সময়ই যে সেই চিন্তা সন্তানের জন্য ভালো বা মঙ্গল বয়ে আনবে, এ রকম ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। মা-বাবা সবকিছুতেই সন্তানদের থেকে ভালো বোঝেন বা তাদের সিদ্ধান্তই ভালো বা সঠিক, এটা মোটেও ঠিক নয়। জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত ছেলেমেয়েকে নিতে দিতে হবে। মা-বাবাকে তাদের ভালো লাগা, পছন্দ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। তাদের মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্য দিতে হবে। অসংগতি থাকলে তাদের বোঝাতে হবে।

জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার অসুস্থ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বাবা-মায়ের আবেগপ্রবণ কৌশল বা শাসনের নামে চাপিয়ে দেওয়ার অপকৌশল থেকে সরে আসতে হবে। সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুসুলভ হতে হবে। একটা চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত এবং প্রতিবাদ করতে না পারার পরিমাণ কতটা ভয়াবহ তা সেই ছেলেমেয়ে ছাড়া আর কেউ জানে না। কত সন্তান হারিয়ে ফেলে তাদের জীবনের সবচেয়ে মূলবান সময়। তছনছ হয়ে যায় তাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। পালিয়ে বেড়ায় নিজের ছায়া থেকে শুধু নিজের ইচ্ছেগুলোকে মরতে দেখে। হাজারো ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায় অভিভাবকের অভিভাবকত্বের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায়।

হয়তো একদিন সব অভিভাবক চাপিয়ে দেওয়ার ঐতিহ্য থেকে সরে আসবেন, সেদিন আর ভাঙবে না কোনো সন্তানের স্বপ্ন, হারাবে না কেউ নিজের সত্তাকে। বেঁচে থাকুক সবার স্বপ্ন।